হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

ছোটোবেলার কথা বলছি। বিশেষভাবে ঢাকার নয়াপল্টনে আমাদের বাসার কথা। বিশাল জায়গা ও অনেক গাছপালা ও বাগান নিয়ে আমাদের সেই সেমিপাকা বাসা। ভাড়া ছিল দুইশ’ টাকা। উঠোনে আমি বাগান গড়ে তুলেছিলাম হরেক রকম ফুলগাছের। ১৯৭১ সাল। যুদ্ধের বছর। স্কুলে যেতে হতো না। পথে-ঘাটে, মাঠে, রাজারবাগ পুলিসলাইন ও সি অ্যান্ড বি’র গোডাউন চষে বেড়াতাম। আমাকে দেখে হাফ ট্রাকে বসা পাক আর্মিগুলো বিজাতীয় চোখে তাকালেও আমার সাইজ ও আকার আকৃতি দেখে কিছু বলত না। আমিও তাদেরকে খুব একটা পাত্তা দিতাম না। বরং তাদের গতিবিধি ও অন্যান্য খবর এনে দিতাম আমাদের পাড়ায় মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেয়া তরুণ বা যুবকদের।

তখন ঢাকায় ছিল অনেকটা গ্রামীণ আবহ। গাড়িঘোড়া ও লোকসংখ্যার আধিক্য ছিল না। ফলে দূর থেকে ভেসে আসা দাড়কাকের প্রলম্বিত কা-কা স্বরে বা ফেরিওয়ালাদের ডাকে উদাস হতাম।
অটো প্রমোশনে ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠেছি। আর সেইসাথে আমাদের বিজয়ের আভাস পাচ্ছিলাম।

নয়াপল্টনের বাসার প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আমাদের বাসায় ঝাল খাওয়া হতো খুব, আমাদের গোটা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ঝালের রেওয়াজ ছিল। খাওয়া হতো শুটকি ভর্তা আর শুটকিমাছের নানা তরকারি। ছোটোবেলায় আম্মাকে দেখেছি রোদে ফেলে চান্দা মাছের শুটকি বানাতে। বাজার থেকে একটাকা বা দুইটাকার চান্দা মাছ কিনলে সেটা কয়েক সের হতো। সেই চান্দা মাছ এখন ইতিহাস। আরও অনেক মাছের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে বলে আশঙ্কা করছি।

তারপর আমরা খেতাম মাঠা- পাতলা, টকটক। সেটা দুই কাঁধে ঝোলানো চ্যাপ্টা লাঠির দুইদিকে হাঁড়ি ঝুলিয়ে এক হিন্দু লোক আমাদের বাসায় দিয়ে যেত। মাস শেষে এসে টাকা নিয়ে যেত। লোকটার চেহারা এখনও ভেসে ওঠে মনের কোণে, বেঁটে-মোটা তেলতেলে শরীর, খালি গা, বিশাল ভুঁড়ির অনেক নিচে এক চিলতে ধুতি, চুল ছোটো করে ছাঁটা আর লম্বাটে মুখে নাকের পাশে একটা মোটা তিল। আর আসত এক পাগলাটে আমওয়ালা। দরজার কড়া নাড়ত সে। আমরা কেউ দরজা খুলে দিলে বিশাল ঝুড়ি ভর্তি আমগুলো সে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে ঢেলে দিয়ে চলে যেত। এরকমটা সে করত আমের মরসুমে অন্তত তিনবার। তারপর আসত টাকার জন্য। সে আম ফেলে যাবার পর ঘরটা পাকা আমের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করত। আমরা ভাইবোনেরা আমের সদ্ব্যবহার করতে লেগে যেতাম।
আপনারা শুঁয়োপোকা দেখেছেন তো? কালো, রোঁয়াসমৃদ্ধ এবং ঘিনঘিনে। এসব আমাদের আম, পেয়ারা আর বড়ই গাছে ছিল। আমগাছের কাণ্ডে এরা একত্রে শয়ে শয়ে অবস্থান করত। একবার পেয়ারা গাছে উঠে আমি পেয়ারা খুঁজছিলাম। খোঁজার কারণ হলো গাছের সমস্ত পেয়ারা সাবাড় করেছিলাম আমিই। তারপরও আঁতিপাঁতি করে খুঁজলে দুয়েকটি পাওয়া যেত। তেমনি একটি গোল, হলুদ ও নধর পেয়ারা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। কিন্তু সে ছিল মগডালে, আমি বৃষ্টিভেজা ডাল ধরে, পা পিছলে না যায়, তেমন সাবধানতায় আরেকটি ডাল মুঠো দিয়ে ধরলাম, সাথে সাথে জ্বলে উঠল আমার হাত। একসাথে কয়েকটি ছ্যাঙ্গাসমেত ডালটা চেপে ধরেছিলাম! সাথে সাথে রস বেয়ে পড়তে লাগল আর আমার হাতে বিঁধে গেল অজস্র রোঁয়া! তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেমে পড়লাম, পেয়ারাটা ঠিকই পেড়েছিলাম। তারপর আমি অসুস্থ, হাত ফুলে গেছে। আম্মা চুন মাখিয়ে দিলেন হাতে। কী আর করা, বিছানায় বসে একটা কালো পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ পেন্সিলটা হাত থেকে পড়ে গেল। খাটের তলে উঁকি দিয়ে কালো পেন্সিলটা উঠাতে গিয়েও আবার ছেড়ে দিলাম। ওটা ছিল কালো একটি শুঁয়োপোকা! এবার ডান হাতটাও গেল। বাচ্চাদের মাথায় অল্পস্বল্প চুল গজানোর মতো আমার হাতের তিন আঙ্গুলে রোঁয়া আর রোঁয়া। সেগুলো একটা একটা করে উঠাতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। তারপর এই হাতটাতেও চুন পড়ল।

