হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
বহু বছর ধরে আমি ঢাকাতেই চাকরি করছিলাম। একসময় বদলি হয়ে যাই খুলনা। একমাত্র বিদেশে ট্রেইনিং বা সেমিনারে আবস্থান করা ছাড়া ঢাকার বাইরে দীর্ঘসময় কখনও কোথাও থাকিনি। হেড অফিসের বড়কর্তা ও আর মাঝারি কর্তার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না বলে জেদ করেই খুলনায় বদলি নিয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম যে, নিজের পায়ে কুড়াল নিজেই মেরেছি। একইসাথে খুলনায় চাকরি করার ইচ্ছেটা মাথা থেকে উবে গেল। কী করি-কী করি করছিলাম। এইসময় বিধাতা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। আমার জাপান যাত্রার সুযোগ এসে গেল। ছয়মাসের ট্রেইনিং জাপানে। তারপর ছয়টি মাস আমার ভালোই কেটেছিল; শুধু ছেলে আর স্ত্রী’র কথা মনে পড়ত। উইকএন্ডে ফোন করতাম।
নিজকে মানিয়ে নিতে পারিনি খুলনায়। জাপান থেকে ফিরে এসে জয়েন করে তারপর কিছুদিনের ছুটি নিলাম। এরপর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। রেজিস্টার্ড পত্র পাঠিয়ে দিই খুলনা অফিসে। সুস্থ হয়ে ঢাকায় একটি পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে জয়েন করি। তারপর আমার কানাডা যাবার আগে দুই চাকরিতেই ইস্তফা দিই।
খুলনায় থাকাকালীন দু’টি প্যারানরমাল ঘটনা ঘটে (হয়তো প্যারানরমাল নয়; আমার মনের বিশেষ অবস্থার বহিঃপ্রকাশ)। এই দু’টি ঘটনা নিয়েই আমি গল্প রচনা করি। একটির নাম দিই ‘কায়া-ছায়ার খেলা।’ সেটি ত্রৈমাসিক প্রাঙ্গণ-এ ছাপা হয়েছিল। অন্যটির নাম ‘পোড়ো মানবের গল্প।’ সেটি ছাপা হয়েছিল চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মুখপত্র সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায়।
খালিশপুরে থাকি। সিরামিকের মনকাড়া স্থাপত্য শিল্পের একটি বাড়িতে। একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়িও ছিল চৌহদ্দিতে। তাতে থাকতেন বাড়িওয়ালা। আমার অফিস ছিল খালিশপুরেই, সেন্ট্রাল রোডে। বাড়িটার পেছন দিকটা জঙ্গুলে, একটা বিশাল পুকুর। তারপর রেলললাইন। আমি থাকতাম দু’তলায় বিশাল জায়গা নিয়ে, একা। মাঝেমধ্যে ভয় করত। তবে ততটা ভয় পেতাম না, আমার বেডরুম থেকে ডাক দিলেই বাড়িওয়ালা শুনতে পাবেন। তাছাড়া আমার নিচতলায় এক ভাড়াটে থাকতেন। বাড়িওয়ালা খালাম্মা আমাকে ¯েœহ করতেন। মাঝেমধ্যেই এটাসেটা রান্না করে আমার জন্য পাঠিয়ে দিতেন। আমার বেডরুমের একদিকের জানালার (প্রায়শঃই আমি দিক নির্ণয় করতে পারি না) কাছে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ, বাউন্ডারি দেয়াল, তারপর একটা পুকুর এবং কয়েকটি কুটির। অবসর সময়ে এই জানালার কাছে বসে পুকুরে হাঁসের সাঁতার কাটা দেখতাম। আমার বেডরুমটা বেশ বড়ই ছিল। ঠিক মাঝখানে ছিল নতুন বানানো একটা খাট। পাশে টুলের ওপর টেলিভিশন ও বক্সফ্যান। জানালার তাকে ছিল ছোটো ছোটো টবে ফুলের গাছ। আমি ছুটির দিনে বিছানায় শুয়ে হয় বই পড়তাম, নয়তো জানালার বাইরে তাকিয়ে নারকেল গাছে বাতাসের খেলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম।
