রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
আটান্ন.
চতুর্দশ অধ্যায়
গভীর মূল্যবোধ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ফক্স অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করার আগে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি থেকে আমার অবসর গ্রহণের নির্ধারিত মাস ছিল জুন ২০১৯। আমার অবসর নেওয়ার একটা পূর্ব পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আশানুরূপ তেমন কিছুই ঘটেনি। এবিসি টিভিতে কাজ শুরু করার পঁয়তাল্লিশ বছর পার হতে চলল এখন আমি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি কাজের মেয়াদ আর বড়াতে চাই না।) না আমি শুধুমাত্র অবসর নিবার কাজেই ব্যাস্ত ছিলাম না শেষ বছরটিতে আমি কঠোর পরিশ্রম করছি এবং আমি আমার বাকী চৌদ্দ বছরের প্রধান নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন কালে নিজেকে যতটা দায়িত্বশীল মনে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল মনে হয়েছে। তার মানে এই নয় যে আমি আমার দ্বায়িত্বে অবহেলা করেছি বা কাজের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করিনি আমি আমার দ্বায়িত্ব পালনে সবসময়ই নিবেদিত প্রাণ। আামি বোঝাতে চেয়েছি আমি আটষট্টি বছর বয়সে এমন কর্মক্ষম থাকবো সেটা আগে কল্পনা করিনি। কাজের তীব্রতা আমাকে কখনও বিষণ্ণ করে তুলতে পারিনি বা আমার মনঃসংযোগে নষ্ট করতে পারিনি। কারণ একটা অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমার হৃদয়ের অনেক গভীরে গ্রথিত। শরীরে অত্যাধিক তাপমাত্র সত্বেও আমি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্মাণে নিমগ্ন আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে যখন আমি এখানে থাকবো না। আকস্মিকভাবে গোপনে মনের গহীন বন্দরে দৃষ্টিপাত করলে চোখের কোণায় দেখতে পাই আমার নতুন অবসরের তারিখ ডিসেম্বর ২০২১। আমাকে হতবাক করে চোখের কোনে ভেসে যায় অপ্রত্যাশিত সময় ডিসেম্বর ২০২১ । কিন্তু এটি আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এটি আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে এ যাত্রা শেষ হতে চলেছে। আমার প্রিয় বন্ধুরা কয়েক বছর আগে কৌতুকপূর্ণভাবে আমাকে একটি গাড়ির লাইসেন্স প্লেট উপহার দিয়েছিলেন যেটা আমি অনতিবিলম্বে আমার গাড়িতে সংযুক্ত করেছিলাম। যেখানে লেখাছিল, ‘ডিজনি ছাড়া কি জীবন আছে?’ উত্তর হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। কিন্তু প্রশ্নটি যে অর্থে ব্যাবহার করা হয় সেটি ছাপিয়ে আমার অস্তিত্ব সঙ্কট আমাকে আলোড়িত করে।
সা¤প্রতিক বছরগুলিতে আমি স্বস্তি পেয়েছি এবং আমার মনে আরও গভীর বিশ্বাস দানা বেঁধেছে যে একজন ব্যক্তির উপর খুব বেশি ক্ষমতা থাকা সবসময় ভাল নয়। এমনকি যখন একজন সিইও উৎপাদনশীল এবং কার্যকরভাবে কাজ করছেন তখনও। একটি কোম্পানির শীর্ষের পদগুলোতে পরিবর্তন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি না অন্য সিইও আমার সাথে একমত হবেন কিনা। তবে আমি লক্ষ্য করেছি যে আপনি একটি চাকরিতে বিশাল ক্ষমতাধর হয়ে উঠলে আপনার পক্ষে ক্ষমতার সদ্ব্যবহার আর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। শুরুতে ছোট ছোট বিষয় পরিবর্তন করার ক্ষমতা আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। ক্রমে আপনার আত্মবিশ্বাস মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে রূপ ধারণ করতে পারে এবং আপনার ক্ষমতা তখন ক্ষমতা না হয়ে দায়ে পরিণত হতে পারে। অনুভূত হতে পারে আপনি প্রতিটি মতামত শুনেছেন এবং আপনি অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন