চির তারুণ্যের আলোয় চির উদ্ভাসিত কবি মেহরাব রহমান টরন্টোর বাঙালি সাংস্কৃতিক জগতে এক চির চেনা মুখ। কথাবার্তা আর বেশ ভূষণে খুব সহজেই সবে মাত্র পরিচিত হওয়া যে কেউ জেনে জান কবি মেহরাব রহমান কাব্যের সরব সরোবরের কত গভীরে প্রতিনিয়ত অবগাহন করে চলেছেন। কাব্য সুধা পান করে কাব্যের সৌন্দর্য্যে তিনি হেঁটে চলেন অবলীলায় প্রান্তর থেকে তেপান্তরে। তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উঠে আসে দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম। কবি মেহরাব রহমান তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প আঁকতে গিয়ে সব সময় তী² দৃষ্টিতে তাকান আমাদের একেবারে আশেপাশে। অনেক ভালোবাসা আর প্রেমময় আবেগে তিনি তুলে আনেন আমাদের বাহ্যিক আর আত্মিক জগতের চিন্ময়ী স্বরূপ। তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি পরম প্রেম আর কৃতজ্ঞতা ঠিকরে বের হয়, যখন তিনি সরল মনে বলে চলেন, … যদি পারো নিয়ে এসো / মুজিবের গোর থেকে এক মুঠো মাটি / যার প্রতিটি ধূলিকণায়, জীবাশ্মে / উচ্চারিত স্বাধীনতার ধারাপাত / জনতার বোল, একটি প্রাণের শব্দ / জয় বাংলা।
আমাদের সাদামাটা জীবন ছুঁয়ে অসীম জগৎ পানে অনন্তকাল ছুটে চলুক কবি মেহরাব রহমানের কাব্যিক কবি সত্ত¡া।
মনিস রফিক
কবি মেহরাব রহমান এর শেকড় প্রথিত নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। বাবা আবু এরফান মাহবুবুর রহমান। বাবার পড়াশোনা কলকাতায়। ভারত বিভাগের পর তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামে। আর এই পাহাড় ঘেরা, সাগর বেষ্টিত চট্টগ্রামের মোহনীয় প্রকৃতির মাঝে কবি মেহরাবের জন্ম।
একটি সুস্থ, সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে উঠেছে কবির দেহমন। তিনি যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘নবারুণ’ সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা ছাড়াও তিনি ছোট গল্প, ছড়া, গান এবং কলাম লিখে থাকেন। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা। নিভৃতচারি কবি মেহরাব রহমান নিরন্তরভাবে কলম যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাঁর স্বপ্ন, তাঁর এই কাব্য যাত্রায় তিনি রেখে যাবেন একটি শ্রেষ্ঠ পংতিমালা বা বাণী যা হতে পারে যুদ্ধ নামক মহাব্যাধির মহৌষধ। কবির প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সতের।
মেহরাব রহমান এর বসবাস কানাডার টরন্টো শহরে। টরন্টোতে তিনি ‘ছেঁড়া কাগজ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। টরন্টোর বাংলা বই মেলায় গত ছয় বছর ধরে তিনি ‘উত্তর আমেরিকা বাংলা কবিতা উৎসব’ এর আয়োজন করে আসছেন।
রক্তরাঙা রক্তকরবি
আমি বিজয় দেখেছি
ফুল্লরাঙিন দিন দেখেছি
আনন্দ ঝড়ে ভেসেছি
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে
সতীর্থ যোদ্ধাদের সাথে
বিজয় ফুল
রক্তরাঙা রক্তকরবিতে
গেঁথেছি বিজয়ের মালা
স্বদেশ সে ছিল তোমার নবজন্ম
তখন তুমি টগবগে রোমাঞ্চ কুমারী
কে জানতো হায়
বিজয় ফুলের মালা আজ
আমার গলায় ফাঁস হবে
রবিবাবুর সেই গীত মনে পড়ে যায়
“এ মনিহার আমায় নাহি সাজে”…
তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছি যুদ্ধ-সাগরে
স্বদেশ…
আমার ফোঁটাফোঁটা রক্ত
মিশেছে তোমার শরীরে
বিজয় আনন্দে
মুখরিত হয়েছে প্রান্তর
যেন কৃষকের ঘরে
প্রতিদিন নবান্ন উৎসব
ওরা আমার বন্ধুপিতাকে
স্বপরিবারে
হত্যা করেছে
কর্কট বেদনায় বিবর্ণ হয়েছি বারেবারে
দংশন-বিষে নীল হয়েছি
একবুক দুঃখ
আর অভিমান নিয়ে
নাড়ীর বন্ধন কেটে
নিজ প্রাণের বীজ
বপন করেছি ভিন গোলার্ধে
এখন আমার বাসভুম
ভিন মাটিতে
বাহ্যতো বেশ আছি
চকচকে
ঝকঝকে
নিরাপদ জীবন
অভ্যাসের বেড়ি আঁটা পায়েপায়ে
একথা ভেবে ভেবে
মধ্যরাতে আমি উন্মাদ হই
আত্মহননে
ক্ষুরধার তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত হই
রক্তস্রোতোধারায় ভেসে যাই
আমি এক অনাবিষ্কৃত ধূমকেতু
একা একা কাঁদি নির্জনে
চোখের জল পান করে করে
অবশেষে ক্লান্ত আমি
আজন্ম মদ্যপ
এক কুঁকড়ে যাওয়ায় তির্যক যন্ত্রণায় …
মাতাল হাওয়ায় ভাসি
স্বদেশ
ওরা তোমাকে নির্মাণ করেছে
স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে
আবার বিনির্মাণে
ভাঙতে ভাঙতে
বিভাজনে বিভক্ত করেছে
লাল-সবুজের সুবর্ণ পতাকা জুড়ে
কতো কলংকের দাগ ছেয়ে আছে
এখানে সেখানে কত টুটা-ফাটা
কত বিশৃঙ্খল শূন্যতা লেখা আছে
কোনো কোনো কোজাগরী পূর্ণিমায়
হঠাৎ শুনতে পাই
নিলয়ের নীল যমুনায়
রাক্ষুসে ঝড়ের তান্ডব লীলা
আমি কান পেতে শুনি
আর এক বিজয়ের বারতা
ঐযে ঐখানে
দূর সীমান্ত সীমানায়
আর এক মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজে
হায়!
