জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।
আট.
সূ²াতিসূ² অভ্যাস এবং পদ্ধতি
অভ্যাস পরিবর্তন করতে আপনার যদি সমস্যা হয় তবে সমস্যাটি আপনি নন। আপনি যে পদ্ধতিতে অভ্যাস পরিবর্তন করছেন সমস্যা সেখানে। খারাপ অভ্যাস বারবার নিজেদের পুনরাবৃত্তি করে কারণ আপনি অভ্যাসটি পরিবর্তন করতে চান না এমন নয়, বরং পরিবর্তনের জন্য গৃহীত পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে।
শুধু লক্ষ্যের পিছনে ছুটলে আপনি আপনার লক্ষ্যের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারবেন না। লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনাকে বার বার আপনার গৃহীত পদ্ধতির কাছে ফিরে আসতে হবে।
একটি একক লক্ষ্য অর্জনের পরিবর্তে লক্ষ্য অর্জনের সামগ্রিক ব্যবস্থার উপর ফোকাস করা এই গ্রন্থের অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। অ্যাটমিক শব্দের গভীর অর্থগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত পরিবর্তন একটা নিগুড় বিষয়। এতক্ষণে আপনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন যে অ্যাটমিক অভ্যাস হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র পরিবর্তনের নাম, কোন কিছুর প্রান্তিক ফলাফল, একটি ১ শতাংশ উন্নতিকে নির্দেশ করে কিন্তু অ্যাটমিক অভ্যাস কেবল কোন পুরানো অভ্যাসকে নির্দেশ করে না। ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলো সব সময় একটি বৃহত্তর পদ্ধতির অংশ। পরমাণু হল কতগুলো অণুর যৌগ, সূ²াতিসূ² অভ্যাসও তদ্রæপ উল্লেখযোগ্য ফলাফল সমূহের যৌগ।
অভ্যাসগুলো আমাদের জীবনে পরমাণুর মত। প্রতিটি এক একটি মৌলিক ইউনিট যা আপনার সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখে। শুরুতে একটা ছোট রুটিন তুচ্ছ মনে হয়, কিন্তু শীঘ্রই ব্যক্তির সমস্ত অভ্যাস একে অপরের সাথে যৌগ সৃষ্টি করে এবং বড় জয়ের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করে। শুরুতে যে প্রাথমিক বিনিয়োগ করেছিলেন, বার বার অনুশিলনের জন্য সেটার অনেক বড় ফলাফল অর্জন করেছেন। অভ্যাস এবং অ্যাটম উভয়েই যেমন ক্ষুদ্র তেমনি শক্তিশালী। অ্যাটমিক হ্যাবিট শব্দদ্বয়ের অর্থ অভ্যাস-এক বিষ্ময়কর শক্তির উৎস। অভ্যাসের নিয়মিত অনুশীলন বা একটা রুটিন কার্যকর করা অত্যন্ত সহজ বাস্তবায়ন যোগ্য ছোট্ট একটা কাজ এবং একই সাথে বিষ্ময়কর শক্তির উৎস। অভ্যাস একটা বৃহদাকার প্রক্রিয়ার অংশ যা যৌগিক প্রভাব সৃষ্টি করে।
নীতিমালা-২
আপনার অভ্যাস কিভাবে আপনার নতুন পরিচয় সৃষ্টি করে
কেন খারাপ অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করা এত সহজ এবং ভাল অভ্যাস গড়ে তোলা এত বেশি কঠিন? দৈনন্দিন অভ্যাস উন্নত করার চেয়ে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলো আপনার জীবনে আরও শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে । তবুও পরের বছর নতুন এবং অপেক্ষাকৃত ভাল কিছু শুরু করার চেয়ে আপনি যে অভ্যাসটি গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন সেটির পুণরাবৃত্তি করতে থাকা উত্তম।
ভালো অভ্যাসগুলোকে দীর্ঘ দিন ব্যাপী ধরে রাখা প্রথম কিছু দিনের জন্য বেশ কঠিন মনে হয়। এমনকি আন্তরিক প্রচেষ্টা সমৃদ্ধ অভ্যাস এবং ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার কাজ যেমন শরীর চর্চা করা, ধ্যান করা, পত্রিকায় লেখালিখি করা এবং রান্না করার মত অভ্যাস এক বা দুই দিনের জন্য যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, পরে এগুলকে একটা উটকো ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
আবার একবার আপনার জীবনে অভ্যাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেগুলি চিরকালের সঙ্গী হয়ে যায়। বিশেষ করে অবাঞ্ছিত অভ্যাসগুলো। অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন জাঙ্ক ফুড খাওয়া, অনেক বেশি টেলিভিশন দেখা, সকল কাজে বিলম্ব ঘটান, ধূমপান ইত্যাদি। এই অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করা অসম্ভব মনে হতে পারে।
অভ্যাস পরিবর্তন করা দুটি কারণে চ্যালেঞ্জিং: (১) ভুল জিনিস পরিবর্তন করার জন্য আমরা চেষ্টা করি এবং (২) ভুল পথে অভ্যাস পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। এই অধ্যায়ে আমি প্রথমটি আলোচনা করব। আসছে অধ্যায়ে আমি দ্বিতীয় কারণটির উপর আলোকপাত করবো।
আমাদের প্রথম ভুল হল আমরা ভুল জিনিস পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝার চেষ্টা করুন। ধরুন তিনটি স্তরে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটতে পারে। পেঁয়াজের স্তরগুলির মত এই স্তর তিনটিকে কল্পনা করতে পারেন।