এবং অন্যের মতামত অস্বীকার করতে পারেন। এটি ইচ্ছাকৃত নয়, আপনার চেয়ার, পদবী আর ক্ষমতা আপনাকে এরকম মানুষে রূপান্তর করতে পারে। আপনাকে আপনার চারপাশের মানুষের মতামত শোনার জন্য যতœশীল হতে হবে। কে কী বলছেন সবার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। চারপাশের মানুষের মতামত শোনা আমি এক ধরণের সুরক্ষা হিসাবে বিবেচনা করি। আমি যে সকল নির্বাহীদের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি তাদের সাথে আমি সমস্যাটি আলোচনা করেছি। বলেছি, ‘আমাকে কখনও খুব উগ্র বা অধৈর্য মনে হলে অমাকে ফিডব্যাক দিবেন।’ তারা কখনও কখনও আমাকে ফিডব্যাক দেন কিন্তু আমি আশা করি এটা যেন তাদের অভ্যাসে পরিণত না হয়।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/07/Bk-10-1.jpg?resize=696%2C459&ssl=1)
এইরকম একটা বই লেখা এবং প্রকাশের কাজ করা সহজ কিন্তু বাস্তবে করে দেখানো মোটেই সহজ নয়। আমার মেয়াদে ডিজনির সমস্ত সাফল্যই আমার নিজেস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিখুঁতভাবে কার্যকর করার ফলাফল যা আমি প্রথম থেকে চিন্তা করেছিলাম। উদাহরণস্বরূপ তিনটি নির্দিষ্ট মূল কৌশলের উপর ফোকাস করা। আমরা যেখানে অধপতিত ছিলাম সেখান থেকে উঠে আসার জন্য অন্যদের নির্দেশনা গ্রহণের চেয়ে নিজেদের তৈরি করা কৌশল বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু আপনি আমাদের এই গল্পটিকে কেবল অতীতের ঘটনা প্রবাহ হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। আসলে কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেওয়ার তাগিদে আমাকে কোম্পানিটির একটা ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরী ছিল। আমি বিশ্বাস করি পণ্যের গুণগতমান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। আমি বিশ্বাস করি প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলোকে ভয় না পেয়ে নিত্য নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা দরকার। আমি বিশ্বাস করি নতুন বাজারের বিস্তৃতি অত্যাবশ্যক। এই কৌশল পত্রে ভর করে আমি যে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তখন আমার কোন বাস্তব ধারণা ছিল না ।
অভিজ্ঞতা ছাড়া নেতৃত্বের নীতি নির্ধারণ করা অসম্ভব কিন্তু আমার বেশ কয়েক জন মহান পরামর্শদাতা ছিলেন। যাদের আমি গুরু বলে মানি। প্রথমত মাইকেল এবং তার আগে টম এবং ড্যান এবং তাদের আগে রুন। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব পথ চলায় বিশাল দিকপাল ছিলেন এবং আমি তাদের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব তাদে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছি। এর বাইরে রয়েছে আমার বিশ্বাস ও প্রবৃত্তি। আমি আমার চারপাশের লোকদের সেগুলো বিশ্বাস করতে উৎসাহিত করেছি। অনেক পরে আমার সেই প্রবৃত্তিগুলো নেতৃত্বের বিশেষ গুণাবলীর রূপ ধারণ করতে শুরু করে। শুধু আমি এটুকুই বলতে পারি।
ডিজনির সিইও হিসাবে কাজে যোগদানের প্রথম দিনে সমস্ত কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে যে ই-মেইলটি লিখেছিলাম স¤প্রতি পুণরায় পড়লাম? সামনে এগিয়ে যাবার কৌশলপত্রের তিনটি স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এর সাথে লিখেছিলাম শৈশবে আমার দেখা ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অফ ডিজনি’ এবং ‘মিকি মাউস ক্লাব’ এর অভিজ্ঞতা। ছোট বেলায় আমি প্রায় ডিজনিল্যান্ডের দৃশ্যপট কল্পনা করতাম আর ভাবতাম দেখতে কেমন হবে ডিজনিল্যান্ড। কবে ডিজনিল্যান্ডে যাবো। আমি এবিসি টেলিভিশনে আমার প্রথম দিনগুলির কথা লিখেছিলাম। ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে প্রতিষ্ঠনটিতে কাজে যোগদানের পর আমি ভীষণভাবে নার্ভাস বোধ করছিলাম। আমি লিখেছিলাম, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবিনি একদিন এই কোম্পানিতে আমি নেতৃত্ব দেব। আমার শৈশবের স্মৃতির দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবো। অথবা আমার পেশাগত জীবন অবশেষে আমাকে এখানে নিয়ে আসবে।’