সেদিনটায় এমনি আলস্যে-তন্দ্রায় নিমগ্ন ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কতক সময় ধ্যান আর সম্মোহনবিদ্যা চর্চা করেছিলাম। ধ্যানে আমি আলফা লেভেলে যেতে পারতাম, তারপর অটোসাজেশন দিয়ে আবার সচেতনভাবে বেটা লেভেলে ফিরে আসতে পারতাম। আলফা লেভেল হচ্ছে গভীর ঘুমের আগের স্তর। তন্দ্রার স্তর বলা যায়। ব্রেইন ওয়েভ বিবেচনায় ধ্যানের পাঁচটি স্তর: বেটা, আলফা, থিটা, ডেল্টা ও গামা। এই ৫টি স্তর নির্ধারণ করা হয় মস্তিষ্কের ওয়েভ সাইকেল অনুযায়ী। মানুষের মস্তিষ্কের কম্পন বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম হয়। বেটা, মানে জাগ্রত অবস্থায় এই সাইকেলের রেট সবচেয়ে বেশি (প্রতি সেকেন্ডে ১৩-৪০) আর ডেল্টা লেভেলে সবচেয়ে কম (প্রতি সেকেন্ডে ২/১ থেকে ৪)। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কারণে ব্রেইনের এই কম্পন মাপা হয় যে যন্ত্রে, তার নাম Electro Encephalograph বা সংক্ষেপে EEG.
অনেক সময় সচেতনভাবে আলফা লেভেলে গিয়ে আমি আর বেটা লেভেলে ফিরে আসতে চাইতাম না। তাতে অনেক উল্টোসিধে চিত্র দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম। বিষয়টা আপনাদের কাছে জটিল ও হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু আপনারা কেউ সচেতনভাবে ধ্যানমগ্ন হবার সামান্য বিদ্যাটা প্র্যাক্টিস করতে সক্ষম হলে আপনাদের কৌতুহল বা সন্দেহ নিবৃত্ত হতে পারে।
আমি সাধারণত নারকেল গাছঘেরা জানালার দিকে পা দিয়ে ঘুমাতাম। আমার বাম দিকে ছিল আরেকটি জানালা, বাড়িওয়ালার যেদিকে। আমার এভাবে শোয়ার কারণ হলো, তাতে করে দুইদিকের জানালার দিকেই নজর রাখতে পারতাম। আমি সাধারণত শীতের সময়ও জানালা খোলা রেখে ঘুমাই, যাতে সাফোকেটেড না হই। শুয়ে থাকলে আমার পায়ের দিক থেকে জানালাটা তখনও অন্তত এক হাত পরিমাণ উঁচুতে থাকে। ধ্যানমগ্নকালীন আমি চিৎ হয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি (ধ্যানের সময় কিছু একটাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার জন্য ফ্যানের গোল অংশের ঠিক মাঝখানের সোনালি ক্যাপের দিকে মনোসংযোগ করি)। অন্যসময়, স্বাভাবিক ঘুমে সাধারণত কাত হয়ে ঘুমাই। সেদিন দুপুরে আমি আলফা লেভেলে আজব সব ব্যাপার ঘটে যেতে দেখলাম। দেখলাম একটা অমানবিক মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দিনের বেলাতেও এতই ভয় পেলাম যে চমকে গিয়ে আমার চোখ পড়ল জানালায়। দেখলাম সত্যিই কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখটা একটা বুড়ো মানুষের মতো। কালচে মুখের কুতকুতে দুই চোখ কেমন ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে আছে। আমি সংবিৎ ফিরে পেতেই সেটা নড়ে উঠল। তারপর মুহূর্তেই অদৃশ্য হলো। দ্রুত জানালার কাছে গেলাম। অবিশ্বাস্য গতিতে সেই ‘বুড়ো লোক’-কে চলে যেতে দেখলাম। প্রথমে তাকে দেখলাম বাউন্ডারি দেয়ালে, সেখান থেকে বাড়িওয়ালার টালির ছাদে। তারপর তাকে দেখলাম একটু দূরে পাশের একটি এনজিও অফিসের তিনতলায় সর্বোচ্চ সানশেডে। এবার বুঝলাম, এটা একটা জলজ্যান্ত হনুমান! ইতোমধ্যে তাকে ঘিরে রাস্তা থেকে নানা বয়সের মানুষের হৈ-হল্লোড় উঠল। সে আমার জানালার সানশেডে ভর করে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর আমাকে দেখছিল। কিন্তু কথা হলো তাকে আমি দেখলাম কেমন করে! সচেতন হওয়ার বহু আগে থেকেই তাকে দেখছিলাম। জানালার দিকে তো তাকিয়ে ছিলাম না!
