ইউসুফ কামাল : কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে এসেছিলাম। ক্লাস চলছিলো পুরোদমে তবু পারিবারিক সমস্যার কারণে যেতে পারছিলাম না উপরন্তু মনও সায় দিচ্ছিল না, আর আমি নিজেও ঐ অসীম শূণ্যতায় ঢোকার সাহস যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাবার রিটায়মেন্ট এ একটা অতিরিক্ত চাপ পড়লো পরিবারের উপর। প্রায় পনেরো দিন বাড়িতেই থাকতে হলো বা থাকলাম। মনের দিক থেকেও ঢাকা শহরে থাকাটাও কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিলো।
এমনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নিজের প্রিয় ডিপার্টমেন্টটাও একটা নিরানন্দ স্থানে পরিণত হয়ে গেল আমার কাছে। যেখানে আগে আসার জন্য উদ্বগ্রীব হয়ে থাকতো মন, সেটাই এখন দুর্বিসহ যন্ত্রণার জায়গা। তাই তো মনের তাগিদেই ঢাকা ছেড়ে একটু হলেও পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। বাড়িতে থাকার বিষয়টা একটু ভিন্নতর, পুরনো বন্ধুরাসহ চিরপরিচিত পরিবেশ। বাবা মা’ সাহচর্যে থাকার সাথে যেন সবার কাছ থেকেই একটা নৈকট্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। মনের অশান্ত ভাবটা আস্তে আস্তে দূরে ঠেলে দিতে সাহায্য করে। এমনি অবস্থার মধ্যেই একদিন সকাল ৯টায় বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠলো। ধরতেই সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, ধরেই ভাবলাম ও জানলো কেমন করে আমি এখনো ঢাকা যাইনি? ওপার থেকে বুলার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ‘বাড়িতে সমস্যা কি বেশি? এত দিন তো থাকার কথা না, তোমার না ক্লাস চলছে?’ বল্লাম, সমস্যা তো আছেই, সর্বত্রই এখন আমার সমস্যা। কোথাও ন্যূনতম শান্তির লেশমাত্র নেই। কিছুই যে ভালো লাগে না। বল্লাম ঢাকাতে এখন একটুও ভালো লাগে না। যেখানে যাই কেমন যেন সব কিছুই বিবর্ণ মনে হয়। টিএসসি’তে তুমি চলে আসার পর দুই দিন গিয়েছিলাম, সেই টেবিলটার কাছের সেই চেয়ারটা ধরে দাঁড়ালাম যেটায় তুমি বসতে।
আলতো করে হাত দিয়ে তোমার স্পর্শ অনুভব করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। যেখানটায় ঘাড় এলিয়ে দিয়ে তুমি আমার সাথে কথা বলতে। মনে হলো এই মাত্র তুমি উঠে গেছো এখনো তোমার শরীরের উত্তাপ লেগে আছে। মনে হলো ‘প্যারী এ্যালিস নাইট’ এর সেই মিষ্টি সুবাসটা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। চারিদিকে তাকালাম কৈ তুমি তো নাই। তোমার ছাড়া যে এমন লাগবে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। তোমার চলে যাওয়া মানেই যেন আমার পুরো অস্তিত্বটাই হারিয়ে যেতে থাকলো। মনটা ভীষণ একা হয়ে গেলো, মনে হলো কোথাও তোমার গাওয়া সেই গানের সুরগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে –
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে চাঁদের আলোর দেশে গেছে
যেখান দিয়ে হেসে গেছে হাসি তার রেখে গেছে রে
মনে হলো আখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে
আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ……..
