ঋতু মীর : “A teacher takes a hand, opens a mind and touches a heart”
১।
জানালার তাকে বসে করছ কি তুমি? নিজের জায়গায় চেয়ারে বস এক্ষুনি! ক্লাশে ঢুকেই ছেলেটাকে দেখে গলার স্বর চড়িয়ে নির্দেশ দেয় সত্যবতী। শুনেও না শোনার ভান করে নির্বিকার পা দোলাতে থাকে ছেলেটা। মুখে চুইং গাম চিবুনোর চপচপ শব্দ করে দুস্ট হাসিতে মাথা দোলায়। নিয়ম বহির্ভূত অবাধ্য আচরণে সত্যবতীকে ইরিটেড করার চেষ্ট্যা বরাবর সে পারদর্শী। ‘জানালার তাকে বসা যাবে না কেন’ ছেলেটার সাথে এই ধরনের সময় নষ্ট করা আর্গুমেন্ট করতে গিয়ে ক্লাশ লেসনের অনেক মুল্যবান সময়ই বিফলে যায় সত্যবতীর। Visual, kinesthetic শিক্ষার্থী হওয়াতে ওর হাত, পা, চোখ, মুখ চলে তড়িৎ গতিতে। আর্গুমেন্ট করতে করতে টিচার্স ডেস্ক এরিয়ার কাছে চলে আসে ছেলেটা। চোখের পলকে কম্পিউটার, মোডেম, ইন্টারনেট কানেকশন তার টান দিয়ে খুলে ‘স্মার্টবোর্ড’ অন্ধকার করে ‘ভার্চুয়াল ক্লাশ’সহ গোটা লেসনের বারোটা বাজিয়ে ভেজা বেড়াল ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসিতে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে সত্যবতীকে। ভাবখানা- আমি যে এই কাজ করেছি তার প্রমান কোথায়? সেই মুহূর্তে রাগের উত্তাপ মনের আকাশে ছড়াতে না দিয়ে self regulation skill-টা প্র্যাকটিস করে সত্যবতী। নিজের টেবিলের সামনে restricted area নোটিশ সেঁটে দিয়ে সরাসরি ছেলেটার ডেস্কের পাশে চেয়ার টেনে বসে সে। Special Education Resource Teacher (SERT) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্যবতীকে প্রচণ্ড বিহেভিয়ারাল এবং চ্যালেঞ্জিং এই ক্লাস সামলাতে প্রতিদিনই অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। ক্লাসের প্রতিটা শিক্ষার্থী IEP- অর্থাৎ individual learning plan এর আওতায় । আচরণে নানা ভিন্নতা, নানারকম সীমাবদ্ধতা বিশেষতঃ learning disability-র মত প্রতিবন্ধকতায় এই শিক্ষার্থী সীমাবদ্ধ।
Responsibility, Collaboration, Self regulation, Organization, Initiative এর মত লার্নিং স্কিলগুলোকে হাইলাইট করে বিষয় ভিত্তিক পাঠে এইসব শিক্ষার্থীকে চালিত করাই কোর্স প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। রিসোর্স টিচারের দায়িত্ব পালন সত্যবতীর কাছে নতুন নয় যদিও তারপরও এই বছরের এই ক্লাসটি স্ট্রেস লেভেল হাই হওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানা ক্লাসরুম ইস্যুর ঝড়ঝাপটা সামলেই পার করতে হচ্ছে। স্কুল ইয়ার এখন প্রায় শেষের পথে। কালমিনেটিং এসাইনমেণ্ট, মারকিং, রিপোটিং, ক্রেডিট রেসকিউ, ক্রেডিট রিকভার বিষয়গুলো নিয়ে সব শিক্ষকেরই নিজ নিজ ক্লাশে বেশুমার ব্যস্ততা। গ্রীষ্মকালীন লম্বা ছুটির সাজ সাজ রব স্কুলের ক্লাশে, করিডোরে। ছাত্র শিক্ষকসহ সবার চোখে মুখেই আসন্ন ছুটির আয়েশি ভাব। ঠিক এই সময়ে ক্লাসে কোন অযাচিত ইস্যু তৈরি হোক মনে প্রাণে তা চায়না সত্যবতী।
২।
কণ্ঠ স্বরে অনুরোধের ঢেউ খেলিয়ে সত্যবতী ছেলেটাকে বলে- নেমে বসতো! আজ কিন্তু ক্লাশে ইয়ার এন্ড পার্টির জন্য প্রোগ্রাম করবো আমরা। গুগল ক্লাশ খুলতে বলে ‘ইভেন্ট প্ল্যানিং’ এসাইনমেন্টের কাজ কতটা এগিয়েছে তা দেখাতে বলে। আমার chromebook ভেঙ্গে গেছে- বলে সেলফোনে মনোযোগে গেম খেলতে থাকে ছেলেটা। ‘দুর্বৃত্তের ছলের অভাব নেই’ জানে সত্যবতী। ঠিক আছে ডেস্কটপ কম্পিউটার তো আছে। আমার সাথে বসে এক্ষুনি এই এসাইনমেন্ট শেষ করবে তুমি! ওকে! ওকে! আমার কাজ প্রায় শেষ ম্যাম! দুর্বিনীত ভঙ্গি ছেলেটার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সত্যবতী। ক্লাশে