একভাবে চিন্তা করলে এখনও সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ এক অদ্ভুত বিষয়। জীবনের পূর্ণ বৃত্যান্তর দিকে আলোকপাত করলে জীবনের একটা পরিপূর্ণ অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। দিন যায় দিন আসে, এক পেশা থেকে অন্য পেশা, তার সাথে জীবনের পছন্দ আর প্রয়োজনগুলোও পাল্টে যায়। কিন্তু গল্পের সূত্র এক এবং অবিচ্ছিন্ন থেকে যায়। জীবন চলার পথে অনেক মুহূর্ত আসে যখন সবকিছু এলমেলো মনে হয় আবার সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললে আপনি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। অথবা আপনি সঠিক গুরু ধরতে পেরেছেন। বা আপনার কিছু ভালো প্রবৃত্তি আছে যা এটা না করে ওটা করতে বলেছে। আমি এ গল্পে যাব না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না কি পরিমান সফলতা ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল তবে আমি আমার চলার পথে অসাধারণভাবে ভাগ্যবান। পিছনে ফিরে তাকালে সবকিছু স্বপ্নময় মনে হয়।
ব্রæকলিনে নিজেদের লিভিংরুমে বসে ‘অ্যানেট ফানিসেলো’ এবং ‘মিকি মাউস ক্লাব’ দেখতো এক শিশু অথবা তার দাদা-দাদির সাথে তার প্রথম সিনেমা সিন্ডারেলা দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে অথবা নিজের বিছানায় শুয়ে ডেভি ক্রোকেট সিনেমা দেখার কয়েক বছর পর দৃশ্যগুলো মনের আয়নায় আবার দেখে নিচ্ছে। (ডেভিড ক্রকেট ছিলেন একজন আমেরিকান লোক-নায়ক, সীমান্তরক্ষী, সৈনিক এবং রাজনীতিবিদ।) সেই শিশুটি যখন বড় হল তখন তিনি নিজেকে খুঁজে পান এই সমস্ত ছবির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়াল্ট ডিজনির প্রধান নির্বাহী হিসেবে। মনে হচ্ছে একজন যাদুকর তার যাদুশক্তি ছু-মন্তর দ্বারা তাকে সেই আসনে বসিয়ে দিলেন।
আমাদের মধ্যে অনেকে যত বড় মানুষ হই না কেন বা যত বিশাল কিছু অর্জন করি না কেন, নিজেদেরকে তখনও একটা দীর্ঘ সময় আগের সেই ছোট্ট শিশুটি হিসেবে অনুভব করি। আমি মনে করি এটিই নেতৃত্বের কৌশল। আপনার চার পাশের পৃথিবী আপনাকে বলে আপনি অনেক ক্ষমতাবান এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তথাপিও আপনি নিজের সম্পর্কে জানেন এবং অবিচল থাকেন এটিই নেতৃত্বের আসল কৌশল। যে মুহূর্তে আপনি আপনার চারপাশের মানুষের কথা খুব বেশি বিশ্বাস করা শুরু করলেন আর নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখলেন আপনার কপালে একটা লেবেল লাগানো আছে, আপনাকে বুঝে নিতে হবে আপনি পথ হারিয়েছেন। এটি মন থেকে মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিন কিন্তু এটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পাঠ। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন এমনকি পথের ধারেও আপনার বসবাস হতে পারে কিন্তু আপনি সেই একই ব্যক্তি, একই মানুষ আপনি যেমনটি সবসময় ছিলেন। (রবার্ট ইগার এখানে গল্প বলা শেষ করেছেন। বাকী কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি গ্রন্থটিতে লিখেছেন সেগুলো তার লেখা দ্য রাইড অফ এ লাইফটাইম বইটিতে পাওয়া যাবে। সমাপ্ত।)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।