ফরিদ আহমেদ : আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েকদিন পর পরই ভাইরাল হন। তিনি ভাইরাল হন তাঁর শিশুসুলভ কথাবার্তার জন্য। এই মাত্র কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে।’ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ যে অন্য দেশের তুলনায় ভালো আছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে ওই ধরনের একটা তুলনা করেন।

তাঁর সেই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচণ্ড রকমের সমালোচনার শিকার হয়। সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। এর মাত্র কিছুদিন আগেই সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। জ্বালানি তেলের সেই মূল্যবৃদ্ধি প্রভাব ফেলেছে অন্য সব পণ্যের দামের উপরে। পণ্যের দাম লাফ দিয়ে বাড়লেও, মানুষের আয় কিন্তু বাড়েনি। বাংলাদেশের মানুষ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, সেই সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই অ-সংবেদনশীল একটা বক্তব্য হিসাবে তাদের সামনে এসেছে। তারা ভেবে নিয়েছে দেশের মন্ত্রীরা নিজেরা বেহেশতের মতো আরামের জীবন যাপন করছেন বলে সাধারণ মানুষদের দুর্দশা, জীবন সংগ্রাম তাঁদের চোখে পড়ছে না। তাঁরা একটা বৃত্তবন্দি জায়গায় বসে আয়েসি জীবন যাপন করছে। সাধারণ মানুষের কষ্টের কান্না সেখানে পৌঁছাচ্ছে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেহেশত নিয়ে তুলনার সেই বক্তব্য ফিকে হতে না হতেই, তিনি আবারও আলোচনায় এসেছেন। আরও ব্যাপকভাবে, আরো তীব্রতার সাথে। চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি চরম বেফাঁস কিছু মন্তব্য করে বসেছেন। অযাচিতভাবে সেই অনুষ্ঠানের তিনি বাংলাদেশের সরকার এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, “‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সা¤প্রদায়িকতামুক্ত, অসা¤প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।”

একটা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ধরনের বালকসুলভ মন্তব্য করতে পারেন কিনা আমি জানি না। পত্রিকার এই লিখিত বক্তব্যকে আমি হয়তো বিশ্বাস করতাম না, যদি না তাঁর বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ দেখতাম। দেশের প্রায় সব জাতীয় পত্র-পত্রিকাতে তাঁর বক্তব্য এসেছে। কোনো পত্রিকাই বানিয়ে কিছু লেখেনি তাঁর বিরুদ্ধে। সামান্যতম অদল-বদল করেও তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেনি তারা। তিনি যা বলেছেন, তারা হুবহু সেই কথাগুলোকে তুলে ধরেছে পত্রিকার পাতায়।

ডিপ্লোম্যাটিক আনসার বলে একটা শব্দ-গুচ্ছ আছে। এর আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে ক‚টনৈতিক উত্তর। সহজ বাংলায় একে বলা যায় কুশলী উত্তর। সাধারণত স্পর্শকাতর বিষয়ে মানুষ কুশলী উত্তর দিয়ে থাকে। এতে করে কোনো পক্ষেরই আহত হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

ডিপ্লোম্যাটরা সাধারণত কথাবার্তায় কুশলী হয়ে থাকেন। একটা দেশের ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা সামরিক বাহিনী নয়। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব থাকে ক‚টনৈতিকদের হাতে। তাঁরা যেহেতু নিঃশব্দে কাজ করেন, সেই কারণে তাঁদের ভূমিকাটা অনেক সময়ই আমাদের চোখে পড়ে না। ফলে, আমরা ধরে নেই যে সামরিক বাহিনীই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। আগেকার দিনে দেশগুলোকে টিকে থাকতে গেলে সামরিক শক্তি বাড়াতে হতো। অন্য দেশকে দখল করাটাই ছিলো সাধারণ সংস্কৃতি। যে দেশে এই কাজটা করতে পারতো না, তাকে অন্যদের দখলে চলে যেতে হতো। অন্যদেশ দখল করা অথবা অন্য দেশ দ্বারা দখলিকৃত হওয়াটাই ছিলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। আধুনিক যুগে এসে সে রকম কিছু ঘটে না। দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে এখন একটা দেশ ইচ্ছা করলেই আরেকটা দেশকে দখল করে নিতে পারে না। দেশ দখল না হলেও, নিরন্তর একটা প্রতিযোগিতা চলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে। সেখানে টিকে থাকতে গেলে ক‚টনৈতিক কৌশলটা দারুণভাবে প্রয়োজন হয়। এই কৌশলটা নিয়মিত প্রয়োগ করতে হয় পররাষ্ট্র দপ্তরে যাঁরা কাজ করেন তাঁদেরকে। এঁদেরকে আলাদাভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় এই কৌশল রপ্ত করার জন্য।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের ক‚টনৈতিক দপ্তরের প্রধান। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছ থেকে আমরা বুদ্ধিদীপ্ত এবং কুশলী কথাবার্তা পাবো, সেটাই আশা করি আমরা। কিন্তু, বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে তিনি বালসুলভ সব কথাবার্তা বলেন। অনেকদিন আগে তিনি ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক বিরাজ করছে সেটা বোঝাতে গিয়ে ওই ধরনের একটা অবমাননাকর তুলনা তিনি করেছিলেন। অথচ, চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে লিখে গিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা হচ্ছে একটা দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাঁর ভাষায়, “Your neighbour is your natural enemy and the neighbourÕs neighbor is your friend.”

