নাদিরা তাবাস্সুম : মনোবিদ ডক্টর রেমনের চেম্বারে অনেক মানুষের ভীড়। এরা সবাই অনেক সমস্যা নিয়ে এসেছে। সকলের কম বা বেশি সমস্যা আছে। তবে কারোরই শরীরের সমস্যা নয় বরং মনের সমস্যা । সাফিদ তার মাকে নিয়ে বসে আছে চেয়ারে কিন্তু মা ছটফট করছে। কিছুতেই বসে থাকতে রাজী নয়। বলে যে, সে সুস্থ তাকে কেন এখানে আনা হয়েছে। ছেলের অভিযোগ তার মা সব সময় চুপচাপ থাকে। কারো সাথে কোন কথা বলে না; এমন কি নিজের প্রয়োজনের কোন কথাও না। সাফিদের বাবা গত চার বছর আগে মৃত্যু বরণ করেছে। মা-বাবার বিবাহিত জীবন অনেক সুখের ছিল। তারা সংসারের প্রতিটি কাজ এবং যেকোন সমস্যা দুজনে মিলমিশে ভাগাভাগি করে সমাধান করতেন। দুজনে একে অপরের খুব নির্ভরশীল ছিলেন। তাই বাবার হঠাৎ মৃত্যু তার মা হয়তো মেনে নিতে পারছেন না। সাফিদের মা অত্যন্ত ধার্মিক। ভালো করেই জানেন যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছেতেই সব কিছু ঘটে কিন্তু তারপরও তিনি অত্যন্ত ভেংগে পড়েছেন। সাফিদের পাশে আর একজন পিতা মাতা তাদের এক সুঠামদেহী যুবক ছেলেকে হাত ধরে বসে আছেন। ছেলেকে আদর করে বুঝিয়ে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আহারে কি সুন্দর চেহারার বাইশ/তেইশ বছর বয়সের একটি ছেলে অথচ মানসিক কোন সমস্যা হয়তো হয়েছে। বাইরে থেকে চেহারা দেখলে একদম বোঝার কোন উপায় নেই তবে অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বোঝা যায় যে ছেলেটির মনে সমস্যা আছে। সকল মানুষের ব্রেইন-এর ভিতর একই রকম গঠন প্রক্রিয়ায় কাজ হয় । কিন্তু কারও স্বাভাবিক আচার ব্যবহার আর কারও অস্বাভাবিক। ছেলেটির মা জানালেন যে, পাঁচ/ছয় বছর বয়স পর্যন্ত কখনও কেউ বুঝতে পারেনি যে সে অসুস্থ। বড় হওয়ার সাথে সাথে ব্যবহার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।

এমন সময় একজন মা তার মধ্যবয়সী মেয়্রে হাত শক্ত করে চেপে ধরে ভিতরে প্রবেশ করে কিন্তু মেয়ে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে চায় না। প্রচন্ড ভয়ে যেন ছুটে পালাতে চাইছে। কারণ জানতে চাইলে মা জানান যে, তার স্বামী দীর্ঘ দিন ঘরে বন্দি রেখে সবাইকে বলে বেড়ায় যে, পাগল হয়ে গেছে। ওর দোষ যে, ও স্বামীর খারাপ কাজে বাধা দেয় এবং কান্নাকাটি করে।

তাই উল্টো ওকে পাগল বানিয়ে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকায় ধীরে ধীরে ও মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছে। সকল রোগীদের দেখে বোঝা যায় যে, কেউ জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক আবার কেউ পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু সাফিদ চিন্তা করে যে, আমাদের চারপাশে থাকা মানুষেরা আমরা সবাই স্বাভাবিক তাই আমরা পরিবারে সমাজে একত্রে বসবাস করি।

কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু আচরণ আমদের প্রকাশিত হয়ে যায় যা দেখে আমরা মন্তব্য করে ফেলি যে ‘এটা সত্যি অপ্রত্যাশিত‘ অথবা ‘এটা অস্বাভাবিক’ ইত্যাদি। যেমন- কেউ কোন মানুষ বা ছেলেকে ন্ম্র ভদ্র বলে জানে অথচ হঠাৎ সে যদি কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে ফেলে। প্রতিবেশি জমির সাহেবকে সবাই একজন ভদ্র এবং ভালো মানুষ হিসাবে চেনে। কিন্তু প্রতি রাত্রে যখন তার বাসায় তিনি তার স্ত্রীর সাথে জোড়ে চীৎকার করে, মন্দ গালিগালাজ করে, এবং মাঝে মাঝে মারধোর করে তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে লোকটি বেজায় খারাপ। অথচ এটি তার প্রতিদিনের অভ্যাস স্ত্রীর দোষ খুঁজে বের করা এবং গালমন্দ করা। স্ত্রী কোন প্রতিবাদ জানালে শারীরিক নির্যাতন করা। কার্যক্ষেত্রে সহকর্মী মুকিতকে দেখে সাফিদ বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে একজনের এতো দক্ষতা থাকতে পারে। কথা ও কাজে দক্ষতা দেখিয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের মন যুগিয়ে উত্তরোত্তর প্রমোশন ও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যায়। কিন্তু যখন অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে শোনা যায় যে, তিনি ফাইলের কাজের ফাঁকে বসের কাছে সহকর্মীদের নামে মিথ্যা বানিয়ে অভিযোগ করেন। ফলে অনেক সৎ কর্মকর্তাদের দক্ষতা থাকা সত্তে¡ও প্রমোশন বঞ্চিত থেকে যায়। এগুলো অবশ্যই অস্বাভাবিক আচরণ অথচ স্বাভাবিকভাবেই সমাজে বজায় থাকছে।