বসে কোন কাজ ইন্ডিপেনডেন্টলি শেষ করতে পারার মত attention span যে ওর নেই মোটেই! অধিকাংশ কাজই বাসায় মায়ের সাহায্য নিয়ে করে কোনমতে জমা দেয়। অলিখিত সন্তান স্নেহে কখনও মা নিজেই কাজটা করে দিয়ে পুলসেরাত পার করে। টের পেয়ে উপায়হীন সত্যবতী ওর জন্য in-classs assignment’ এর ব্যবস্থা করে। ইভেন্ট প্ল্যানের কাজটাও সেই উদ্দেশ্যেই করা। আচ্ছা! সবচেয়ে আগে দেখি- তোমার প্লানিং গোল বা উদ্দেশ্য কি? জানোতো ! আমাদের সামনে যখন ‘goal’ নির্দিষ্ট এবং পরিস্কার থাকে তখন লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক সহজ হয়। শিক্ষকতার মজ্জাগত উপদেশে ব্যস্ত হয় সত্যবতী। ছেলেটি ঠিক কতোটা শুনে বা আদৌ শুনেই কিনা তা বুঝে উঠতে পারে না সত্যবতী। ‘I want to make my mom happy- that is my goal’! সাদাসাপটা এই ঘোষণায় বিস্ময়ে চমৎকৃত হয় সত্যবতী। তুমি যদি আমার এই goal পছন্দ না কর তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। তুমি আমার মাকে ফোন করে আমার সম্পর্কে অভিযোগ করে তাকে মনোকষ্টে ফেলেছো। আমাকেও বাসায় অনেক ঝামেলায় ফেলেছো। আমি কিন্তু তোমাকে একটুও পছন্দ করিনা মিস! এ আবার কোন আর্গুমেন্ট শুরু হয়ে গেল- চিন্তিত হয় সত্যবতী। মনে পড়ে- প্রথম দিনেই ছেলেটা বাসায় ফোন করা তার একদম পছন্দ নয় বলে মহাতর্ক জুড়ে দিয়েছিল। দ্যাখো! তুমি আমাকে পছন্দ করোনা সেটা ঠিক আছে। সবার সবাইকে পছন্দ করতে হবে এমনও কোন কথা নেই। কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি এবং সেকারণেই তোমাকে স্কুলে ‘সাকসেসফুল’ দেখতে চাই! স্থির বিশ্বাসের অটল লক্ষ্যে ছাত্রের দিকে তাকায় সত্যবতী। মাকে সুখী করার মহান লক্ষ্য তোমার, আমি কি তাতে বাঁধা দিতে পারি? ছেলেটার চোখে সরাসরি তাকিয়ে বলে-কিন্তু মাকে সুখী করতে হলে যে এই মুহূর্তে এই ‘ইভেন্ট প্ল্যানিং’ এসাইনমেন্ট এর একটা নির্দিষ্ট ‘Goal’ ঠিক করতে হবে। কি করা যায় বলতো? শান্ত ভঙ্গিতে থেমে থেমে কথা বলে সত্যবতী। জানো মিস! এই সপ্তাহেই আমরা শহরের বাইরে একটা ফ্যামিলি ট্যুরে যাচ্ছি- উচ্ছ্বাসে জানায় ছেলেটা। খুব ভালো! মোটিভেশনের ভ্যারিয়েসনে কণ্ঠস্বর ওঠানামা করে সত্যবতীর। কি উদ্দেশ্যে বল? মাকে রিলাক্সড সময় উপহার দিতেই তো! আবার জিজ্ঞাসা করছো কেন? অসহিষ্ণু কণ্ঠ ছেলেটার। পাঠের লক্ষ্যে পৌঁছার উচ্চ ধাপে ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে তৃপ্তির এক স্বর্গীয় ছায়া খেলে যায় সত্যবতীর মুখে। কোথায় যাচ্ছে, কি দেখতে যাচ্ছে, কি কি করার প্ল্যান আছে, খরচ কি হবে, যাত্রা কিভাবে, ইমারজেন্সিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি নিতে হবে- সবকিছুই প্রশ্ন করে করে গুছিয়ে লিখতে সাহায্য করে সত্যবতী। কাজ শেষ করার সুন্দর সাবলীল এক কনফিডেন্স ছেলেটার চোখে মুখে। চঞ্চলমতি, দুরন্তপনায় এক নির্জন শান্ত ভঙ্গি। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে অন্যদিনের মত দুড়দাড় ছোটে না। ক্লাসের কড়া নিয়মমত দায়িত্ববানের ভুমিকায় চেয়ার টেবিল পরিস্কারসহ জায়গা মত গুছিয়ে রেখে সত্যবতীর কাছে এসে দাড়ায়। হাত মুঠি করে ‘বন্ধুত্ব’ সুচকে সত্যবতীর হাত ছুঁয়ে বলে-you are truly amazing and a great teacher! I like you! পাখির পালকের হাল্কা অনুভুতিতে সত্যবতীর মন উড়ে উড়ে যায়- জানালা ছাড়িয়ে, আকাশের ওপারে অন্য এক আকাশে! হেনরি এডামের প্রিয় উক্তি মনে মনে আওড়ে চলে সে- ‘a teacher affects eternity, and one can never tell where their influence stops’ (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com