(বুলার গান গাওয়ার সময় মনে হতো ওর সমস্ত স্বত্তা গানের ভাষার সাথে মিশে গেছে, ওর নিজের মনের কথা বুকের ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। মনে হতো গানের কথাগুলো যেন অদ্ভুত এক মাদকতায় ভরা, একান্তই ওর নিজের কথা)।
বিষয়টা বিদ্যুৎ বুঝতে পেরেছে আমার কাঁধে হাত রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বল্লো, চলো বেরোই। হয়তো আমার বুক ভাংগার শব্দটা ওকেও স্পর্শ করেছে। ও নিজেও বুলাকে অত্যাধিক স্নেহ করতো। তারপর থেকে আমি আর টিএসসি’তেই ঢুকিনি। কেন যাবো তুমি নাই যে ওখানে, গেলেই বরং আরো খারাপ লাগে। শূণ্যতা এসে ভর করে সারা মন জুড়ে।
মনের একাকীত্ব দূর করার জন্য পুনুর হলে গিয়েছি, ওর সাথে কথা বল্লে যদি ভালো লাগে, মনে হতো বন্ধুদের সাহচর্যে যদি ভালো লাগে। বিফল মনে আবার বাসায় ফিরে এসেছি। নিউমার্কেটে নিজামের দোকানে অকারণে যেয়ে বসে থেকেছি। নিজাম বুঝতে পারে আমার মন খারাপের কারণ। ও চেষ্টা করতো এটা ওটা বলে মনকে ভিন্ন প্রবাহে ঘুরিয়ে দিতে। দোকানে নতুন কিছু আসলেই গিফট করতো বুঝতাম একটু খুশী করতে চাইতো। নিজামের বন্ধুত্বের ধরনটা ছিলো সত্যিই অসাধারণ, একদিকে ব্যবসার চাপ তারপরও বন্ধুদের সাথে ওর বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য ছিল ওর ঐকান্তিক ভালোবাসা। তবুও কোথাও বসে একদন্ডও শান্তি পাইনি। মনের শূন্যতা দূর করতে যেখানেই যাই কোথাও সেই শূন্যতা তো আমাকে ছেড়ে যায় না। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে গেলাম তোমার সাথে দীর্ঘ সময় কাটানো রেসকোর্সের সেই স্মৃতিময় জায়গাটায়। সবই আছে শুধু তুমিই নাই কোথাও। সব কিছুই যেন ঠিকই চলছে, শুধুমাত্র ছন্দপতন যেন এক জায়গায়। বুলা চুপ করে সব শুনছে। কোন কথা বলছে না, ভাবলাম হয়তো লাইন কেটে গেছে বল্লাম, তুমি কি আছো? ভাংগা গলায় বল্লো, তুমি কেন আমাকে জোর করে পাঠালে, আমি তো আসতেই চাইনি! এখন আমার নিজেকে বড় একজন স্বার্থপর সুবিধাবাদী মনে হচ্ছে। আর বলতে পারলো না….
বুঝলাম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ জোরে নি:শ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনলাম, কান্না গলায় বল্লো, আমার মায়ের মতোই আমারও কিন্তু সামান্যতম উচ্চাভিলাষ কখনই ছিলো না। তোমার এই কষ্টগুলো এখন আমি কেমন করে সহ্য করবো। আমি এ কথাগুলো কার সাথে শেয়ার করবো? এখন আমি কি করবো, কি করবো? বিশ্বাস করো আমাকে, আমি কিন্তু মোটেই স্বার্থপর মানুষ না। আমার চাওয়াগুলো সব সময় ছোট ছোট। কখনই বেশি কিছু চাইনি আমি। এখন বুঝি পৃথিবীতে সবার ইচ্ছাই পুরণ হয় না, কিছু কিছু মানুষের চাওয়া অপূরণীয়ই থেকে যায়।
ফোন ধরে বসে রইলাম হয়তো আরো কিছু কথা শোনার আশায় কিন্তু ফোনের ওপারে তখন শ্রাবণের অঝোর ধারা আমার মনের কষ্টগুলো সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু দৃশ্য দেখা যায় না কিন্তু আড়ালের দৃশ্যপটগুলো পরিস্কারভাবেই অনুধাবন করা যায়। ওর কান্নার শুরুতে দেখেছি নাক মুখ লাল হয়ে যেতো, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও মুখে কোনই শব্দ হতো না। হয়তো বুকের কষ্টগুলোই চোখ দিয়ে গলে গলে বের হতো। কোন কথাও বলতো না শুধু নীচে মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আংগুল দিয়ে মাটি খুঁটতো।
সম্ভবত: মনটা একটু আয়ত্বে এনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বল্লো, আমি তোমাদের ঢাকার বাসায় ফোন করেছিলাম, জিলু ভাই আমাকে সব বলেছে। তুমি ঠিক মতো ক্লাস করো না, বেশি বাইরে বের হতে চাও না। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করো না। কেন এমন করছো বলোতো। তুমি এমন করলে আমি কেমন করে বিদেশ বিভূইয়ে থাকি বলো তো …..!! জিলু ভাইয়ের দেওয়া নাম্বার দিয়েই তোমাকে ফোন দিলাম, এ নাম্বার তো আমার কাছে আগে থেকেই আছে। জিলু ভাই বার বার বলে দিয়েছে তোমাকে বোঝাতে। তুমি নাকি কারো কথাই শুনছো না। অবুঝের মতো জেদ কেন করছো!
