কবি শিউলী জাহান ছোট ছোট শব্দ খেলায় অবলীলায় গড়ে তোলেন আমাদের একান্ত জীবন আর আমাদের চারপাশের এক অপূর্ব চিত্রিত ক্যানভাস। তাঁর এই শৈল্পিক কাব্য তুলিতে তিনি এই ছবি আঁকতে গিয়ে ভ্রমণ করেন মানুষের দৃঢ় আত্মিক জগৎ থেকে মহাজাগতিক অসীম পথের বাঁকে বাঁকে। তাইতো তাঁর কবিতার রূপকাশ্রিত ছবিগুলো একেবারে আমাদের সাদামাটা জীবনের গান গাইতে গাইতে ধেয়ে চলে মহাকালের সিম্ফনির ঝংকারে, যা আমাদের মাঝে নিয়ে আসে প্রাণিত প্রাণের স্পন্দন। শিউলী জাহানের এই ভ্রমণ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একেবারে বর্তমান সময়ের মানুষের স্বরূপকে তুলে ধরে, সেই সাথে তিনি আমাদের সামনে উম্মোচিত করেন প্রকৃতিকে ভালোবেসে ঋজু হয়ে এই প্রকৃতির অপার আনন্দে নিজেকে অবগাহিত করতে। কবি শিউলী জাহানের কবিতার জীবন ঘনিষ্ঠ শব্দের লয়ে এক অপূর্ব প্রাণ জুড়ানো সোনালী গান ভেসে আসে, যে গান আমাদের মাঝে বারে বারে জাগিয়ে তোলে আমাদের ঈপ্সিত জীবনবোধ আর প্রত্যয়ী জীবনানন্দকে।
– মনিস রফিক

শিউলী জাহান-এর জন্ম তাঁর পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার পারিল গ্রামে। তিনি পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিউলী জাহান সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন এবং তাঁর সাংবাদিকতা পেশা তাঁকে লেখালেখির জগতে প্রবেশের ক্ষেত্র প্রসারিত করে। মূলত কবিতার নিগড়ে বেঁধে থাকতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। তবে যা কিছু মন ও হৃদয়কে আন্দোলিত করে, ভাবনার সাগরে ঢেউ তোলে এমন সব বিষয় নিয়েই তিনি লিখতে পছন্দ করেন। প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর লেখার মূল বিষয়। বাংলাদেশ ও টরন্টোর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতা ও রচনাসমূহ। বর্তমানে তিনি সপরিবারে বসবাস করছেন কানাডার টরন্টো শহরে।
শিউলী জাহানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে, ‘আশার বাগানে নীল প্রজাপতি’ ও ‘দ্রোহের সাত রঙ’।

আগুনমুখী

আমি আগুন হাতে নিয়ে বসে থাকি
যতটা সময় থাকা যায় দগ্ধহীন!

পাথরে পাথর ঘষে দিয়ে গেছে পূর্বপুরুষ
নিশ্চয়ই গুহামানব বোঝেনি কতটা হতে পারে দাহ্য,
কতটা দহন – কতটা বিবিধ হতে পারে তার ব্যবহার
নিতান্তই তুচ্ছ হতে পারে ভূ-গোলকে যা কিছু ন্যায্য।

কাঠ পোড়ে, নগর পোড়ে, পোড়ে মন এবং মানুষ
পুড়ে পুড়ে ছাই হয় বিগত দিনের প্রেমময়!
আগুনের দাহ্যতায় মসনদে ঘটে অভিষেক
লকলকে শিখায় ঠেস দিয়ে ভূত ও ভবিষ্যতের দাবায়।

