শারমীন শরীফ : “বেশি বা কম যাই হোক না কেন তখনকার মত সেটাই সত্যি, সেটাই স্বাভাবিক”- ড্যারেন ব্রাউন…আজ সকালে জুলাই ৮ ২০২২, ঘুম থেকে উঠে দেখি ইন্টারনেট নেই, অনলাইন ক্লাসে ঢুকতে পারছি না। ভাবলাম ফোনের ডেটা ব্যাবহার করে জুমমিটিংএ ঢুকে টিচারকে জানিয়ে দেই নেটের সমস্যার কথা। খেয়াল করলাম সেটাও কাজ করছে না। ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ কিছুই কাজ করছে না। প্যানিকগ্রস্থ হয়ে গেলাম। গ্রীষ্মের ছুটির কারণে ছেলে বাড়িতে এবং অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি তার তোয়াক্কা না করে হন্তদন্ত হয়ে ছেলেকে ডেকে তুললাম, ছেলেকে বললাম ফোন চেক করতে যে তার ফোন কাজ করছে কিনা কিন্তু ছেলে জানাল যে সেটাও কাজ করছে না। ততোক্ষণে ছেলের ঘুমও উবে গিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবছি কি হল, কি করব? ছেলের ধারণা যে আমাদের এরিয়াতে মোবাইল টাওয়ারে সমস্যা নিশ্চই, সাথে এও বলল যে ড্রাইভ করে একটু দূরে গিয়ে দেখা যেতে পারে অন্য টাওয়ার থেকে কানেকশন পাওয়া যায় কিনা। যেই কথা সেই কাজ, আমি বেরোবার জন্য রেডি হতেই ছেলে বলল সেও আসতে চায় আমার সাথে। দু’জন বেড়িয়ে কোন দিকে যাব ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিলাম সাউথের দিকে যাব। ইজলিংটন ধরে সাউথের দিকে যেতে আমার চোখ গেল লাইব্রেরির দিকে। দেখলাম অসংখ্য মানুষ লাইব্রেরির চত্বরে বসে ল্যাপটপ অথবা মোবাইল ঘাটছে যেটা একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য। আমি বুঝলাম যে বড় কোন ঘাপলা হয়েছে। গাড়ি ঘুরিয়ে লাইব্রেরির দিকে গেলাম। পার্ক করে চত্বরে ঢুকে ল্যাপটপ ঘাটা এক রমনীকে ‘আমাকে মাফ করবেন’ বলে জিজ্ঞেস করলাম যে নেট ঘটিত কোন সমস্যার কথা সে জানে কিনা, সে জানাল যে রজার্সের সার্ভিস ডাউন সারা দেশে। বুঝলাম যে ফাইডো যেহেতু রজার্সের অংশ তাই ফোনও কাজ করছে না। আমি লাইব্রেরীর ভেতরে হাটা ধরলে ছেলে মহিলাকে ধন্যবাদ জানাল, তখন আমার খেয়াল হল যে আমি নিজের ধান্দায় এতই অস্থির যে সামান্য ভদ্রতাটুকুও খেয়ে বসে আছি, আমি আবার ফিরে গিয়ে মহিলাকে ধন্যবাদ জানালাম। লাইব্রেবির ভেতরে ঢুকে দেখি অজস্র মানুষ সেখানে, সবাই যে যার ল্যাপটপ এবং ফোন নিয়ে ব্যাস্ত। আমি আমার ফোন কানেক্ট করতে চেস্টা করতে লাগলাম। ছেলে তার লাইব্রেরী কার্ড দিয়ে একটা খালি কম্পিউটারে খুঁজে নিয়ে লগইন করে ফেলল। সার্চ দিয়ে বুঝলাম যে সমস্যা সাধারণ নয় বরং বেশ সিরিয়াসই বলতে হবে। রজার্সের সার্ভিস ম্যাপ পুরোটাই লাল সারা দেশে।

অনেক ঝামেলা করে ফোন লাইব্রেরীর নেটে কানেক্ট করতে পারলাম। শুরুতেই জুমে লগইন করে টিচারকে জানালাম ঝামেলার কথা। সে জানাল, যেহেতু সে আমার মুখদর্শন করেছে সেহেতু সে আমাকে হাজিরা খাতায় ‘আছি’ বলে মার্ক করে দেবে এবং আমি আজকের জন্য মুক্ত বলে বিদায় দিয়ে দিল। আমি আরো খুব জরুরি কিছু কাজ সেরে নিলাম ফোনেই। ফোন কানেকশন কাজ করছিল না, মানে ইন্টারনেটে যোগ হলেও ফোনের মাধ্যমে কথা বলা যাচ্ছিল না। সকাল থেকে উদ্ভ্রান্ত হয়েছিলাম কিন্তু এই পর্যায়ে এসে মেজাজ খারাপ হল। ভীষণ অসহায় লাগতে শুরু করল। বাড়ি ফেরার সময় ছেলে ড্রাইভ করতে চাইলে আমি না করলাম না। গাড়িতে বসে ভাবছিলাম যে ভাগ্যিস বাড়িতে পাওয়ার আছে, অন্তত নাস্তাটা করতে পারব শান্তিতে এবং এককাপ গরম চা বানাতে পারব। সাথে সাথে