আমি কি আর কখনো বিজয় দেখবো না?
নব আনন্দে
নববসন্তে বিজয় ফুল
রক্তরাঙা রক্তকরবিতে
আবার গাঁথব না বিজয়ের মালা?
না না তা কী করে হয়?
আমিতো
পলাতক
আমিতো দেশদ্রোহী
এক অপরাধী আসামি
এখন গলায় পরেছি ফাঁস
বিজয়ফুলের মালা
“এ মনিহার আমায় নাহি সাজে” …
সেই মেয়েটি
মেঘ অফুরান
চোখেতে তুফান
জল চলমান
কল্কল্ধায়
কেঁপে কেঁপে যায়।
অধরা প্রিয়া বাজে রিন্রিন্
সুরেলা রঙিন।
সেই মেয়েটির
দুচোখ গভীর।
মাটির গহনা
সুখের মোহনা।
কপালে তিলক
ভুলালো ত্রিলোক।
হাসিতে তার পাড় ভাঙা ঢেউ
তার কত দাম জানেনাতো কেউ
হিমালয় থেকে নদী ধেয়ে আসে
জানিনাতো সে কারে ভালোবাসে?
জোছনা সে রাতে
ঝর্ণা বহাতে
মিঞা তানসেন রাগিনী শোনায়
তার তনুমনে স্বপ্ন বোনায়।
হীরক খচিত আঁচল তাহার
বাতাসে ওড়ায় টিলা ও পাহাড়
বাংলাদেশের শ্যামলিমা মেয়ে
নদী কল্কল্ ছুটে চলে ধেয়ে।
বুকেতে তাহার উর্বর জমি
আগুন অধরে কোটিবার চুমি;
সেই মেয়ে আর
সব একাকার।
সেই মেয়েটির
দুচোখ গভীর
চোখেতে তাহার বর্ণিল মানচিত্র
এদেশ এখনো স্বর্ণ মাখানো চিত্র।
একাত্তরের রক্ত
এতদিন তোমাদের সূক্ষ্ণ অত্যাচারে
রক্ত কেবলই উত্তপ্ত, এখন রক্ত আমাদের
ফেনিল ফুটন্ত।
দগদগে লালরক্ত তোমাদের
অকস্মাৎ বেয়নটে আরো লাল।
দিয়েছে অনেক রক্ত,
সে রক্ত কোন প্রতিদান চায়নি।
এবারের রক্ত উত্তপ্ত লাভা,
প্রতিশোধ নেবে,
তোমাদের সাজানো ইতিহাস কলঙ্কিত করবে।
আমার প্রিয়তমার
গোলাপি ঠোঁটের হাসি
তোমাদের ভাড়া করা বোমার চেয়ে বিধ্বংসী
উদ্ধত সাপের ফণার চেয়ে বিষধর।
হালাকু খাঁ’র ইতিহাস ম্রিয়মান হচ্ছে
তোমাদের এলএমজির নিপুণ দক্ষতায়।
আশ্চর্য এখনও আফিমখোর
আফিমের নেশায় মত্ত।
ছাড়তে হবে তোমাদের এই দুর্জয় মাটি,
দেহ নিয়ে নয়
কলঙ্কিত আত্মার নগ্ন ইতিহাস নিয়ে।
তাই বলি, বারবার বলি,
আমাদের রক্ত এখন ফেনিল ফুটন্ত
মরণ যজ্ঞের করো আয়োজন,
রচিত হোক তোমাদের কলঙ্কিত ইতিহাস
তোমাদের কবরের পরে।
(মুক্তিযুদ্ধ সময়ে রচিত)
এক পরবাসীর ফর্দ
তবে কি সূর্যের গায়ে ভীষণ জ্বর?