আমি আগুন হাতে নিয়ে বসে থাকি
পাথর পুড়ে একখন্ড হীরকের আশায়।

সম্পর্কগুলো পথ বা নদীর মতো নয়

মানুষের সম্পর্কগুলো হয় খুব হঠাৎ করে
মুখর হলরুমে, বৃষ্টিভেজা দুপুরে, কোনো নির্জন কফি টেবিলে
কিংবা অস্থির জনপদে; মানুষের সম্পর্কগুলো পথ বা নদীর মতো নয়
জীবনের জটিল সমীকরণে সমান্তরাল হয় না এগিয়ে চলা।

মানুষের সম্পর্কগুলো অনেকটাই আবার ঋতুকালীন
সকল সময় উজ্জ্বল থাকে না চাঁদ এবং নক্ষত্রেরা; ঘন্টাধ্বনির সাথে
বাঁধা থাকে তার স্থায়িত্বের নোঙর; সবুজ-হলুদ-কমলা পাতার মতো
একসময় ঝরে যায়; আবার শীতনিদ্রায় খোঁজে পুনর্জাগরণ!

পথ কিংবা নদী কিছুটা গন্তব্যহীন গন্তব্যে বয়ে চলে অন্তহীন
তীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে জনপদ; শাখাপ্রশাখা মাড়িয়ে নাড়িয়ে,
মানুষের সম্পর্কগুলো কিছুদিন গন্তব্যহীন–উড়ন্ত-ডুবন্ত রঙিন বেলুন
অতঃপর অস্তিত্বের অন্বেষণে খুঁজে নেয় উষ্ণ গৃহকোণ!
শূন্যতার কোলাহলে

যখন মনে হচ্ছে
সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,
নিঃস্তব্ধতার গাঢ় কুয়াশায় কেবলই মৃত্যুর মুখ
শূন্য ব্যালকনিতে কিংবা বন্ধ জানালায় উঁকি দিচ্ছে ভয়,
একাকী রাজপথ আনমনে গুনে যাচ্ছে প্রাণের ক্ষয়,
এবং আমরা সবাই রুদ্ধদ্বারে আমাদের একাকীত্ব নিয়ে
ধেয়ে আসা তীব্র আলোর সামনে দাঁড়িয়ে
ভয়ার্ত এক হরিণের মতো!

তখন করতল বাড়িয়ে দিয়েছে সৃষ্টির মৌলিক পাণ্ডুলিপি
আমাদের অস্পর্শ হাত সযত্নে স্পর্শ করেছে মানবিক বোধ,
আমরা শিখেছি প্রদীপ নেভানো রাত্রির মতো নীরবতা
সময়কে সূচকে ধরে রেখে বটবৃক্ষের মতো সহিষ্ণুতা,
আমরা আত্মস্থ করেছি বিজ্ঞান ও আধুনিকতা
স্মরণ রেখেছি ঈশ্বর, ভুলিনি নিজ নিজ প্রথা!

শূন্যতার কোলাহলে আমরা তো দেখেছি
প্রকৃতি ও মানুষের পরম নির্ভরতা
সেখানে সাফল্য নয়, ব্যর্থতা নয়,
পরিশেষে টিকে থাকে ভালোবাসা
বেঁচে থাকার–বাঁচিয়ে রাখার
জীবনের মৌলিক কোমলতা।

প্রিজম

দূর থেকে পাতাগুলো যখন ঝলমলে
হলুদাভ-খয়েরি এবং রাসবেরি লালে আনত
যখন দিগন্ত সূর্যের নিমিত আগুনের প্রভায় সিঁদুর রমণী
এবং সারিবদ্ধ ফেরারি পাখিদের কালো ছায়া প্রার্থনায় জোড়া বাঁধে;
যখন শীত জেলিফিশের মতো থকথকে শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়-
আমি আমাদের গন্তব্যের ঘন্টার সংকেত শুনতে পাই।
ঠিক এই প্রিজম সময়গুলোতে
আমি জীবনের পাথরগুলোকে নিরীক্ষণ করি- নিজেকে খন্ডিত করি-
আগুনের তাপ থেকে গুটিয়ে নেই হাত।
কেউ কেউ বলে এই পৃথিবীর সমাপ্তি হবে আগুনে
কেউ বলে, বরফ যুগে
আমি আগুনের স্বাদ নিয়ে দেখেছি-
আগুনের সপক্ষে যারা, তাদের বুক জুড়ে
শুধু ঘৃণা–
তারা গড়তে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে ভালোবাসতে
বরং বরফ যুগের পক্ষে থাকাই ভালো।
করোটির রেখা