ভাবলাম যে আমরা নিজের অজান্তেই কি ভাবে বিজ্ঞানের উন্নতির হাতে জিম্মি হয়ে গিয়েছি। শুধু ইন্টারনেট নেই বলে আজকে সবাই দিশেহারার মত ছোটাছুটি করছে। কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। ভাবলাম আজকে ছেলেটা কাছে আছে বলে আমি নিশ্চিন্ত, কিন্তু যখন সে কাছে থাকবে না দূরে চলে যাবে, হয়ত বা অন্য শহরে থাকবে তখন এমন হলে কি করব? একটা দিন, সারাদিন বা আরো বেশি দিন যদি সন্তানের সাথে যোগাযোগ করতে না পারি তখন কি দশা হবে? ভাবতেই কেমন করে উঠল বুকের ভেতর।

একটা সময় যোগাযোগের মাধ্যম ছিল শুধু চিঠি। দেশের মধ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চিঠি যেতে এক সপ্তাহ বা তার বেশি লাগত আর দেশের বাইরে হলে পনের দিন বা তারও বেশি সময় লাগত। বাবা মায়েদের যেন কত কষ্ট লাগত বা অস্থির লাগত সন্তানের মঙ্গল জানার অপেক্ষায়, একটি চিঠির অপেক্ষায়। নতুন বিবাহিত একজন স্ত্রী যার স্বামী অনেক দুরে কোথাও কাজের জন্য থাকতে বাধ্য হচ্ছে তারও যে কত কষ্ট হত, এ নিয়ে তো কবিতা, সিনেমারও অভাব নেই (চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও) এখন নেট নিয়ে কবিতা রচনা হয়। আবার এও ভাবি তখনকার সময়ে এটাই স্বাভাবিক ছিল বলে হয়ত তাঁদের মাইন্ডসেট টাও তেমনই ছিল। এখন আমরা চাইলেই সব পাই, সবই হাতের কাছে মজুদ, তাই দৈনিন্দিন জীবনে একটু ব্যাঘাত হলেই আমরা এলোমেলো হয়ে যাই, অস্থির হয়ে যাই। পুরোটাই অভ্যাস, পুরোটাই ব্রেইনের খেলা। আজকে হঠাৎ করে আমরা আবার যদি আদিম যুগে ফিরে যাই তাহলে আমরা কি হাল ছেড়ে দেব বা মরে যাব? নিশ্চয়ই নয়, আমরা সময়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করব। মনে পড়ে গেল ২০০৩ সালের কথা। আমি সবে মাত্র ক্যানাডায় এসেছি। মনে আছে অগাস্টের ৪ তারিখ সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে অন্টারিওবাসি আবিস্কার করল যে পাওয়ার নেই। সেই সপ্তাহে হিট এলার্ট ছিল। আধাদিনের মধ্যে সব মানুষ পাগল হয়ে গেল গরমে। বড় বড় মলগুলো জেনারেটর চালাচ্ছিল বলে অনেক মানুষ সারাদিনের জন্য মলে ঢুকে গেল। বাড়িতে রেফ্রিজারেটরের সব খাবার নস্ট হতে শুরু করল। রান্না নেই, খাবার নেই, গরমে অস্থির সবাই। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি আর আমি ভাবিলাম; এ কোন লোডশেডিং এর দেশে এলাম রে বাবা! সবাই ভাবছিল; এইতো পাওয়ার এলো বলে। পরে জানা গিয়েছিল যা পাওয়ার আসতে এক সপ্তাহও লাগতে পারে। মানুষ তখন সাথে সাথে বিকল্প ভাবতে শুরু করেছিল। অনেকে গাট্টিবস্তা বেঁধে অন্য শহরের উদ্দেশ্যে চলে গেল। বাজারে গ্যাসস্টোভ এবং গ্যাস সিলিন্ডার শূন্য হয়ে গিয়েছিল তখন কারণ সবাই তখন পিকনিক মোডে চলে গিয়েছে। এত অরাজকতার মধ্যেও জীবন চলছিল সুশৃংখল ভাবে। সবাই পরিস্থিতির সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছিল।

আমি তখন হ্যামিল্টনে থাকি এবং আমার ব্যাচেলর মামা সেখানে একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টের ১৪ তলাতে থাকতেন। সেই বিল্ডিং এ এলিভেটের জন্য এবং হলওয়ে আলোকিত রাখার জন্য জেনারেটর চালু ছিল, আমার বুদ্ধিমান মামা কেনেডিয়ান টায়ারে গিয়ে বিশাল লম্বা একটা এক্সটেনশন কর্ড কিনে আনলেন এবং রাত ১২টার পরে গিয়ে সেই কর্ড হলওয়ের পাওয়ার আউটলেটে লাগিয়ে দিয়ে আসতেন শুধু ফ্যানটা চালু করবার জন্য। দরজা জানালা সব খোলা শুধু