হাসান গোর্কি : সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমাদের সেদিনের আলোচনা শেষ হয়েছিল আপনার এই ধারণা ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে যে প্রকৃতি অন্ধ ও উদ্দেশ্যশূন্য এবং প্রকৃতির অংশ হিসেবে প্রাণী ও উদ্ভিদের উদ্ভব ঘটা, একটা জীবন চক্র পার করা এবং বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াও নিরর্থক। আমি ভেবে দেখেছি, সেরকম হতে বাধা আছে। বাধাগুলো খোলা মনে বিবেচনায় নিলে প্রকৃতি ‘অন্ধ’, ‘উদ্দেশ্যশূন্য’ ও ‘নিরর্থক’ হবার সম্ভাবনা কমে যায়। আপনি যদি আরও মুক্তমনে এগিয়ে যেতে চান তাহলে দেখবেন সম্ভাবনাটা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায়। আপনি যা করেন, দেখেন বা অনুভব করেন তার সবগুলোর পেছনে কোনো একটা অর্থ ও একটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক ফলাফল দেখতে পাবেন যদি আপনি যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে থাকেন। দৈনন্দিন কাজের তালিকা যাচাই করে দেখুন; দেখবেন আপনার প্রত্যেকটা কাজের পেছনে একটা ফল আছে।

সঞ্জিব পুরোহিত: আমাদের করা বা দেখা সব কাজের একটা অর্থ বা উদ্দেশ্য আমরা বুঝতে চাই। সেসবের কিছু বুঝতে পারি; কিছু পারি না। মরে যাবার পর নিজেকে প্রায় সমরূপ বিন্যাসে টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা থেকে আমরা সন্তান লালন-পালন করি। রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গৃহ নির্মাণ করি। ক্ষুধা নিবারণের জন্য শস্য ফলাই। এসবের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আমরা গান শুনি, ছবি আঁকি, সমুদ্র দেখি, পাহাড়ে উঠি, ফুলের বাগান করি, রূপালি চাঁদের পেলব জ্যোত্স্নায় নিমগ্ন প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যে অপার্থিব প্রশান্তিতে সময় কাটাই। এসবেরও অর্থ আছে, উদ্দেশ্য আছে; যদিও তা প্রথমগুলোর মতো অভিলাষ-পূর্ণ নয়। অর্থটা কাজগুলোর নিজের জন্য এবং নিজের মধ্যে পূর্ণ। যেমন চাঁদের আলোর মুগ্ধতা থেকে আমরা দ্বিতীয় প্রকারের কোনো ফল পাই না, যেটা পাই সন্তান প্রতিপালন থেকে। কিন্তু দিন শেষে এই সবগুলো কাজের যোগফল একটা শূন্য ফলাফলে গিয়ে শেষ হয়। মাতৃগর্ভে যে শিশুটি মৃত্যুবরণ করেছে এবং যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে ৭০ বছরের কর্মযজ্ঞময় জীবন পার করেছে – মহাকালের বিচারে এই দুই জনের কৃতকর্মের যোগফল সমান।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার ধারণায় মাতৃগর্ভে মৃত্যুবরণ করা শিশুদের সাথে স্পার্টাকাস- রবীন্দ্রনাথ- নেপোলিয়ান-ইন্দিরা গান্ধীর মতো মানুষদের অর্থবহতা সমান। দেখুন ‘০’ ও ‘১’ এর মধ্যে ব্যবধান আছে। অসীমের সাথে ‘০’, ১, ১০০০০, ১০০০০০০- সবার অনুপাত একটা গাণিতিক ধ্রুবক। আপনি ‘মহাকাল’ টেনে আলোচনার মূল বিষয়কে বিভ্রান্ত করবেন না। আমরা একটা কাল-বদ্ধ সসীম অবস্থার ধারণা নিয়ে কথা বলছি। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি লিখেছেন; মাতৃগর্ভে মরে যাওয়া ঐ শিশুটি সেটা করেনি। এই দুই কর্মের পার্থক্য আছে, তা সেটা যতো ক্ষুদ্র-ই হোক। আর যদি আপনি মহাকালের বিচারে অর্থবহতা খুঁজতে চান তাহলে এভাবে দেখুন- অসীম সংখ্যক অতি–পারমানবিক কণা অথবা তরঙ্গ দিয়ে মহাবিশ্ব তৈরি। এই অসীম সংখ্যক ক্ষুদ্র অস্তিত্বগুলোর অভ্যাগমন বা বিদ্যমানতা অসীম বৃহত একটা কিছু তৈরি করেছে। অসীম সময়ের কাছে একজন ইন্দিরা গান্ধী অর্থবহ কিছু নন; কিন্তু অসীম সংখ্যক ইন্দিরা গান্ধী বড় অর্থ বহন করেন।

সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি জানেন, মহাজগতের মোট শক্তির পরিমাণ সমান— নেগেটিভ ফোর্স ও পজিটিভ ফোর্সের যোগফল শূন্য। আলো-অন্ধকার, তাপ-শীতলতা, আকর্ষণ- বিকর্ষণ, শৃঙ্খলা- বিশৃঙ্খলা, গতি-স্থিতি- সবকিছু যোগ করলে একটা বিশাল শূন্য ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, মহাজগতের সকল শক্তির উত্স হলো ‘ডার্ক মেটার’। যা পদার্থের একটা অনুকল্পিত রূপ (hypothesized form)। মহাকর্ষীয় প্রভাব থেকে এদের অস্তিত্ত¡ সনাক্ত করা গেলেও তার প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হয়নি। আপনি যতক্ষণ শক্তির উত্স সম্পর্কে না জানছেন ততোক্ষণ তা থেকে উত্পন্ন ফলাফল বিষয়ে যে ধারণা-ই করবেন সেটা ভুল হবার সম্ভাবনা থাকবে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: কোনো ঘটনার ফলাফল পর্যবেক্ষণের জন্য কারণ জানা জরুরি নয়। ধরুন, আমি একটা চওড়া রাস্তায় এক টন ওজনের একটা লোহার বল ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটার গতিতে ছুঁড়ে দিলাম। ঢালু রাস্তায় সেটা প্রায় সমান গতিতে ছুটে গিয়ে ২ কিলোমিটার দূরে আপনার সামনে একটা গাড়িতে আঘাত করে সেটাকে ভেঙে ফেললো। আপনি জানেন না বলটা কে ছুঁড়েছে। কিন্তু আপনি যে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করবেন সেটা নির্ভুল না হবার সুযোগ নেই।

সঞ্জিব পুরোহিত: ‘ফলাফল’ শব্দটাকে আপনি ভুলভাবে বুঝেছেন। ‘ফল’ এবং ‘অফল’ মিলেই ফলাফল। আপনি পুরো ঘটনার অংশবিশেষ আপনার পছন্দ মতো বেছে নিলেন। আমি যে কষ্ট করে বলটা ছুঁড়েছি সেটা আপনি জানেন না। কিন্তু অনুমান করে আপনার বুঝতে পারার কথা যে, কেউ অথবা কিছু এই বলটা ছুঁড়েছে। এখন এই ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য প্রযুক্ত বলের মান থেকে গাড়িটি ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে কার্যকর বলের মান বিয়োগ করলে শূন্য পাবেন (দুই কিলোমিটার অতিক্রম করার জন্য ব্যবহৃত বলকে উপেক্ষা করলে)। যাহোক, আপনার সসীম ক্ষেত্রের আলোচনায় ফিরে আসি। ধরুন, আপনি জীবনের অর্জিত সব টাকা ব্যয় করে প্রাসাদোপম একটা বাড়ি বানালেন এবং সেখানে শান্তিতে বসবাস করলেন। বৃদ্ধ হয়ে মরে যাবার সময় আপনার মনে এই চমত্কার আবাস ত্যাগ করার জন্য যে কষ্ট তৈরি হবে তা ঐ শান্তির বিপরীত অনুপাতে সমান। ইন্দিরা গান্ধীর বর্ণাঢ্য অবদান এবং তাঁর মৃত্যুজনিত ক্ষতির মান নির্ণয় করা গেলে দুটির যোগফল সমান হবে। দিনশেষে আমাদের কাজগুলো শূন্য ফলাফল বয়ে আনে। সে অর্থে আমি বলেছি সবকিছু নিরর্থক।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: কোনোকিছুর যোগফল শূন্য হবার অর্থ তা নিরর্থক নয়। কর্মযজ্ঞগুলোর ফলাফল সংশ্লিষ্টরা ভোগ করে। বীজ থেকে অংকুরিত হবার পর একটা গুল্ম পত্র-পল্লব বিস্তার করে, ফুল-ফল উত্পাদন করে এবং সবশেষে মরে যায়। আপনি শুধু অঙ্কুরিত হওয়া এবং মরে যাবার যোগফল মেলাতে চাচ্ছেন। সেটা যে শূন্য তা মানছি। কিন্তু জীবদ্দশায় গুল্মটি যা করেছে সেটাকে নিরর্থক মনে করছি না। আর মরে যাওয়াকে আপনি বিনাশ ভাবছেন কেনো! জীবন তো একটা চলমান প্রক্রিয়া। গাছ মরে যাবার আগে বীজ রেখে যায়। প্রাণীরা মরে যাবার আগে সন্তান রেখে যায়। গ্রহরা ধ্বংস হয়ে গেলে নতুন গ্রহে আবাস গড়ে ওঠে। নক্ষত্র নিভে গেলে আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ থেকে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। কানাডা প্রবাসী কবি মাসুদ খানের অমৃতের সন্তান কবিতার অংশবিশেষ শুনুন:

