ইউসুফ কামাল : গাড়িতে বসে এসি’র বাতাসটা বাড়িয়ে সবাই ঠান্ডা হয়ে নিলাম। ঠান্ডা বাতাসে সবাই একটু একটু করে চাঙ্গা হতে শুরু করলো। বুলা’র দিকে ভালো করে তাকাতেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো বল্লো, আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো কেনো? এর মধ্যেই তো বেড়ানোর আনন্দ, তবু তো তুমি অনেক ভালো ব্যবস্থা করেছো। করিম মিয়াকে বল্লাম, মোগরাপাড়া বাস স্ট্যান্ডে কিছু ভালো হোটেল আছে, ওখানেই খেয়ে নেব চলো। সবারই এখন খাওয়া দরকার।

রোদে আর পরিশ্রমে মনে হলো সবাই কম বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঈষত হাপিয়ে ওঠা সবার চেহারায় একটা ভিন্নতা যোগ হয়েছে তবুও সবারই ভালোই লাগছে। স্বত:স্ফূর্তিতার জন্য সবাই এখনও প্রাণবন্ত, কেউই অন্যকে বুঝতেই দিচ্ছে না যে সে ক্লান্ত। বেড়াতে গেলে একটু আধটু পরিশ্রম হয়-ই, সেটা মেনে নিতেই হয়।
বিশ্রামের পর খাওয়ার পর্ব শেষ করলাম, খাবারের মানের সার্বিক অবস্থা যা চিন্তা করেছিলাম তার চেয়ে ভালোই। ভালো খদ্দেরই আসে বোঝা গেলো, তা ছাড়া রান্নার মানও ভালোই মনে হলো। ভ্রমণকারীদেরকে ধরে রাখতে হলে তো এ গুলো করতে হবে না হলে ব্যবসা চলবে কেন?

সোনারগাঁও নাম নিয়ে অনেক রকম জনশ্রæতি আছে, কেউ বলে সুবর্ণ ভূমি থেকে সোনারগাঁও এর নামকরণ হয়েছে, অনেকের মতে আশেপাশে কোন সোনার খনি ছিলো আর সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে সোনার গুঁড়ো ভেসে আসতো তার জন্য হতে পারে, এমনি অনেক কিছুর মতো আরো আছে ঈশা খা’র স্ত্রী সোনাবিবি’র নামানুসারে সোনারগাঁও এর নামকরণ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে কোনটা যে সত্য তার কিন্তু কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
সোনারগাঁও ছিলো বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীন পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। ৪৫০ বছর আগে বারোভূইয়ার দলপতি ঈশাখা ১৫ শতকে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনারগাঁও এ।

এখানে সোনাবিবির সমাধি ছাড়াও পাঁচ বিবির মাজার, ইব্রাহিম দানিশমান্দ এর দরগাসহ নানা রকম স্থাপনা আছে। সোনারগাঁও এর উত্পাদিত মসলিন সম্মন্ধে জনশ্রুতি আছে, একটা মসলিনের বড় চাদরকে নাকি একটি দিয়াশলাই এর বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা যেত। বিশ্ববিখ্যাত এই মসলিনের একমাত্র উত্পাদন স্থল ছিলো এই সোনারগাঁও। পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রক্ষপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি জনপদ। চারিদিকে নদী দ্বারা বেস্টিত ছিলো বলে সহজে কোন শত্রু সোনারগাঁওকে আক্রমণ করতে পারতো না।
হাঁটতে হাঁটতে বড় সরদার বাড়ির সামনে চলে আসলাম। এটা ঈশা খাঁর জমিদার বাড়ি হিসাবেও পরিচিত। মতান্তরে অনেক ঐতিহাসিক এটাকে গোপীনাথ সরদারের বাড়ি হিসাবেও বলেছেন। অনেকে এও বলেছেন, এই বাড়িতে ঈশা খা বাস করতেন তাই এটা ঈশা খা’র বাড়ি হিসেবেই পরিচিত। নীচতলায় ৪৭টি আর দোতলায় ৩৮টি কক্ষসহ সর্বমোট ২৭৪০০ ফুটের বিশাল বাড়িটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

