অনলাইন ডেস্ক : আততায়ীর হামলায় গুরুতর আহত হয়ে অবশেষে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন জাপানের ৬৭ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, দেশটির ইতিহাসে যার সবচেয়ে দীর্ঘসময় গণতান্ত্রিকভাবে সরকারপ্রধান থাকার রেকর্ড ছিল।

শুক্রবার সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে জাপানের নারা শহরে এক নির্বাচনী প্রচার সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় আবেকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়, সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে যান তিনি। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

তার কিছুক্ষণ পর দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা জানান, আবের অবস্থা সংকটাপন্ন এবং চিকিৎসকরা তার জীবন বাঁচাতে লড়ছেন। তারও কয়েক ঘণ্টা পর জাপানি গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর আসে।

২০২০ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে শিনজো আবে জাপানের সরকারপ্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়া ফুমিও কিশিদা শুক্রবারের এই হামলাকে ইতোমধ্যেই ‘চুড়ান্তভাবে ক্ষমার অযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

জাপানের অর্থনীতিকে আরও দৃঢ় করা এবং দেশটিকে শক্তিশালী সামরিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া আবে একদিকে যেমন গণতান্ত্রিকভাবে দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘকালীণ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে সবচেয়ে কম বয়সে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ডটিও তার দখলে। ২০০৬ সালে যখন প্রথমবারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন, তার বয়স তখন ৫১ বছর।

জাপানের একটি ইস্পাত কারখানার কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা আবে জাপানের পার্লামেন্ট সদস্য হন ১৯৯৩ সালে। সে সময় তার বয়স ছিল ৩৯ বছর।

ওই বছরের নির্বাচনে জাপানের ইয়ামাগুচি প্রদেশের নাগাতো আসনে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন ১৯৫৪ সালে টোকিওতে জন্ম নেওয়া আবে।

জাপানের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া শিনজো আবের নানা নবুসুকে কিশিও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন জাপানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্যতা ও প্রতিরক্ষা সহায়তা চুক্তির জেরে দেশজুড়ে শুরু হওয়া প্রবল জনবিক্ষোভে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন নবুসুকে কিশিও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে মার্কিন বাহিনীর পারমাণবিক বোমা হামলার ক্ষত তখনও ভুলতে পারেনি জাপানের জনগণ।

শিনজো আবের রাজনৈতিক জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তার নানার গভীর প্রভাব দেখা যায়। মাতামহের মতো তিনিও রক্ষণশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন এবং আজীবন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত মিত্র ছিলেন।

জাপানের সফলতম প্রধানমন্ত্রী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের সবচেয়ে কম বয়সে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়া আবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত তার ‘সিগনেচার তত্ত্ব’ অ্যাবেনোমিক্সের জন্য। জাপানের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যেসব নীতি তিনি নিয়েছিলেন, সেসবই আবেনোমিক্স নামে পরিচিত।

২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে মন দেন তিনি, পাশপাাশি গুরুত্ব দেন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শক্তিশালী করতেও। দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ওই বছর জাপানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিরও (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট হন তিনি। অবশ্য শারীরিক অসুস্থতার জন্য এক বছর পরই তাকে প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়।

পদত্যাগ করার পর জাপানের একটি সাময়িকীতে লেখা নিবন্ধে আবে বলেন, ‘যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে—আবে প্রশাসনের উদ্যোগে রক্ষণশীলতার যেসব আদর্শের উত্থান ঘটেছিল, আমার পদত্যাগের ফলে সেসব ফিকে হয়ে যাবে কি না।’

‘জাপানে রক্ষণশীলতার শেকড় যেন আরও বিস্তৃত হতে পারে, সে লক্ষ্যে এখন থেকে একজন নিবেদিতপ্রাণ আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে যাব আমি।

২০১২ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আবের দল জয়ী হয়ার পর আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। তার দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ‘আবেনোমিক্স’ বা ‘আবেতত্ত্ব’ দেশটির অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করবে বলে ফের দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসেন।

তারপর উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত আগ্রাসী ভাব, দেশের অর্থনৈতিতে ধস, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নিয়ে জনগণের অসন্তোষে আবের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হয়ে পড়লে ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং আবারও বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফেরেন।

মূলত আবের আমলেই জাপানের প্রতিরক্ষা খাত এক প্রকার নবজীবন লাভ করে। তিনি এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দেশের সামরিক সক্ষমতার বিকাশে পদক্ষেপ নেন।

তার ফলাফলও পাওয়া যায় হাতেনাতেই। আবের আমলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জাপান দেশের বাইরে যুদ্ধ করার ও মিত্র কোনো দেশ আক্রান্ত হলে তাদের সুরক্ষায় সেনা পাঠানোর বিষয়টির অনুমোদন করে।

অবশ্য দেশের সামরিক বাহিনী নিয়ে আবের যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ছিল আবের। তিনি চেয়েছিলেন দেশের সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ বদলে জাপানের প্রতিরক্ষাবাহিনীকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পূর্ণ শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে রূপান্তর করতে। সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন তিনি।

টোকিওতে অলিম্পিক গেইমস নিয়ে আসার মূল কারিগরও ছিলেন তিনি। কোভিডের কারণে ওই গেইমস ২০২০ সালের বদলে ২০২১ সালে হয়, দূর্ভাগ্যজনকভাবে তখন আবে আর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন না। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের মাঝামাঝিই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভূমিকা
প্রতিবেশী দেশ উত্তর কোরিয়ার প্রতি তেমন সদয় ছিলেন না আবে। কয়েক দশক আগে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে জাপানি নাগরিক অপহরণের ঘটনা তার প্রধান কারণ। তবে উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান তাকে দেশজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।

আবার চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চাইতেন তিনি, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস।

চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকে নিয়ে কোয়াড এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি) গঠন ও বিকাশেও আবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেও রাজনীতি থেকে অবসর নেননি আবে; এবং কেবল দলের বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও প্রচারণাতেই নয়, সমসাময়িক বৈশ্বিক নানান বিষয় নিয়েও গণমাধ্যমে নিয়মিত বক্তব্য রেখেছেন তিনি।

ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চালানোর পর জাপানের টেলিভিশনে করা এক মন্তব্যে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী জাপানে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র রাখার বিষয়টি টোকিওকে ভেবে দেখতে বলেছিলেন। তার ওই বক্তব্য চীন ও অন্যান্যদের ব্যাপক ক্ষুব্ধও করেছিল।

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব
জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘকালীণ প্রধানমন্ত্রী আবে ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেও ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (এলডিপি) আবে। দলটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনও তারই নিয়ন্ত্রণে।

আবের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা রোববার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ভালো ফল আশা করছেন; তেমন ফল হলে তা তাকে আবের ছায়া থেকে বের করে আনতে ও নিজের প্রধানমন্ত্রীত্ব পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করবে বলে ভাষ্য বিশ্লেষকদের।

রোববারের নির্বাচনে এলডিপির এক প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানাতেই নারা গিয়েছিলেন আবে।

তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোনার পরপরই কিশিদা তার নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত ঘোষণা করে টোকিও চলে যান বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।

জাপানে বন্দুক সহিংসতা বিরল হলেও আবের ওপর এই গুলির ঘটনা জাপানকে ‘চিরদিনের’ মতো বদলে দেবে বলে অনুমান নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।

সূত্র: রয়টার্স