আমরা বরাবর চেনাপথেই হাঁটি
বিজন-নির্জন ঘুরে ঘুরে আবার চেনামুখেই চোখ

আজকাল অচেনা পথগুলো – বড় বেশি অচেনা,
অন্ধকারাচ্ছন্ন, শ্বাপদসংকুল —
মীমাংসিত ঋতুর স্বাদ নিতে সহসাই ব্যাকুল
হয়ে ওঠে মধ্যাহ্নের নির্জনতা,

ছন্দের নিয়ম ভেঙেচুরে জীবন জেনেছে
কুয়াশাপথে এখন আর সন্ন্যাসধর্ম নেই; নেই বৃক্ষবাড়ি
মগজের উত্তাপ নিয়ে পাখিদল নেমে এসেছে কাঁচের আলোয়।

এখন বিকেলের আনমনা বারান্দায় জীবনকে দেখতে ভালোবাসি,
সবুজ পুঁইয়ের ডগায় একফোঁটা বৃষ্টির নম্রতায় খুব ডুবে যাই,
পুরনো পকেটে রুমালের ভাঁজে চেনা সুগন্ধি
করোটির হাড়ে বিগত দিনের ক্যানভাস আঁকে।

সময় ও সভ্যতার চাকায় সচল কাঠঠোকরা
কৌতূহল ও ক্লান্ত করে ভারী চোখ, প্রত্যুষের শিশির,
অপেক্ষারত বইটির পাতা উল্টায় বিশ্বস্ত আঙুল।

স্ব এবং নিজস্বতাই এখন আমাদের পরম নিরাপত্তা
মানুষ ও মনস্বিতার গুঞ্জনে কাছে ডাকি মানুষসত্তা।

কাকাতুয়া রঙের বিকেলে

একে একে ছেড়ে গেছি সব মায়ার ঘাট শুশুকের মতো
দু’চোখের দুরত্ব নিয়ে দূরে সরে থাকি যেন পাথরের নারী,
ডুবজলে নদী যেমন সরে যায় কালের পথে, সকল পদচিহ্ন মুছে।

পিঁপড়ের সারির মতো অগণন মায়াবী ছায়া হেঁটে যায় কুয়াশায়
মহাকালের সিম্ফনি বাজে কালোত্তীর্ণ মেঘেদের মৌন শোভায়,
রোদ-ছায়ায় মুখের রেখায় হামাগুড়ি দিয়ে মিলিয়ে যায় বসন্তদিন।

দূরবর্তী অমলিন স্মৃতিতে কাকাতুয়া রঙের অপেক্ষমাণ বিকেল
আমাদের অনাবৃত ছায়ার গভীরে আজও আনমনে হেসে ওঠে,
আজও আমলকির ব্যাকুল ঘ্রাণ মোনালিসার বিমূর্ত ঠোঁটে।

তুষারমৌলির রুপালি বাকলে নির্মাণ ঘুমায় শীতল কম্পনে,
তবুও–নিদ্রিত আকাশে জেগে থাকে সব নক্ষত্রদের অনিদ্রিত তৃষ্ণা,
বাবুই ডাকে এই স্তব্ধ বিকেলে অনির্বাণ আবেগের নতুন বুননে।
অপরাহ্ণের সাঁকোতে দাঁড়িয়ে

