বিদ্যুৎ সরকার : “সারা দিন কুত্তার মতো দৌড়াইয়া আর, শুয়োরের মত গতর খাইট্টা কোন রকম বাইচ্চা আছি।” না, এটাকে কোনভাবেই বেঁচে থাকা বলা যায় না। বড় জোর বলা যেতে পারে – টিকে আছে। বেঁচে থাকাটা হলো একটি সামগ্রিক বিষয়। ধুন ফুন করে খেয়ে না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে চিত হয়ে শুয়ে থাকলে সেটাকে আর যাই বলুক অন্তত বেঁচে থাকা বলাটা সমিচীন নয় কিছুতেই। সেই ভোর না হতেই দোকানের ঝাপ উঠাও, চায়ের চুলা ধরাও, পানি গরম হলে কাপ-প্লেট ধুয়ে থালায় সাজিয়ে রাখো, টোস্ট, খাস্তা বিস্কুট, মুড়ি হাতের কাছে রাখা চাই। সুরুইজ্জা আসতে আসতে রোদের উত্তাপ বেরে যাবে ঢের। এরই মধ্যে সকালের প্রথম দফা চা-পানের আসর মোটামুটি শেষ হয় আমার।
দ্বিতীয় দফা শুরু হয় উঠতি, পাতি স্বঘোষিত মাস্তান স¤প্রদায়ের কল্যাণার্থে। ছোলা-মুড়ি, কলা-ব্র্যাড, সিদ্ধ ডিম তাদের ফার্স্ট চয়েস তারপর এক কাপ গরম চা। বিনিময় মূল্য একগাল হাসি, আর বাকীর খাতায় কলমের আঁচর।
চুলার ধোঁয়া, নিজের ধোঁয়া মিলে চোখে অন্ধকার দেখে রহমত মিয়া। তবুও কষ্ট করে চালিয়ে যেতে হবে এ ব্যবসা। ঘরে একটা নতুন বৌ, মুখে কিছু না বললেও অন্তরে তো বাজে। এইতো কিছুদিন আগে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা হয়ে গেল দিঘির পারে, ফুল বানুরে কিছুই দিতে পারেনি। হাতে দু’গাছি রেশমি চুরি, কপালের টিপ, চুলের ফিতা আর খাবারের দোকান থেকে খাজা, গজা আর বিন্নি ধানের খৈ। অবশ্য মিষ্টির দোকানে বসে পেট ভরে হরেক রকমের মিষ্টি খাইয়েছে রহমত। ইচ্ছে ছিল একটি শাড়ি কিনে দেয়ার কিন্তু ট্যাকের টাকায় কুলোয়নি। সাধ আছে সাধ্য নাই, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবুও পিছু হটার লোক না রহমত। আস্তে আস্তে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে চায়। সে জানে একদিন তার এ ছোট দোকান বড় হবে, মালা মালে ভরে যাবে চতুর্দিক। বৌকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারবে, এটা ওটা কিনে দিতে এতোটা কষ্ট হবে না আর তার।
সুরুইজ্জা এসে কাজে হাত লাগায়। সকাল থেকে জমে থাকা এটো কাপ-প্লেট, গ্লাস-বাটি ধুয়ে সাজাতে থাকে পুনরায় ব্যবহারের জন্য। এদিকে রহমত মিয়া নতুন করে বোয়াম, ডিব্বায় খাবার দাবার ঢুকিয়ে ক্যাটলি ও সসপেনে চা আর দুধ জ্বাল দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর থেকেই বয়স্ক মুরব্বিদের আসর, তাদের চা আর কুকিজ বড়জোড় বনরুটি তাদের মূল চাহিদা। চলে রাজনীতির রাজা-উজির মারা, চেংড়া পোলাপাইনদের গুষ্টি উদ্ধারের কাজ। মাঝে মাঝে রহমত মিয়া সুযোগ থাকলে তাদের আলোচনায় যোগ দেয়। রহমত মিয়ার সুখ লুকিয়ে আছে মানুষের ভালোবাসায় আর বৌয়ের সান্নিধ্যে। কিন্তু ভালোবাসার ভালোলাগা সময় কই তার? সাত সকালে নাকে-মুখে কিছু দিয়ে ‘জন বেনসন’র মত দৌড়। এরে খাওন কয় না, বৌয়ের সোহাগের দাম দেয়া আর কি। বৌ দুপুরের খাওয়া একটা গামছার মধ্যে সযতনে বেঁধে দেয়। এর মধ্যেও যেন লুকিয়ে আছে ভালোবাসার অটুট বন্ধন। পরন্ত বেলায় দোকানের কাস্টমারের ভীড় কম থাকে তখনই রহমত মিয়ার উদর ঠান্ডা করার সময়। সুরুইজ্জা সকালেই এ কাম শেষ করে দোকানে আসে। দুপুর, বিকেলে খিদা লাগলে কলা-রুটি বা মুড়ি খেয়ে চা খায়। অবশ্য সন্ধ্যার পর পরই বাড়িতে চলে যায় সে, রহমতের যেতে রাত অনেক গড়ায়। সব কিছু গুছিয়ে তবেই না তার যাওয়া। আজ একটু আগে ভাগেই যেতে হবে। আজ তাদের বিয়ের দু’বছর পূর্ণ হবে রাত বারোটায়, এ দিনটির কথা সে ভুল করেও ভুলে যায় না। গেল হাঁটে বৌয়ের জন্য একটি টাঙ্গাইল সাড়ি কিনে এনে দোকানে রেখে দিয়েছিল আজ দিবে বলেই। চটের ব্যাগের মধ্যে অন্যসব প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে সাড়িটিও নিতে ভুল করেনি সে।