দুই তলা বাড়ির সামনে ঘাট বাঁধানো বড় পুকুর, বাড়ির সমান্তরাল আরো কয়েকটা বাড়ি। ঈশা খাঁর বাড়ি দেখলেই বোঝা যায় এক সময় কতো দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিলো এই বাড়ির বাসিন্দাদের। বাড়ির প্রধান প্রবেশ পথের দুই পাশে দুই অশ্বারোহীর মুর্তি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে যেন নিজেদের কাজই করে যাচ্ছে।

সবাই মিলে যেয়ে বসলাম দীঘির ঘাটে, রোদটা একটু কমে এসেছে। বুলা স্যান্ডেল খুলে পানিতে পা ভিজিয়ে পানির কাছা কাছি যেয়ে বসলো। বরিশালের মানুষ তো পানি দেখে ওরা ভয় পায় না বরং পানির সাথেই সখ্যতা বেশি, পানির আবহাওয়াতেই যে ওরা বড় হয়েছে।
বিদ্যুত সিগারেট ধরিয়ে বল্লো, আমি একটু হাঁটি তোমরা কথা বলো। এমনিতেই ও একটু অনুসন্ধানী চরিত্রের মানুষ বোধহয় অন্যকোন স্থাপনা আছে কিনা দেখতে গেলো। নাকি আমাদেরকে নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলো সেটা ওকে কোনদিনই আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।
স্মৃতির অ্যালবাম এ আটকে থাকা প্রহরগুলো যেন মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়, কিছু সুখস্মৃতি আবার কিছু বেদনার। তবে সব গুলোই কিন্তু সুখ জাগানিয়া। দু:খের প্রহরগুলো যেন এখনো দু:স্বপ্নের মতোই ছড়িয়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে মনের এখানে ওখানে।

বুলার মন ভালো থাকলে বোঝা যায় ওর গুন গুন গান গাওয়া। লক্ষ্য করে বল্লাম, প্রথম দিন তুমি কোন গানটা গেয়েছিলে তোমার কি মনে আছে, তুমি কি বলতে পারবে?
আমার যদিও মনে আছে তবু বুলাকে জিজ্ঞাস করলাম। বুলা বুঝে ফেলেছে আমি পরোক্ষভাবে গান শুনতে চাচ্ছি। তা ছাড়া পরিবেশটাও গান শোনার মতোই, সামনে অথৈ জলরাশি আশে পাশে মোহনীয় নৈসর্গিক পরিবেশ, একটা ঐতিহাসিক সুন্দর পরিবেশই বটে।
বুলাও হয়তো এমনি কিছু একটাই ভাবছিলো, বল্লো ওটাই শুনতে চাচ্ছো তো? তবে ঐ গানটা আজ না হলেই হয়তো ভালো হতো।
তখনও বুঝিনি পরিবেশ এমনিভাবে ঘুরে যাবে, আগে বুঝতে পারলে হয়তো আমিই বলতাম না।
একজনের ভাবনার সাথে অন্যের ভাবনার মিলে যাওয়ার মধ্যেই বোধ হয় মানুষের সাথে মানুষের মনের মিল হয়। না হলে, না বলা কথার মাঝে, ভাবনা চিন্তার মাঝে মিল আসে কেমন করে?