মানুষের শরীর এবং মনের গঠন প্রণালী অতি বিস্ময়কর। প্রতিনিয়ত সমাজ সংসারে কর্মক্ষেত্রে মানুষের মন এবং চিন্তা চেতনার বহিঃ প্রকাশ ঘটে চলেছে। শরীর এবং মন দুটো নিয়েই মানুষ। যদিও শরীরটাকে দেখা যায়, ধরা যায়, ছোঁয়া যায় কিন্তু মনকে দেখা যায় না, ধরা যায় না বা ছোঁয়াও যায় না তবুও আমরা স্বীকার করি মনের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সেটা কোথায় এবং কিভাবে বুঝি যে মানুষের মন আছে? সাধারন ভাবে একটা মানুষের হাঁটা চলা ফেরা, কথা-বার্তা আচার-ব্যবহার ইত্যাদি দেখে শুনে বোঝা যায়, মানুষটা ভালো অথবা মন্দ প্রকৃতির। প্রত্যেক মানুষের শরীর-এর আকৃতি-প্রকৃতিতে যেমন কোন মিল নেই তেমনই হাঁটা-চলা, কথা-বার্তা ও ব্যবহার-আচরণ- এ কারো সাথে কারো হুবহু কোন মিল নেই অথচ শরীরের গঠন প্রক্রিয়া সকলের একই। কেউ অতি বোকা, কেউ অতি চালাক, কেউ অতি বুদ্ধিমান কেউ বা জ্ঞানী সাধু। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ব্রেইন বা মস্তিষ্কই তাকে চালনা করে। শরীরটা একটা জড়বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। আর মন বা চিন্তা-চেতনা থাকে মস্তিস্কের ভিতরে। কিন্তু মস্তিষ্ক বা তার ভিতরে অবস্থিত সবই জড়বস্তু; তাহলে কিভাবে এই জড়বস্তু চিন্তা চেতনা, আবেগ অনুভূতি, প্রেম ভালোবাসা, নীতি বোধ সৃষ্টি করে? আবার সকল মানুষের চিন্তা চেতনা, আবেগ অনুভূতি, এক রকম নয়। নিউরোসাইন্স অনুযায়ী মানুষের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক-এর ভিতরটা অসংখ্য নিউরন বা স্নায়ুর সমষ্টি। যখন রক্ত এর মধ্যে দিয়ে সঞ্চালিত হয়, তখন জৈব – বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এই বিদ্যুতের ধনাত্মক (পজিটিভ) প্রবাহ প্রথম ভেন্ট্রিকেল দ্বারা এবং ঋণাত্মক প্রবাহ (নেগেটিভ) দ্বিতীয় ভেন্ট্রিকেল দ্বারা মস্তিষ্কে পোঁছায়। এই বিপরীত ধর্মী প্রবাহ মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলিকে (শরীরের ব্যাটারি শক্তি) উত্তেজিত করে এবং মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলিকে সক্রিয় রাখে। এই কার্যকলাপের সাহায্যে মানুষ-এর সকল প্রকার হাঁটা চলা দৌড়ানো, শরীরের নানা অঙ্গ ভঙ্গি, ভারসাম্য, ক্ষুধা তৃষ্ণা, চিন্তা চেতনা, জ্ঞান অভিজ্ঞতা সমন্বয়, ভালো মন্দ ব্যবহার আচরণ ও অন্যান্য সকল কাজকর্ম পরিচালিত হয়ে থাকে। সুতরাং মনের বা মস্তিষ্কের ভিতরে যার যা কিছু ঘটে সে অনুযায়ী চিন্তা চেতনা, ব্যবহার আচরণ এবং কথা বার্তার অনুরণন বা প্রতিফলন ঘটে থাকে। প্রত্যেক জড়বস্তু যখন কোন কাজ করে তখন আমরা জানি যে তার পেছনে কোন চালিকা শক্তি কাজ করে। মস্তিষ্কের ভিতরে সৃষ্ট মন বা চিন্তা চেতনা মানুষকে চালনা করে অথবা চালিত হয় । চেতনা বা ‘কনশাস্নেস’ প্রধান চালিকাশক্তি- যা স্বাভাবিক হতে পারে অথবা অস্বাভাবিক হতে পারে।