“অমরতা চাও? চাও অন্তহীন পরমায়ু?
বিলাপ থামাও, শোনো, আমরা যে যখনই আসি
অমরতা নিয়েই আসি হে অমৃতের সন্তান– অলুক অব্যয় অনশ্বর চির-আয়ুষ্মান।
জরা ব্যাধি মন্বন্তর মহামারি অনাহার অত্যাচার গুম খুন দুর্বিপাক দুর্ঘটনা
কোনো কিছুতেই হবে না কিছুই, ধস নেই, মৃত্যু নেই, ক্ষয়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া নেই
শুধু বয়ে চলা আছে, রূপ থেকে রূপান্তরে, রূপক থেকে ক্রমশ রূপকথায়…
জলে স্থলে মহাশূন্যে অগ্নিকুণ্ডে… কোত্থাও মরণ নাই তোর কোনোকালে…
সাড়ে চার শ কোটি বছরের পুরনো এক সজল সবুজ
কমলা আকারের মহাকাশযানে চড়ে
চলেছি সবাই এক অনন্ত সফরে। “ (অমৃতের সন্তান, মাসুদ খান)।

সঞ্জিব পুরোহিত: অসাধারণ পংক্তিমালা। কবিকে ধন্যবাদ, আপনাকেও। হ্যাঁ, কাব্য-কবিতা- কল্পনায় ভেসে নাক্ষত্রিক মেঘের রাজ্যে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলা যায়। আপনি জীবনের প্রবাহমানতার যে চিত্রটা বর্ণনা করলেন তা চিত্তাকর্ষক ও শ্রুতিমধুর। আমি সম্ভবত আলোচনার মূল অংশটা আপনাকে বুঝাতে পারিনি। কোনো ঘটনা অর্থপূর্ণ হবার জন্য ঐ ঘটনার সাথে সম্পর্কিতদের লক্ষ্য, সম্মতি ও স্বেচ্ছা- অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ১৯৭১ সালে জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। বহির্বিশ্বের সাহায্য গ্রহণে ও আত্মত্যাগে তাদের সম্মতি ছিল। লক্ষ্য অর্জনে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। জনগণ যদি স্বাধীনতা অর্জনে আগ্রহী না থাকতো এবং তাদের ওপর স্বাধীনতা চাপিয়ে দেওয়া হতো তাহলে সেটা অর্থপূর্ণ হতো না। এবার দেখুন জন্মের আগে পৃথিবীতে আসার কোনো লক্ষ্য আপনি নির্ধারণ করেননি। পৃথিবীতে আসার পর আপনি যা করছেন তার সবকিছু-ই আপনার শরীরের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা উপাদানগুলো দিয়ে চালিত হয়ে করছেন। এর থেকে ভিন্ন কিছু আপনি করতে পারতেন না। যেমন, আপনি পাথর খেতে পারতেন না, আকাশে উড়তে পারতেন না, মানুষের প্রতি শুধু-ই নিষ্ঠুর বা সহানুভূতিশীল হতে পারতেন না, অপরিসীম ধৈর্যশীল বা বিদ্বেষী হতে পারতেন না।

এই কাজগুলো আপনি সেই মাত্রায়-ই করতে পারবেন যা আপনার প্রবৃত্তি (অথবা, বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব) আপনাকে অনুমোদন করে। কেউ যদি আত্মহত্যা করে তাহলেও সে সিদ্ধান্ত তার মস্তিষ্ক নেয়। অর্থাত সকল প্রাণী খুব অল্প সময়ের জন্য একটা সত্তার বাহন হিসেবে কাজ করে, হতে পারে সেটা মস্তিষ্কের জৈব-বৈদ্যুতিক রসায়ন বা স্পিরিচুয়াল এনটিটি। এই দায়িত্ব পালনে তার সম্মতি-অসম্মতির কোনো সুযোগ নাই। আরও সহজ করে বলি— কেউ আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা ব্যাঘ্র-সংকুল বনের প্রান্তে ছেড়ে দিল। আপনার সামনে দুটি পথ খোলা: এক- বনের প্রান্তে বসে থেকে নিশ্চিত বাঘের পেটে যাওয়া। দুই- সাঁতরে নদী পার হয়ে জীবন বাঁচানো। আপনি দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়ে ভাবতে পারেন আপনার কাজটা অর্থপূর্ণ ছিল। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, এই দুটি কাজের একটির ব্যাপারেও আপনার আগ্রহ বা সম্মতি ছিল না। তাহলে তা অর্থপূর্ণ হলো কী করে!

সিদ্ধার্থ ঋষিন: যদি আমরা ধরে নেই পূর্বানুমতি বা প্রাক- সম্মতি ছাড়া প্রকৃতি বা ঈশ্বর আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাহলেও তা অর্থপূর্ণ হতে বাধা নেই। ধরুন, কেউ আমাকে ধরে নিয়ে কক্সবাজারের একটা পাঁচ তারকা হোটেলে রেখে এলো। ইচ্ছামতো খরচ করার জন্য হাতে পাঁচ লক্ষ টাকাও দিলো। আমি এক মাস সমুদ্রের বিপুল ফেনিল জলরাশির দিকে তাকিয়ে অপার আনন্দময় সময় পার করে ঢাকায় ফিরে এলাম। এই ঘটনাটা আমার জন্য অর্থপূর্ণ না হবার কারণ নেই।

সঞ্জিব পুরোহিত: ঐ বিপদসংকুল বনে রেখে আসা এবং বিমোহন বালুকা বেলায় রেখে আসার মধ্যে মূলগত কোনো পার্থক্য নেই। আমি আগে কয়েকবার বলেছি, নিজের জন্য কোনোকিছু অর্থপূর্ণ হবার প্রথম শর্ত হওয়া উচিত সেই বিষয়টার ব্যাপারে আগ্রহ ও সম্মতি থাকা। আপনি সমুদ্রসৈকতের উদাহরণ দিলেন। এর বিপরীত উদাহরণও বাস্তব হতে পারে। আমার বড়দি সন্তানহীন। যমুনার চরে মহিষ চরানো ১০ বছরের পিতৃহীন এক রাখাল বালককে তিনি দত্তক হিসেবে পুত্রের মর্যাদায় ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বালক এক মাসের মাথায় পালিয়ে এসেছে। আমরা আলোচনার একটা জায়গায় আটকে আছি। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে যা কিছু ঘটে চলেছে সব-ই অনৈচ্ছিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্দেশ্যহীন। হিমালয় এবং তিব্বতের মালভূমি থেকে নদীবাহিত পলিমাটি এসে গাঙ্গেয় বদ্বীপ তৈরি করেছে। এখানে নদ-নদী, পর্বত, কাদামাটি বা মালভূমির কোনো ইচ্ছা কাজ করেনি। চৈত্রের ঘূর্ণিবায়ু যখন এক প্রস্থ ধূলিকণা উড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র ফেলে তখন তাকে আমরা ধূলিকণাগুলোর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করি না। প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান আসলে ঐ ধূলিকণাগুলোর মতো। কিন্তু এরকম ভাবতে বাধা দেয় আমাদের চৈতন্য। ধূলিকণাগুলোর চৈতন্য থাকলে তারাও বাত্যাতাড়িত হয়ে উড্ডীন থাকাকালে বা স্থানান্তরিত হবার পর বিষয়টাকে অর্থপূর্ণ ভাবতো।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন কণার ঘূর্ণন, সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন, সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছের খাদ্য তৈরি, নদীর প্রবাহ, মেঘের সঞ্চরণ- আপনি যদি আলাদা করে এসবের অর্থ বুঝতে চান তাহলে সফল নাও হতে পারেন। তাদের সন্মিলিত অভ্যাগম (কিউমিলেটিভ এপ্রোচ) হয়তো আমাদের জন্য অগম্য, বোধের অতীত একটা বৃহত্তর অন্বয় ও অনুবর্তিতা তৈরি করে। তার অংশ হিসেবে আমাদের কাজ ও অস্তিত্ব অর্থপূর্ণ হবার সম্ভাবনা-ই বেশি।

সঞ্জিব পুরোহিত: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবলে মহাজগতের যে সামগ্রিক উত্পাদন তাকে আপনি অর্থপূর্ণ বা অর্থহীন দুই-ই বলতে পারেন। সৃষ্টির আগেও মহাজগত ছিল। সেই অবস্থাকে আমরা ‘অনস্তিত্তে¡র দশা’ বলতে পারি। এই দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য হলো দৃশ্যমানতা। আমরা যখন তাকে দেখছি তখন তাকে অর্থপূর্ণ বলছি। কিন্তু সৃষ্টির আগের অবস্থাকে অর্থহীন মনে করছি। বাস্তবে আমরা বাস করি একটা ত্রিমাত্রিক জগতে। বোধের সীমাবদ্ধতার কারণে চতুর্থ মাত্রাটি (সময়) গাণিতিক হিসেবের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। আমরা যে রেফারেন্স ফ্রেম থেকে দেখছি তাতে মহাজগতকে অর্থপূর্ণ মনে হবার-ই কথা। মানুষের কথাই ধরুন। তার অস্তিত্বে আসা না আসার মধ্যে পার্থক্য হলো দৃশ্যমানতা। এটুকু বাদ দিলে আমাদের পৃথিবীতে আসা না আসার ফলাফল সমান। প্রায় অসীম ক্ষুদ্র এই সময়ের ভ্রমণ যে অর্থ তৈরি করে ভালো-মন্দ, দুঃখ-আনন্দ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা-দুরাকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে তার যোগফল শূন্য।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: পৃথিবীতে আসার আগে যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হতো আপনি এখানে আসতে রাজি আছেন কিনা তাহলে কিন্তু আপনি রাজি হয়ে যেতেন। তার অর্থ ঐ দশার চেয়ে শূন্য যোগফলের পৃথিবী আপনার কাছে অর্থপূর্ণ মনে হতো।

সঞ্জিব পুরোহিত: এটা একটা ভুল অনুমান। আমি রাজি হতাম সেটা আপনি ভাবছেন কীভাবে! অথবা আপনি রাজি হতেন সেটা বুঝলেন কী করে! আপনাকে যদি এক মিলিয়ন বছর অতীতে বা এক মিলিয়ন বছর ভবিষ্যতে গিয়ে বাস করার অপশন বেছে নিতে বলা হয় আপনি এই দুটির কোনোটি-ই বেছে নিতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। আপনি বর্তমান পৃথিবীতে বাস করতে চাইবেন। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্য করে নিলে আপনি কি আপনার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বাবা, মা, ভাইবোনদের ছেড়ে সেখানে চলে যাবেন!

সিদ্ধার্থ ঋষিন: অনর্থেরও একটা অর্থ আছে। কিন্তু সেখানে কোনো একটা সংঘটন থাকতে হবে।
সঞ্জিব পুরোহিত: তাহলে মহাজগতের ফলাফল যে শূন্যও হতে পারে সেটা মানছেন?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: ফলাফল ইতিবাচক, নেতিবাচক বা শূন্য যা-ই হোক— তাকে অর্থপূর্ণ বলতে কুন্ঠা থাকা জরুরি নয়।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি বরাবর একজন রসিক মানুষ!
সিদ্ধার্থ ঋষিন: রসবোধে আপনি তুলনারহিত! শুভরাত্রি।
সঞ্জিব পুরোহিত: শুভরাত্রি। hassangorkii@yahoo.com
জুলাই ৩১, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।