পরদিন শুনলাম হনুমানটা ধরা পড়েছে। সে বোধহয় চিড়িয়াখানা থেকে কোনোভাবে পালিয়ে এসেছে কিংবা হতে পারে সে কেশবপুর থেকে অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করে তারপর এসে পৌঁছেছে খালিশপুরে। হতে পারে। কারণ কেশবপুরে তাদের বাসস্থান আর খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছে। শুনেছিলাম একবার একটা হনুমানকে কেউ একজন লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল সেই হনুমানটি সেই ব্যক্তির খাবার কেড়ে নেয়ায়। এরপর একটা গোদা হনুমানের নেতৃত্বে একদল হনুমান কেশবপুর থানায় এসেছিল সেই লোকের বিরুদ্ধে নালিশ করতে!
আমার পরের প্যারানরমাল অভিজ্ঞতাটি আরো ভয়ঙ্কর। তখন খালিশপুরেরই আরেকটি বাসায় ভাড়া থাকি। কম ভাড়ার বাসা। দোতলা পুরোনো বাসার দোতলায়। সামনের দিকটায় বাড়িওয়ালা থাকতেন তার পরিবার নিয়ে আর পেছন দিকে থাকতাম আমি। সেটা প্রচণ্ড শীতের রাত্রি ছিল। বরাবরের মতো জানালা খুলেই ঘুমিয়েছি। মশারি টানিয়ে, তারপর তিনটি কাঁথা গায়ে দিলাম (কাঁথা সরে যায় বলে দু’টি দিলাম গায়ে, একটি ভাঁজ করে পায়ের ওপর দিলাম)। আলসেমি করে লেপ কেনা হচ্ছিল না। গভীর রাতে স্পষ্ট টের পেলাম এবং অনুভব করলাম আমার পায়ের কাঁথাটা কে যেন নিচের দিকে টেনে নিচ্ছে। সে অবস্থাতেও বুঝতে চেষ্টা করলাম সত্যিই আমার পায়ের ওপর থেকে কাঁথাটা সরে যাচ্ছে কিনা। যাচ্ছিল। এরপর ভয় পেলাম। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাইনি কারণ আমি স্বল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাতে ঘুমাতাম। তাছাড়া জানালা দিয়েও অন্য কোনো একটা বাসা থেকে বিদ্যুৎবাতির আলো আসছিল ঘরে। একসময় ঘোর কাটিয়ে তড়াক করে উঠে বসলাম। তারপর খাটের তলা, বাথরুম, ঘরের আনাচেকানাচে, সিমেন্টের তাকে সর্বত্র চোখ বুলালাম। কোনোকিছুই চোখে পড়ল না। সেরাতে আর ঘুমোতে পারিনি। বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলাম লেখালেখি করে। পা থেকে কাঁথাটা সরে যাবার সময় দুই পায়ে শিরশিরানি অনুভব করেছিলাম।
সেই শিরশির ভাব আজও অনুভব করি দুই পায়ে!