একটু বাতাসের জন্য। মামা আমাকে ডেকে নিলেন তাঁর বাসায় কারণ আমি তখন দোতলায় ছোট্ট একতা ঘুপচি ঘরে থাকতাম, বাতাস ঢোকার তেমন কোন সুযোগ ছিলনা সেখানে। মামা আর আমি বারান্দায় গ্যাস স্টোভ জ্বালিয়ে মহা আনন্দে সারাদিন রান্নাবান্না করে খেয়ে দেয়ে টইটুম্বুর আর রাত হলে গরমে হাঁসফাঁস। মামার বাসার বারান্দায় অনেক কবুতর আসত। এরমধ্যে মামা একদিন বুদ্ধি করে কিছু ভাত বারান্দা থেকে ঘর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন। একটা বোকা কবুতর সেই ভাত খেতে খেতে ঘরের মধ্যে ঢুকে যেতেই মামা দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেটাকে ধরে, কেটে রান্না করে ফেললেন। মামা কত করে বলতেও আমি সেটা একটুও খাইনি। কবুতরটার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল। কি বিশ্বাস নিয়ে সে এসেছিল আমাদের কাছে কিন্তু সে তো জানে না যে মানুষ কত হিংস্র, স্বজাতিকেই সে ছাড় দেয় না আর সে তো আমাদের খাদ্য মাত্র। পাওয়ার আসতে পুরো ৪ দিন লেগেছিল আর ততদিনে আমরাও যেন সেটাকেই মেনে নিয়ে ইলেট্রিসিটি বিহীন জীবনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলাম।

আজ মনে হচ্ছে দিনটা অনেক লম্বা, ‘আমার দিন কাটে না, আমার রাত কাটেনা’র মত আবস্থা। বাসায় এসে নাস্তা খেয়ে মনে হল এখন কি করব? বই পড়লাম কিছুক্ষণ, মন বসল না, লিখতে বসলাম। মাথাটা এত এলোমেলো হয়ে আছে যে লেখাও বেরোচ্ছে না। মনে হল ভি সি আর থাকলে বেশ হল, বা সিডি, ক্যাসেট প্লেয়ার। কোনটাই নেই। কখন কি করে সব নেটে যুক্ত হয়ে গেল কে জানে। প্রেমিক, প্রেমিকাদের কথা ভেবে বেশ মন খারাপ হচ্ছিল, যারা ফাইডো ব্যাবহার করে তাদের সকালটা আজ মিষ্টি মধুর ‘গুড মর্নিং জান’ দিয়ে শুরু হয়নি বা ‘বাবু খাইছো’ বলতে পারবে না…আহারে! আজকে তারা হয়ত ভবিষ্যতের জন্য বিকল্পের প্ল্যান নিয়ে রাখবে অথবা আমার মত লাইব্রেরী বা স্টেপলসে দৌড়ে যাবে যোগাযোগের মাধ্যম খুঁজতে। হ্যাঁ ঠিক তাই, দুপরের পরে আমি অকারণে বাজার করতে চলে গেলাম, ওয়ালমার্টের নেট এত বাজে অল্প একটু বাজার করে যে রেগে বের হয়ে গেলাম। মাথায় এল স্টেপলসের কথা। ব্যাস সোজা সেখানে, ছেলের ফোন চার্জার প্রয়োজন, মনে হল সেটা আজ কিনলেই সব থেকে ভাল হবে। ভিড় খুবই কম সেখানে, আমার মত কয়েকজন নাছোড়বান্ধা মহিলা এক কর্ণারে বসে ফোন ঘাটছে বা ল্যাপটপ ঘাটছে। আমিও সাথে সাথে স্টেপলসের নেটে ঢুকে গেলাম এবং দেখলাম যে ওদের নেট অনেক ভাল কাজ করছে। ব্যাস সাথে সাথে আমার জরুরী ইমেইল এবং ফোন সেরে নিলাম। সময় নিচ্ছিলাম বলে ছেলে পেছন পেছন ঘ্যান ঘ্যান করে ঘুরছে বাসায় যাবায় জন্য। আমিও ধুত্তোরি বলে চার্জার কিনে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। বাসায় এসে যাই করছি অভ্যাসবসত ফোন হাতে, একবার ভাবলাম যে ফোন তো কোন কাজই করছে না তাহলে ঘোড়ার ডিমটাকে হাতে নিয়ে ঘুরছি কেন, ফেলে রাখলাম টেবিলে। পাঁচ মিনিট যাতেই ভাবলাম না থাক ফোনটা হাতেই থাক, কি কাজে আসবে কে জানে? দৌড়ে গিয়ে আবার হাতে নিলাম; কি এক আজব অভ্যাসে জড়িয়ে গিয়েছি আমরা! গাড়ি চালাতে চালাতে রেডিওতে শুনছিলাম যে হ্যামিল্টনের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সেখানের ক্যমিউনিটির লোকজনদের অনুরোধ করছে ৯১১ কল করে ফোন কানেকশন টেস্ট না করতে… does desperation has it’s own limits? I don’t think so! (চলবে)