এখনকার যুগ ব্যবস্থাতে আমরা চাণক্যের মতো চরম ধরনের ভাবনা ভাবি না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের স্বাভাবিক শত্রæ হিসাবে বিবেচনা করি না। কিন্তু, বিশ্ব ব্যবস্থাতে দেখা গেছে, সব দেশেরই অভিন্ন সীমান্ত থাকার কারণে প্রতিবেশীদের সাথে কম-বেশি কিছু সমস্যা লেগেই থাকে। ফলে, এদের সঙ্গে কর্মতৎপরত্তা চালাতে গেলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর জায়গা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বতোভাবে সহযোগিতা দিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। আমাদের প্রবাসী সরকারকে আশ্রয় দিয়েছে, এক কোটি শরণার্থীর চাপ সহ্য করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়েছে, তাদের ট্রেনিং এর জন্য জায়গা দিয়েছে, সারা বিশ্ব জুড়ে ক‚টনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশে হয়ে, এবং সবশেষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভারতীয় বাহিনী অংশ নিয়েছে মিত্র বাহিনী হিসাবে। ভারতের এই অসাধারণ ভূমিকার জন্য তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞত রয়েছে বিপুল পরিমাণে।
সমস্যা হচ্ছে, একটা স্বাধীন দেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে আজীবন চলতে পারে না। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ এবং ভারত দু’টো আলাদা দেশ। ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটা জরুরী, কিন্তু, তার চেয়েও জরুরী হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থ দেখা। দুই দেশের সম্পর্ক যেনো মর্যাদাপূর্ণ হয় সে দিকটাতে খেয়াল রাখা। প্রতিবেশী দেশের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং নতজানু সম্পর্ক কোনো দেশের মানুষই মেনে নিতে পারে না। এটা তাদের আত্মমর্যাদাতে আঘাত হানে।

এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাকে বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয় যে বাংলাদেশে কোন সরকার আসবে, সেটা ঠিক করার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের আর নেই। ভারত ঠিক করে দেয় কে আমাদের দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে। যে কারণে তিনি দিল্লিতে গিয়ে অনুরোধ করে এসেছেন শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার সব করতে। দেশের মানুষকে অপমান করার জন্য এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ এখন জেনে গিয়েছে যে তাদের সরকার আসলে ভারতের বানানো সরকার। কাজেই, স্বাভাবিকভাবে বর্তমান সরকার ভারতের একটা তাবেদার সরকার হবে।

জন্মাষ্টমীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন তাই যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অবিবেচনাপ্রসূত। তাঁর অগভীর চিন্তাভাবনার প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন অবান্তর সব কথাবার্তা বলে। অনেকেই তাঁকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন এটা বলে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন সরল মানুষ। তিনি তাঁর সারল্যের কারণে এই কথাগুলো জনসম্মুখে বলে দিয়েছেন। এদের এই বক্তব্যকে মেনে নিলেও, গুরুতর এক প্রশ্ন থেকেই যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি সত্যি সত্যিই ভারতকে এমন অনুরোধ করে এসেছেন? সেটা যদি হয়, তবে আমাদের জন্য সতর্ক হবার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটা স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীন কর্মকাণ্ডে বিদেশি হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা দেশবিরোধী কাজ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডকে আইনের আওতায় আনাটা আবশ্যক।