এমতাবস্থায় দেশের ভিতর যে কোন প্রান্তে থাকলেই আমি ছুটে চলে আসতাম তোমার কাছে। এখানে যে আমার হাত পা বাঁধা। ইচ্ছে করলেই তো আসা যায় না। এখন আমি কি করি? শোনো, তোমার বাবার শরীরের সর্বশেষ অবস্থা কি? জিলু ভাই আমাকে বল্লো উনার শরীরের অবস্থা নাকি বেশি ভালো না?
বল্লাম, হ্যাঁ বাবাকে মনে হয় ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। সমস্যাগুলো জটিল বলে ধারণা করছে স্থানীয় ডাক্তাররা। মনটা ভালো না, কি যে করি কিছুই ভালো লাগছে না। আমার কথায় মনে হলো ও কিছু একটা চিন্তা করলো, একটু সময় নিয়ে বল্লো, জিলু ভাইয়ের কথা শোনার পর আমার মন বলছিলো তোমার কোন বড় সমস্যা হয়েছে, যখন শুনেছি তুমি ক্লাস বাদ দিয়ে বাড়িতে। তখনই আমার আরো সন্দেহ হয়েছে। এতদিন তো তুমি আমাকে সাহস যুগিয়ে এসেছো আর এখন তুমি নিজেই অশান্তির মধ্যে। আমি তো এখন অনেক দূরে তোমার কোন কাজেই লাগতে পারছি না। সত্যিই তোমার জন্য আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। এখন কি করতে পারি বলো তো, কথা ছাড়া তো কিছুই করতে পারছি না। বিপদে মনকে শক্ত রাখো, বেশি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
বল্লো, তুমি বাবার চিকিৎসাটা ভালো করে করাও। আমাকে নিয়ে এখন একটু কম চিন্তা করো, আমি তো আছিই। বাবা মা’কে মানুষের জীবনে কতটুকু প্রয়োজন আমি আমার মা’কে হারিয়ে সেটা বুঝেছি। আমার অনুরোধটা রাখবে, চিকিৎসার ব্যাপারে যেন কোন রকম গাফলতি না হয় তোমার পক্ষ থেকে। এই মুহূর্তে উনার চিকিৎসা বেশি জরুরি। উনাকে নিয়ে কবে ঢাকা ফিরবে, এই সপ্তাহেই? বল্লাম, সম্ভবত তিন চার দিনের মধ্যেই।
বুলা বল্লো, আমার বাবার শরীরের কথা চিন্তা করে তুমি নিজের ভালো লাগা সব কিছু দূরে ঠেলে আমাকে আমার বাবার পাশে থাকার জন্য পাঠিয়েছো। আমি বুঝি, আমাদের ভালোর জন্য নিজের কষ্টটাকে মেনে নিলে। আর যা হবার তাই হলো, এখন একা একা কষ্ট করছো। ভালো কথা একটা বিষয় বলতে ভুলেই গেছি। গতকাল তোমার পাঠানো সার্টিফিকেট পেয়েছি। কালকে কাগজপত্র জনা দিতে বাবা আমাকে নিয়ে যাবেন। ফিরে এসে সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে চিঠি লিখবো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, ইউএসএ