অথচ ১৯৮২ সালে আমাদের গোপিবাগের বাসায় থাকতে জামরুল গাছ থেকে ওরকম একটি ছ্যাঙ্গা যখন আমার মাথায় পড়ল তখন ভয়ে-ঘৃণায় দুইচোখে অন্ধকার দেখেছিলাম! ভাগ্যিস সেদিন সাথে বন্ধু আলম ছিল। ও আমার মাথা থেকে ছ্যাঙ্গা সরিয়ে ফেলল।

এই ছ্যাঙ্গা যে কত উপাদেয় খাবার আফ্রিকার কয়েকটি দেশে, সেটা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক-এ দেখলাম। আফ্রিকা মহাদেশের পুরো দক্ষিণ অংশজুড়ে এই পোকা খাওয়ার রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। বাড়িতে এনে লবণ-মরিচ সহযোগে রসনা নিবৃত্ত করছে তারা! ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকে দেখেছি বতসোয়ানার একটি অঞ্চলে বিভিন্ন রকম গাছ থেকে মেয়েরা ঝুড়িভর্তি শুঁয়োপোকা সংগ্রহ করছে। এসব শুঁয়োপোকার নাম মোপেন (Mopane)।

মোপেন গাছের নাম অনুসারে। তাই বলে এরা শুধু যে মোপেন গাছের পাতাই খায় তা না, তারা অন্যান্য গাছ যেমন, আমগাছের পাতাও খেয়ে থাকে। আর ছড়িয়ে থাকে বিশাল অঞ্চলজুড়ে। মহিলারা সাধারণত কারুর মালিকানায় নেই, এমনসব ঝোপঝাড় থেকে এসব পোকা ধরে টপাটপ ঝুড়িতে ফেলে। কারো বাড়ির আঙিনার মোপেন গাছ বা অন্যগাছ থেকে এসব পোকা সংগ্রহ করার সময় সেই বাড়ির বাসিন্দাদের অনুমতি নেয়া হয়।

এসব পোকা হাত দিয়ে টিপে চিড়িক করে ভেতরের রসালো অংশ ফেলে দেয়া হয়! তারপর এগুলোকে রোদে শুকিয়ে ফেলা হয়। এরকম শুকনো অবস্থাতেই অনেকে মজাদার চিপসের মতো শুঁয়োপোকা খেয়ে ফেলে। আরো মজা হবার জন্য এগুলোকে ভেজে বা সেদ্ধ করে পেঁয়াজ-মরিচ-লবণযোগে খাওয়া হয়।

নয়াপল্টনের বাসাটা ছিল স্মৃতিময়। এখন ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। এই বাসা ও সেই আমলের ঢাকা শহর, মানে আমার জন্ম ও বড় হওয়া এই ঢাকা শহরের গল্প করার ইচ্ছেটা লালিত আছে। খুব শিগগিরি লিখব হয়তো।