রোদের মুখমন্ডল গলে গড়িয়ে নামছে
ঝলমলে নদী; সেখানে সাঁতার কাটছে
ফিনিক্স পাখিরা আনন্দ-উৎসবে; পালকের
ভাঁজে ভাঁজে শতাব্দীর সিঁড়ি ভাঙার গল্প-
গন্ধরাজ গার্হস্থ্যবেলা
রক্তজবা দুপুরের বন্ধুর পথরেখা,
সভ্যতার গায়ে আঁকা টলমলে অশ্রæবিন্দু,
কিংবা সমুদ্রস্নানে গাংচিলের পাখা মেলা।

তাঁদের রৌদ্রস্নাত বুকে আমি সভয়ে কান পাতি
নিদ্রামগ্ন আফ্রোদিতির করুণ শোকের স্বনন
কিংবা মুক্তোর খোঁজে- বিস্ময়ে দেখি,
তাঁদের হৃদয় জুড়ে পলাশের রঙ, জুম চাষের কোলাহল
আবদ্ধ সব জমি দলেবলে হয়ে উঠেছে ভীষণ আবাদি।

মেঘের ছায়া সরিয়ে দু’হাত মেলে দিয়েছে স্থবির পাহাড়,
বসন্তের শেষবেলায় গাছে গাছে নতুন পুষ্পের বাহার,
আমাকে আশ্বস্ত করে সূর্যমুখী দিন, কৃষ্ণচূড়ার ঘ্রাণ,
অপরাহ্ণের সাঁকোতে দাঁড়িয়ে
আমি প্রফুল্ল চিত্তে গাই ফসলের গান।

আলোর জন্য যুদ্ধ

যখন দৃশ্যায়নে দেখি হাইপেশিয়ার মৃত্যু, দেখতে পাই প্রাচীন হাড়ের দহন। একজন নারীর। একজন কন্যার।
ধুম্রজালে ঘুরপাক খায় দর্শন, গণিতশাস্ত্র, সময় ও বর্তমান! আমি ভাবতে চাই, বহু আগে সরে গেছে সেই অন্ধকারের কাল।
আলোর জন্য যুদ্ধ হয়নি কবে, বন্ধু? তাই তো আজও হাইপেশিয়ার দগ্ধ অবয়ব দেখি, পারাবালানিদের উল্লাস দেখি।
রক্তে প্রোথিত বৈষম্যের নৃত্য দেখি। সৃষ্টির আদি থেকেই তো শুরু ইতিহাসের পালাবদল। তাই সেলিবেসির রূপান্তর খুঁজি বর্তমানে।
মানচিত্রে দাগ কাটি, হাতের মুঠোতে নেই মৃত্তিকার ঘ্রাণ, নিজেকে ভেঙে ভেঙে জলে নামি…আবার হাইপেশিয়ার কাছে এসে নিজেকে পোড়াই।

হাইপেশিয়া তুমিই বলো, আজ কতটা সেজেছে নারী, অলংকারবিহীন, আপন যাত্রায়, নিজস্ব মাত্রায়!
এখনও নারী কেন পোড়ে? পোড়ানোর এতো কেন আয়োজন রাজপথে, ইন্দ্রজালে, অন্তরে-অন্তরে।

আলোর জন্য যুদ্ধ হয়নি কবে! তাই পুনর্পাঠ, জোয়ান অব আর্ক, ইতিহাসের পাতায়!

ফসিলের গল্প

সমুদ্রে যেতে যেতে জনস্রোতে আটকে যাওয়া কষ্টের
অতঃপর সেটা বিরহে রূপ নেয় আর পথ খুঁজে না পেয়ে।

এখন রাত আর দিনগুলো একইভাবে আসে যায়
প্রাত্যহিক লেনদেন, নিয়মিত টিপটিপ জল পড়া,
গুচ্ছ গুচ্ছ স্তব্ধতা খেয়ে নেয় মধ্যাহ্ন আর রাত্রিযাপন।

কেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া কঠিন
আরও কঠিনতর হয় যদি থাকে মায়ার বিপরীত টান।

প্রতিদিনের লিফটের উঠানামা; সমান্তরালে চলাফেরা বিরতিহীন
অথচ সব সচলের মাঝেও খুব অন্তরীণ কিছু নিশ্চল
যেন মৃত মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে –
মৃত মানুষ খোলা জানালা পেলেও আর আকাশ দেখে না
সূর্যকে পাবারও বোধহয় আর কোনো প্রত্যাশা থাকে না তার।

এই দেখুন,
আমি মানুষের কথা বলতে গিয়ে
ফসিলের গল্পে হারালাম – নাকি নদীর কথা বলছি?

পালকে জলের দাগ

কিছু সুন্দর দূরত্বে দীপ্তি ছড়ায়
কালো হ্রদে ভেসে থাকে শুভ্র রাজহংস যেমন।
পালকে তার রৌদ্রগন্ধ
ঋজু গ্রীবায় নিপুণ অহং;
নৈকট্যে- পালকে জলের দাগ; আকাশের ঘন নীলে
কেবল বায়ুর আর্দ্রতা
জলকণা, অপার শূন্যতা–
কবি হয়ে যায় শব্দহীন;
রূপালি চাঁদ জাগে জ্যোৎস্নাবিহীন;
নৈকট্যে, মুগ্ধ পাখিরা উড়ে যায়
কেবল রেখে যায় কিছু মাংসের গন্ধ!

কাকতাড়ুয়া জীবন

আমাদের এক একটি জীবন আজ
নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়া।

প্রতিদিন বুকের পাঁজর গুনে গুনে রাখি
চোখের পাপড়িতে আঁকি সীমাবদ্ধতার বেড়ি।

পর্দা টেনে দেই-বাড়ে অর্গলের ভার
দু’হাত মেলে দিয়ে কেবলই তাড়িয়ে বেড়াই
অনাহুত কীটপতঙ্গ; দুষ্টচক্র।

ফসলি ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলা নিশ্চিন্ত পথিক আর নেই!

কষ্টনদীর উজান স্রোত

কষ্টনদীর উজান স্রোতে ভাবনাগুলো
এখন কেবলই নিম্নগামী।

আরশির উপত্যকায় মাতৃত্বের ভূলুণ্ঠিত দেহ;
ঝিলিক দেয় চাপাতির ধার; দাবার ক‚টনৈতিক চালে
আত্মজের হৃদপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড়!
খাবি খায় পুরনো শকুন! স্বচ্ছ গ্লাসে
উছলে ওঠে বহুজাতিক স্বার্থের সংলাপ!
সবুজ আগুনে পোড়ে মনুষ্যত্ব; পোড়ে দেশপ্রেম!
ধুলোয় পড়ে থাকে আদিপিতার খণ্ডিত লাশ;
ছায়ার তলে ছায়ার আশ্রম,
স্বজনের অশ্রুত শয্যায় দূরত্বের পরিধির বিভ্রম!

এমন দিনে কী করে সাজি সখী রমণীয় সাজে
কী করে নিজেকে জড়াই বাসন্তীর বিনম্র বেহাগে!
কপালের টিপে আঁকি তাই বেদনার দু’চোখ;
লজ্জিত আঁচলে ঢাকি শিক্ষার বোধ!

ভাবনাগুলো আজ কেবলই নিম্নগামী
কষ্টনদীর উজান স্রোতে অশনির ঘণ্টা শুনি!

আমাদের অক্ষমতা

আমাদের অক্ষমতাগুলো কী অবাক
একে একে ঢাকা পড়ে যায় রঙিন চাদরে!