রহমত মিয়ার পায়ের আওয়াজ ফুল বানুর চেনা, তাই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে চটের ব্যাগটা নিয়ে যথা স্থানে রেখে দেয়। রহমত মিয়ার কাছে ফুল বানুর এ হাসির দাম লাখ টাকা। তবে আজকের হাসি তার কাছে আরও দামী মনে হলো। আজ তো তাদের বিয়ের দু’বছর পূরণের দিন। হাতমুখ ধুয়ে দু’জনে খেতে বসে। আজ ফুল বানু ভাল-মন্দ কিছু রান্না করেছে নিশ্চয়ই। ঘরের জন্য যা যা প্রয়োজন তা ফুল বানু ঘরে বসেই কিনে নেয় ফেরিওয়ালার কাছ থেকেই। এমন কি মাছ, তরিতরকারি সবকিছুই ঘরে বসেই মিলে যায়। এ জন্য প্রতি সপ্তাহে ফুল বানুর হাতে কিছু টাকা দিয়ে রাখে রহমত মিয়া। এতে করে তাকে এ দিকে খুব একটা নজর দিতে হয় না। রাতের খাওয়া শেষ করে দু’জনে মিলে সব গুছিয়ে শোওয়ার আয়োজন করতে গিয়ে রহমত মিয়া তো হতবাক! ফুল তোলা নতুন দু’টি কভার দিয়ে শোয়ার বালিশগুলো ঢেকে দিয়েছে ফুল বানু। শুধুই কি তাই, শিয়রের পাশে সুন্দর একটি নকশি কাঁথা – শুধুই অবাক হবার পালা রহমত মিয়ার। এসব কিছু ফুল বানুর মায়াবী হাতের পরশে বিকশিত। ভালোবাসার অনুপম ছোঁয়ায় রহমত মিয়া ফুল বানুকে কাছে টেনে নেয়। আদরে আদরে তাকে আজ ভরিয়ে দিতে চায়। চটের ব্যাগ থেকে নতুন শাড়িটা বের করে ফুল বানুর হাতে তুলে দিতে দিতে বলে, “তোমাকে আমি মন মত কিছুই দিতে পারি নাই, এমন অবস্থা আর বেশি দিন থাকবো না, একদিন আমাগো সব হইবো দেইখা নিও।” ফুল বানু কিছুই বলে না, মাথা নিচু করে চুপ হয়ে থাকে। মশারীর মতো চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। হারিকেনের আলো কমিয়ে রহমত নকশি কাঁথাটা টেনে অর্ধেক নিজ গায়ে জড়িয়ে নেয়। ফুল বানুকেও শুয়ে পড়তে বলে। শুয়ে শুয়ে রাজ্যের কথা মনে পড়ে যায় দু’জনের। সেই প্রথম ফুল বানুকে দেখতে যাওয়া অতঃপর বিয়ে, বিয়ের প্রথমদিকের দিনগুলোর স্মৃতি। দিন-মাস গড়িয়ে এক বছর এবং আজ দু’বছরে পা রাখলো। কেমন করে দিন চলে যায়, মাস যায় কিন্তু ফুল বানুর প্রতি মনের টান বিন্দুমাত্র কমে নাই।
নকশি কাঁথার বাকী অংশে ফুল বানুকে জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। ফুল বানুও আদুরে বাহুডোরে রহমত মিয়াকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়। রহমত মিয়া ফুল বানুর বুকের ভাজে ভালোবাসার ওম খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ বলে উঠে, “বৌ তোমার বুকের মাঝে খালি মহুয়া ফুলের গন্ধ পাই কেন্। মহুয়ার গন্ধ যে পাগল হইয়া গেলাম। কি আতর মাখলা তোমার বুকের মাঝে?” ফুল বানু জবাব দেয়, “কি যে কও, আতর পামু কই? আমার গায়ের গন্ধ হইলে হইতে পারে।” গন্ধের উন্মাদনায় রহমত মিয়া আরও শিহরিত, রোমাঞ্চিত। ফুল বানুর শরীরের ভাজে ভাজে বুঝি মহুয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে নিমেষেই। পরস্পরের শরীর এখন উত্তাপে তাপিত। রহমত বলে, “বৌ তোমারে আমি কিছুই দিতে পারি নাই এই দুই বছরে শুধু, ভালোবাসা ছাড়া।” ফুল বানু উত্তরে বলে, “তুমি আমাকে যা দিছো তাতেই আমি অনেক খুশি। শুধু একটা জিনিস চাইয়া নিমু তোমার কাছ থাইকা।” “কও তুমি, কি চাও, আমার সাধ্যমত দিতে চেষ্টা করুম।” আমারে একটা সন্তান দিবা? আমার আর কিছু চাই না।” সত্যিই তো তার এ চাওয়া মোটেও অমূলক নয়। এক এক করে দু’বছর কেটে গেল অন্তত একটি সন্তান তো তার প্রাপ্য। এতে তো শুধু ফুল বানুর নয় রহমতেরও তো সুখের বিষয়টি নিহিত। রাতের সুখময় স্মৃতি আর ভোরের আলোকোজ্জ্বল স্বর্ণালী রোদ জানান দিয়ে যায় সুখ আসছে সুখের রথে চড়ে। ফুল বানুর বারান্দায় ঝলমলে রোদ্দুর। আয়নায় এতোদিন নিজের যে মুখ দেখে অভ্যস্ত আজ কেমন করে বদলে গেল যেন – উচ্ছল, উজ্জ্বল, মুখে অমলিন হাসি।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা