ভজন সরকার : জানি না, পৃথিবীতে আর কোন কবি-লেখকের রচনার প্রভাব একটি জাতিগোষ্ঠীর জীবনে এমনভাবে পড়েছে কিনা- যা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালির জীবনে। বাঙালির জীবনবোধের আত্মপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস- বাইশে শ্রাবণ।
২২শে শ্রাবণ কেমন ছিল সেদিন, ১৯৪১ সালের সেদিনটি? কেমন ছিল ২২ সন্নিকটের আগের দিনগুলো? এ নিয়ে অনেক গ্রন্থ থেকে অজানা তথ্য জানা যায়। জানা যায় সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের শয্যাপাশে ছিলেন এমন অনেকের কাছ থেকেও। এ রকম কিছু তথ্য সমৃদ্ধ রচনা, যেমন, বাইশে শ্রাবণ- অনুত্তম ভট্রাচার্য; নির্বাণ- প্রতিমা দেবী; গুরুদেব- রানী চন্দ; বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ; সব পেয়েছির দেশে- বুদ্ধদেব বসু; রবীন্দ্রসংগীত- শান্তিদেব ঘোষ ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে লেখার মধ্যে অন্যতম বহুপঠিত সে কবিতাটি, যা ২৭ জুলাই লিখেছিলেন-
“প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে-কে তুমি।
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় – কে তুমি।
পেল না উত্তর”।
৩০শে জুলাই অস্ত্রোপচার হবে কবির অনিচ্ছাসত্বেও কলকাতার ডাক্তারদের অনুরোধে। দুপুরে অস্ত্রোপাচার হবে সকাল সাড়ে ন’টায় তিনি ঘুমে আচ্ছন্নতার মধ্যেই রানী চন্দকে বললেন লিখে নিতে-
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে
সরল জীবনে।”
অপারেশনের সমস্ত কিছুই প্রস্তুত দুপুর বেলা। রবীন্দ্রনাথ ডাকলেন রানী চন্দকে। বললেন, “লিখে নে আরও তিনটে লাইন, সকালবেলার কবিতাটির সাথে জুড়ে দিস”। রবীন্দ্রনাথ বলে গেলেন, লিখে নিলেন সেবিকা রানী চন্দ –
“অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার”।
এ তিনটি লাইনই রবিঠাকুরের সর্বশেষ রচনা।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যু নতুন কিছু নয়। আশি বছরের জীবনে অনেক মৃত্যুশোক বইতে হয়েছে কবিকে।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কবিপত্নী মৃনালিনী দেবীর মৃত্যু। দু’বছর পরেই মেঝো মেয়ে রেণুকার মৃত্যু ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১১ বৎসর বয়েসে পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। অর্থাৎ মৃত্যু ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকে যেনো আচ্ছন্ন করেছিলো ক্রমেক্রমে। ১৮৭৫ সালে মাতা সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে তেরো বছর। ১৮৮৩ সালে বড় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলেন। এই বড় বৌদি কাদম্বরী দেবী ছিল রবীন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু। কবি বড় বৌঠানের মৃত্যু শোকও সারা জীবন বয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে ছিল না কোনো সন্তান। ইতিমধ্যেই তাঁর আরেক মেয়ে মাধুরীলতা বা বেলা মৃত্যু বরণ করলেন ১৯১৮ সালে। এ মেয়েটির সাথে তার জামাতার বনিবনা হচ্ছিল না। রবীন্দ্রনাথ মেয়েকে নিজের কাছে আনতে গিয়েই মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ পেলেন। কনিষ্ঠা কন্যা মীরা বা অতশীর একটি মাত্র ছেলে নিতু। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই নাতিকে বড্ড ভালোবাসতেন। নিতুকেই মনে করতেন তাঁর বংশধর। ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথের এই প্রিয় দৌহিত্র নিতু মাত্র ২০ বছর বয়সে জার্মানিতে মারা যায়। রবীন্দ্রনাথ খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
“কিছুকাল থেকে আমি আছি মৃত্যু ছায়ায় ডুবে। নিতুর বই, তার কাপড়, তার জিনিসপত্র এসে পৌঁছেছে। যে নিজে চলে যায়, সে যা কিছু ফেলে যায় তাতে তার বিচ্ছেদকে আরও দুঃসহ করে তোলে-সংসারের সমস্ত আয়োজনকে কী ফাঁকি বলেই মনে হয়!”
তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তা নিয়ে অসংখ্য লেখা লিখেছেন সংগীত ও সাহিত্য-বোদ্ধারা। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন মানসিক শক্তি দিয়ে মৃত্যুচিন্তা থেকে নির্ভয় ও নির্ভার থাকতে চেয়েছেন। এমনকি প্রিয়জন হারানোর শোক তাঁকে বিচলিত করলেও সৃষ্টির পথে তিনি সারাজীবনই থেকেছেন অবিচল।
কিন্তু কবিতা, উপন্যাস, গল্প বাদ দিলেও অনেক গানে কবি অবচেতনভাবেই মৃত্যুর ভাবনাকে স্থান দিয়েছেন। কবির ৭৫ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত সময়ে লেখা এমন অনেক গান আছে যেখানে মৃত্যু ছায়া ফেলেছে সরাসরি।
একটা বিষয় দৃশ্যমান হয় যে, যখনই রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যা, রাত্রি, অন্ধকার, গোধুলি, সূর্যাস্ত কিংবা এ জাতীয় শব্দের সমার্থক শব্দ ব্যবহার করেছেন সেখানেই মৃত্যুর বিষন্নতা এসেছে- কী কথায়- কী রাগ-রাগিনী ব্যবহারে। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। ১৯৩৯ সালে অর্থাৎ মৃত্যুর বছর দুই আগে কবি বর্ষার একটি গান লিখেছিলেন, গানটি তেমন বহুশ্রæত নয় কিন্তু গানের প্রতিটি ভাগে মৃত্যু ছায়া ফেলেছে সরাসরি।
“শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে, শেষ কথা যাও ব’লে\”
স্থায়ী ও অন্তরাতে তো বটেই সঞ্চারী ও আভোগেও কী বিমর্ষ বিষন্নতার ছায়া!
প্রকৃতির ভিতর দিয়েই তিনি হয়ত নিজের জীবনাবসানের মুহুর্তকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বুঝেছিলেন, আর বাকী নেই এখনি শেষ কথাটি বলতে হবে। কারণ, “নামিছে অন্ধকার”, পশ্চিমগগনে শেষ রেখাটি শেষবারের মতো দৃশ্যমান হয়েছে; শেষবারের মতো জীবনের দ্বার খুলেছে এখনি আবার বন্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য।
কী আশ্চর্য! এ গানটির পরেই রবীন্দ্রনাথ গীতবিতানে আরেকটি গান স্থান দিয়েছেন, “এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে/ সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে”।
কী অদ্ভুতভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেবার মানসিক শক্তি! ছোট গল্পের মতো জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও শুধু মৃত্যুকে নয়-জীবনের ভালোবাসাগুলোকেও ছোঁয়ার অতৃপ্তি। গল্পের মতো জীবনের আলোটুকু শেষ হয়েও কোথায় যেন একটু আটকে থাকে; সব নিভে গিয়েও ছায়াটুকু যেন থেকে যায় আরও কিছু সময়! জীবন তো বটেই মৃত্যুর ধর্মও কি এমনি; “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ”?
রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। তাঁর রেখে যাওয়া কর্মের রৌদ্রালোকে আমরা আজও আলোকিত। আজও ২২শে শ্রাবণের সিক্ত সমীরে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া খেলা করে। আমরা স্মরণ করি এ মহান কবিকে। এ স্মরণ চলবে নিরন্তর। যতদিন থাকবে বাংলা সাহিত্য, যতদিন থাকবে বাংলা ভাষা,যতদিন থাকবে বাঙালির আবেগ-প্রেম- বিরহ –দুঃখ কিংবা দুঃখ জয়ের প্রতিজ্ঞা।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের তাই নিত্যদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি, ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ ছাড়িয়ে যা আজও বহমান রবি-অনন্ত স্রোতে।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)