আমরা সূর্যতোরণের ছবি আঁকি কফিনে পেরেক ঠুকে,
মুখে সুখের প্রলেপ মেখে।
আমাদের অক্ষমতাগুলো প্রতিদিন
জমা হচ্ছে হাসপাতালের করিডোরে,
প্রতিটি শিশুর আর্তনাদে,
সময়ের কুটচালে যুবকের তাজা রক্তে,
রাজপথে পড়ে থাকা ফুটন্ত গোলাপের নিথর দেহে,
বিলাসের অলিতে-গলিতে।

এ-যেন এক ঘোর লাগা সময়
যেন অলিন্দ-নিলয়বিহীন এক পাঁজরের ঘর
উবু হয়ে বসে আছি জরায়ু সময়ের হাত ধরে!

হায়! আমাদের অক্ষমতায়
মূক ও বধিরের নিরন্তর অভিনয়!

এক জ্যোৎস্নায় বিষণ্ণ মহাচাঁদ

সেদিন চাঁদের মাতাল জ্যোৎস্নায় ভিজেছিল পৃথিবী। ভিজেছিল সভ্যতা প্রাচীন মগ্নতায়; ভিজেছিল আরো শতজোড়া
চোখ, প্রকৃতির আলোয়–সে আলোয় তারা চিনে নেয় আপনজন, দেখে নেয় পোড়া ভিটে, ভাঙা হাঁড়ি, খসে
যাওয়া কাঁচুলি; জ্বলে যাওয়া পালক–খসখসে ডানায় কেঁদে যায় নিশাচর, কাঁদে না শতজোড়া চোখ। চোখের
কার্নিশ থেকে হারিয়ে গেছে জল। তীর ধনুকে গেঁথে গেঁথে সেই সে কবে – শতলাশ পড়েছিল বর্গী আমলে,
নিজভূমিতে তারা আর কাঁদে না; মাটি খামচে ধরা জুমচাষের শক্ত মুঠিতে কেবল শূন্যতা জমা হয়; চাঁদ-
জ্যোৎস্নায় একতাল অভিমান হয়ে ভিজিয়ে দেয় আদিমেরুদন্ড।হৃৎপিÐে বেজে চলে সাঁওতালি মাদল – দ্রিম দ্রিম
দ্রিম; কেঁপে উঠে কালো মাটি – কাঁপে না মানুষ!

কেঁপে উঠেছিল কি তিতাস নদীর ঢেউগুলোও বুকে নিয়ে শাঁখা-সিঁদুরের আর্তনাদ; উবু হয়ে পরে থাকা বিচূর্ণ
মন্দির সে চাঁদের আলোয় খোঁজে অন্ধকার নিশি! দ্রিম দ্রিম দ্রিম…সুদূরের সাঁওতালি মাদল এসে মিলিয়ে যায়
আদিবাসী এক মেতিস কবির কণ্ঠে – এমন চাঁদের আলোয় সেও কি ভিজেছিল স্বদেশে পরবাসী নিঃশ্বাসে সংরক্ষিত
আদিঘরে? অথবা চাঁদ-প্রেমে শিহরিত হয়েছিল কি তাইগ্রীস নদীর উপক‚ল? ব্যাবিলনের শূন্যউদ্যান ধরে ঝুলে
থাকা লাশের মিছিল? হৃৎপিণ্ডে বেজে চলে সাঁওতালি মাদল – দ্রিম দ্রিম দ্রিম। কেঁপে উঠে কালো মাটি – কাঁপে না
মানুষ!

আর আমার এই পরবাসী চোখে ছিল কেবল চাঁদের শরীর; কালো আকাশ চিরে ঝরেনি মধু–দেখিনি সিন্ধু জলে
ঝিলমিল আলোর নহর। দেখেছি তার কালের ক্ষতে বিক্ষত বিপন্ন সোনালি অবয়ব, সাতদশকের বিবর্তনে
অসভ্যতা থেকে সভ্যতা–ক্রমশ সভ্যতা থেকে অসভ্যতার বিমূর্ত নগ্নতায় বিষণ্ণ শোকগ্রস্ত এক মহাচাঁদ!