প্রথম স্তরটি আপনার ফলাফল পরিবর্তন করছে। এই স্তরটি আপনার ফলাফল পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন: ওজন কমানো, বই প্রকাশ, একটি চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করা। আপনার নির্ধারিত লক্ষ্য সমূহের অধিকাংশই এই স্তরের সাথে যুক্ত।
দ্বিতীয় স্তরটি পদ্ধতিগত পরিবর্তনকে নির্দেশ করছে। আপনার অভ্যাস পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট: জিমে একটা নতুন রুটিন বাস্তবায়ন করা, অধিকতর কর্ম-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য আপনার টেবিলটিকে ছিমছাম ও পরিচছন্ন রাখা, একটি ধ্যান অনুশীলন ও এর বিকাশ ঘটানো। আপনার সৃষ্ট বেশিরভাগ অভ্যাস এই স্তরের সাথে যুক্ত।
তৃতীয় এবং গভীরতম স্তরটি আপনার পরিচয় পরিবর্তন করে। এই স্তরটি আপনার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত: আপনার বিশ্বদর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি, আপনার ব্যক্তি-ইমেজ, নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে আপনার ধারণা। আপনার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, অনুমান এবং পক্ষপাতগুলি এই স্তরের সাথে যুক্ত।
আপনি যা কিছু অর্জন করলেন সেটা ফলাফল। যে কর্ম-প্রক্রিয়া আপনাকে নির্দিষ্ট ফলাফল এনে দিল সেটা পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। অভীষ্ট ফলাফল অর্জনের পথে আপনি যা কিছু বিশ্বাস করেন সেটা আপনি বা আপনার ব্যক্তিত্ব। যখন একটা দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী অভ্যাস গঠনের প্রশ্ন আসে বা যখন ১ শতাংশ উন্নতির পদ্ধতি নির্মাণের প্রশ্ন আসে- সে ক্ষেত্রে একটি স্তর ভালো আবার অন্যটি খারাপ, বিষয়টি এমন নয়। পরিবর্তনের সকল স্তরই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হচ্ছে পরিবর্তন প্রবাহ কোন দিকে ধাবমান।
অনেকে তাদের অভ্যাস পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেন তারা কি অর্জন করতে চান তার উপর মনোযোগী হয়ে। এটি আমাদের ফলাফল ভিত্তিক অভ্যাসের দিকে নিয়ে যায়। বিকল্প হল পরিচয়-ভিত্তিক অভ্যাস গড়ে তোলা। পরিচয়-ভিত্তিক অভ্যাস করলে আমরা কে হতে চাই তার উপর মনোযোগী হতে শেখায়।
লক্ষ্য করুন দুজন ব্যক্তির একটি সিগারেট প্রত্যাখানের প্রতিক্রিয়া, উভয়ে ধূমপান পরিত্যাগ করার কাজে ব্যাস্ত। যখন তাদের দুজনকে ধূমপানের প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন প্রথম ব্যক্তি বলেন, ‘না ধন্যবাদ। আমি ধূমপান পরিহার করার চেষ্টা করছি।’ প্রতিক্রিয়াটি যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তিনি এখনও ধূমপায়ী, তিনি অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করছেন। সিগারেট অফারকারী ও প্রত্যাখানকারী একই মূল্যবোধ বা বিশ্বাস বহন করে চলেছেন কিন্তু প্রত্যাখানকারী আশা করছেন তার আচরণের পরিবর্তন হবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি অস্বীকার করে বললেন, ‘না ধন্যবাদ। আমি ধূমপায়ী নই।’ দুটি বিবৃতিতে ছোট একটা পার্থক্য লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বিবৃতিটি একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ধূমপান তার অতীত জীবনের অংশ ছিল, বর্তমানে তিনি ধূমপায়ী নন। তিনি ধূমপায়ী হিসেবে আর নিজের পরিচয় দেন না।
বেশিরভাগ মানুষ যখন উন্নতি করার জন্য নতুন কিছু শুরু করেন তখন তারা নিজেদের পরিচয়ের পরিবর্তনকে বিবেচনা করেন না। তারা ভাবেন, “আমি মেদ শূন্য আকর্শনীয় শরীরের মালিক হতে চাই (ফলাফল) এবং আমি যদি এই ডায়েটে লেগে থাকি তবে আমি আকর্শনীয় শরীরিক গঠনের অধিকারী হব (প্রক্রিয়া)।” তারা লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য তাদের কর্ম-পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। তারা তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধের কথা বেমালুম ভুলে যান। তারা কখনই নিজেদের দিকে ফিরে দেখেন না। তারা বুঝতে পারেন না যে তাদের পুরোনো মূল্যবোধ পরিবর্তনের সমস্ত নতুন পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিতে পারে।
প্রতিটি কর্ম পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে মানুষের বিশ্বাসবোধ। গণতন্ত্রের কাঠামো দঁড়িয়ে আছে কতগুলো বিশ্বাসবোধের উপর যেমন গণতন্ত্র মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিৎ করে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় ইত্যাদি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সামাজ কাঠামো। (চলবে)…
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।