হয়তো ঝরনার জল খেয়েছে প্রচুর
অগত্যা মেঘের কাঁথা মুড়ি দিয়ে
শুয়ে আছে শূন্যের বিছানায়।
কিছু কিছু বিপন্নতায়
গাছের পাতারা নড়ে না
ধীর লয়ে হাওয়া বয়।
পাতা ঝরে, ঝরে যায়।
নবনীতার যাওয়ার দিনের বিষণ্নতা
তাই কি কাঁদছে আকাশ?
তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে বৈতরণী ব্যথায়
ফিসফিস বলে যায়,
এত দূরে কেন নবচাঁদ
কাছে এস, আরো কাছে
জোয়ার জলের মতো
নির্লজ্জ মিশে যাও বালুতটে।
দেখছ না, ঐ যে উড়োজাহাজ,
একটু পরে কলের বাজপাখিটা
আমাকে নিয়ে উড়ে যাবে
দিগন্ত থেকে দিগন্তে
নোঙর করবে আপন স্বদেশে।
আমার বিয়োগের ক’টা দিন, নো জাঙ্কফুড।
মাছ খাবে, সবজি খাবে,
আর বেশি বেশি বিশুদ্ধ জল।
সকালে-সন্ধ্যায়, দিবসে-রাত্রিতে
নিমগ্ন থেকো প্রভুর আরাধনায়।
কথা ক’টা কণ্ঠস্থ করোতোতার মতো;
মনের ভেতরে গেঁথে নাও মনে থাকে যেন।
সম্রাজ্ঞী তোমার আদেশ অমান্য করি
সে সাহস কোথায়?
তবে যে আমার একটা দীর্ঘ ফর্দ মানে…
মানে মানে করছ কেন? তালিকা তো পেয়েছি,
আর কেন?
যা আমার চাই
ক্ষুদ্র কাগজে পুরোটা ধরেনি
বাকিটা রাখতে হবে
মগজে,
তোমার মননে
নিভৃত সংগোপনে।
ঠিক আছে আকাশে ওড়ার আগে
বলে যাও মৃত্তিকার মৃদুমন্দ কথা।
নবীনতা তোমার ইচ্ছে,
যদি পারো নিয়ে এসো
ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার
জোয়ার-ভাটার এক আঁজলা জল
বৈশাখী পূর্ণিমার মাতাল করা এক ফালি চাঁদ।
বুকে ধরে নিয়ে এসো পাখির কিচিরমিচির,
ফাল্গুনের, চৈত্রের, কোকিলের কুহুতান,
আমার প্রিয় বর্ষাজলের উন্মাদ নৃত্য,
কোলাব্যাঙের ঘেঙর ঘেঙ, মেঘমল্লার রাগিণী।
তোমার ইচ্ছে,
যদি পারো নিয়ে এসো
নবান্ন উৎসবে কৃষাণের ঘর থেকে
দুধ চিতই, নলেনগুড়ের ভাঁপা পিঠে
আর নারিকেল পুলি অথবা
খেজুর রসের পোড় খাওয়া গন্ধ মাখানো
কাওনের ফিরনির স্বাদ
তারই সঙ্গে শীতের
একমুঠো মিঠে কড়া রোদ্দুর।
তোমার ইচ্ছে,
যদি পারো নিয়ে এসো
আষাঢ়ের ঝুম্ঝুম বৃষ্টি
কবেকার ফেলে আসা অলস দুপুরের ঘুম
এবং শরতের এক বর্গহাত নীলাভ আকাশ।
২১-এর বইমেলা
পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার পথ ধরে
বাংলা একাডেমির সুরম্য প্রান্তর;
বৈশাখের, নববর্ষের প্রথম প্রহর,
রমনার মুখরিত সবুজ চত্বর;
সে এক অসম্ভব অনুভব
সমুদ্রসম জাতীয় কবিতা উৎসব
তোমার ইচ্ছে,
যদি পারো নিয়ে এসো
ঐসব উদ্যাপন থেকে
এক পেয়ালা টইটম্বুর আমেজ।
তোমার ইচ্ছে,
যদি পারো নিয়ে এসো
মুজিবের গোর থেকে এক মুঠো মাটি
যার প্রতিটি ধূলিকণায়, জীবাশ্মে
উচ্চারিত স্বাধীনতার ধারাপাত
জনতার বোল, একটি প্রাণের শব্দ
জয় বাংলা।
নবচাঁদ এ তো এক যতিচিহ্নহীন দীর্ঘ অভিলাষ।
তার চেয়ে বলো না কেন
রূপকথার দৈত্য হয়ে তোমার জন্যে
আমার করতলে নিয়ে আসি গোটা বাংলাদেশটা।
আমার হাতে এখন একবিন্দুও সময় নেই
একটু পরেই ডানা মেলে উড়ে যাব শূন্যে মহাশূন্যে।
ভালো থেকো। তুমি ভালো থেকো।
এই পরবাসে রুদ্ধদ্বার, আমাকে শূণ্যের কোঠায়
রেখে ও চলে গেল কোন সুদূরে।
আমার ভুবনজুড়ে গভীর অন্ধকার
এখন কেবল অথৈ নীরবতায়
ডুবসাঁতার কাটা।