আমাকে বিস্মিত করে গেয়ে উঠলো সেই দিনের সেই গানটি “আমার প্রাণের’ পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মত
সে যে ছুয়ে গেল নুয়ে গেল রে ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত
সে চলে গেল বলে গেল না সে কোথায় গেল ফিরে এল না
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল কি যেন গেয়ে গেলো
তাই আপন মনে বসে আছি কুসুম বনেতে
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে চাঁদের আলোর দেশে গেছে।।
যেখান দিয়ে হেসে গেছে হাসি তার রেখে গেছে রে
মনে হলো আখির কোনে আমায় যেন ডেকে গেছে সে
আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ভাবতেছি তাই একলা বসে
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’’।।
গান শেষ হলো, তবু তেমনি বসে রইলো শূন্যের পানে স্থির অপলক দৃষ্টিতে যেন হারানো কিছু একটা খুঁজে ফিরছে। গানের রেশটা তখনো যেন কাটে নাই, কোনো কথা নাই। আজ মনে হয় সত্যিই তো সে গানের প্রতিটি কথা যেন মিলে গেছে জীবনের প্রতিটি ধারার সাথে আক্ষরিক অর্থেই।

কতগুলো প্রহর পার হয়েছিলো মনেও নাই, আমিও ডাকিনি। কিছুক্ষণ পরে নিজেই ঘুরে তাকালো, রোরুদ্যমান চেহারা নিয়ে। শান্ত সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে হয়তো বা কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করলো। দুই চোখ লাল হয়ে গেছে, এক অব্যক্ত বেদনায়। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করে বল্লো,
মনে আছে প্রথমদিন এই গান শুনে তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে,
তুমি কষ্টের গান গাও কেন? আমি কি বলেছিলাম তোমার কি মনে আছে?
বল্লাম, হ্যাঁ মনে আছে তুমি বলেছিলে, ‘ছোট ছোট কষ্ট সহ্য করতে পারলে পরে বড় কষ্ট সহ্য করা যায়’। বল্লো, সঠিক বলেছো তোমার দেখি সব মনে আছে।
অস্ফুট শব্দে বল্লো, আমাকে আর কখনো গান গাইতে বোলো না। তোমার সামনে গাওয়া প্রতিটা গানের সাথে যে তোমার সব স্মৃতি আমার সামনে এসে যায়। কেন আসে, অনেক দিন কারন খুঁজতে চেষ্টা করেছি পাইনি, তবে মনে হয় তোমার প্রতি আমার টানটা হয়তো বা অনেক বেশি হয়ে গেছে। যা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
তোমাকে আমি অনেক বুঝে ফেলেছি, তুমিও এখন সব কিছুর মধ্যেই আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করো। আর সেটা বুঝি বলেই কষ্টের মাত্রাটাও আমার বেশি। অনেক ব্যাপারেই যেন স্থবির হয়ে পড়েছি।

শেষের দিকে গলার স্বরটা ধরে এলো বল্লো, কারো জন্যে যে কষ্ট লাগতে পারে সেটা এখন অনুভব করছি, জীবনে কখনো তো এমন হয়নি তাই হয়তো বুঝিনি। এখন প্রতিনিয়ত: আমার এই কষ্টটা যেনও বেড়েই চলেছে, মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
হয়তো আমি আর গান গাইবো না গাইতে গেলে যে তোমার স্মৃতি চলে আসে, তোমাকে আশে পাশে খুঁজতে থাকি। কি মায়ায় যে বেধে ফেলেছো আমাকে? মাঝে মাঝে ভাবি তোমায় ছেড়ে থাকবো কেমন করে?
মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো হয়তো বা কষ্টটাকে আড়াল করতে! কিন্তু তাতে কি মনের আড়াল করা গেলো?
নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে, কি বলবো ভেবে পেলাম না, কষ্টতো আমারও লাগে সেটা বুলাকে কি করে বোঝাই!
বিদ্যুত ওর হাঁটা শেষ করে ফিরে এলো বল্লো, বেলা পড়তে শুরু করেছে চলো ঢাকার দিকে ফিরি।
বল্লো, পথে আবার একটু চা খেতে পারলে ভালো লাগবে। কি মনে করে কেন যেন দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকালো, হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছে। কিছুই বল্লো না, তবে আমি নিশ্চিত বুলার থমথমে চেহারা দেখে যা বোঝার ও বুঝে ফেলেছে বল্লাম, চলো ফিরে যাই।
(চলবে)
উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া