বিদ্যুৎ সরকার: একটু আগেও সে এখানটায় ছিল। অথচ, এখন নেই! তার শরীরের দাগগুলো এখনও স্পষ্ট ফুটে আছে বিছানার সফেদ চাদরে। এখনো তার শরীরের উষ্ণতা হাত দিয়ে অনুভ করতে পারছি আমি। ওর শরীরের যে গন্ধ আমি এতো দিন পেয়ে আসছি তা কেমন করে আমি ভুলে যেতে পারি? এইতো আমার চার পাশে সেই পরিচিত সুগন্ধটি ছরিয়ে আছে, ম ম করছে ঘরের চার দেয়ালের নরোম হাল্কা বাতাসে। ওর নরম পায়ের শরম পাওয়া মৃদু পদধ্বনি কান পাতলেই শুনতে পাই। মাঝে মাঝে সকালে ওর সোহাগি হাতের আদরে আমার ঘুম ভেঙে যায়, সেদিন সকালটা হয়ে উঠে স্বপ্নিল মোহময়। অথচ প্রতি রাতেই চাই আমার হাতের পরশ, আমার হাতের আদর। তবেই না তার দু’চোখে ঘুম নেমে আসে আবেশে। একটু ঠান্ডা পড়েছে তো গুটিশুটি মেরে যতটুকু সম্ভব আমার দেহের অন্দরে নিজেকে সাপ্টে রাখে। একটু উষ্ণতা, একটু ভালোবাসা তাইতো চাই। ঘুম ভেঙে ওকে দেখতে না পেলে মনটা এমনিতেই খারাপ হোয়ে যায়। পাড়া বেড়ানো তার অনেক মন্দ অভ্যাসের একটি। আজ সকালে কি তাই করেছে? শীতের সকালগুলোতে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় রোদের উষ্ণতা পেতে। কই আজতো ওখানটায় দাঁড়িয়ে নেই। তবে কী হলো তার? কোথাও সে নেই। এ ঘর ও ঘর, বারান্দা, ছাদ কোত্থাও না। সকালের ব্র্যাকফাস্ট, তাও করেনি। তবে কেন এতটা সময় সকাল সকাল বাইরে থাকা?

ও কে আমি নীল বলে ডাকি, অনেকটা আদুরে ডাক। অনেক বেশি বেশি আদর চায় ও। উঠতে বসতে আদর আর আদর। তাই নামটা সংক্ষিপ্ত করে আদর মিশিয়ে ও কে সম্বোধন করি ‘নীল’ বলে। সেও যে আমাকে একটু আধটু আদর সোহাগ করে না তা কিন্তু নয়। ও ভীষণ আদর বুঝে, সোহাগ বুঝে।কিন্তু ওগুলো পাওয়ার ব্যাপারে তার দিকের পাল্লা সব সময়ই ভারি রাখবে। উচ্চ স্বরে ওকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললেই হলো সারাদিন আমার কাছে আর আসবে না, আদর করতে গেলে মুখ সরিয়ে নেবে। গুমরা মুখ করে দূরে গিয়ে বসে থাকবে। অভিমানটা বেশি হলে লুকিয়ে টিপ টিপ পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। কখন ফিরবেন এই গৃহে উনিই জানেন। কিন্তু আজ কি হলো, আমার ঘুম তো সবে ভেংগেছে তা হলে রাগটা কার সঙ্গে ঘটলো সেটাইতো ভেবে পাচ্ছি না। আর এখন তো অনেক বাজে ঘড়িতে, ব্র্যাকফাস্টও করা হলো না। ওকে বাদ দিয়ে একা আমি কেমন করে ব্র্যাকফাস্ট করি? ওরও তো একবার ভাবা উচিৎ আমি না খেয়ে বসে আছি। শুধু ও নেই বলে আমি কেমন করে একা খেতে বসতে পারি? যখনই ওর সাথে খেতে বসি সকাল, দুপুর, বিকেল ও পাশে থাকলে হাজারো খুনসুটি আর ভালোবাসার আবদার। ও না থাকলে যে ওসব ভীষণভাবে মিস করবো। সব কিছু কেমন পানসে হয়ে যায় মেঘহীন আকাশের মতো, কাঁটাহীন গোলাপের মতো। ওর প্রসারিত বাহুডোরে জমে থাকে পল্লবিত ভালোলাগার ভালোবাসা। আমিতো ভালোবাসা চাই, চাই প্রেম- প্রেম বিলাসী মন শঙ্খচিল হয়ে উড়ে উড়ে যায় শূন্য থেকে অনন্তে। ‘চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর…..।’ ও তো প্রায়ই রাস্তার ওপারের চারুলতাদের বাসায় সময়-সুযোগ পেলে ছুটে যায়। যাবেইবা না কেন ওখানে গেলে চারুর আদর-যত্ন, মুখরোচক আপ্যায়ন তাকে নিশ্চয়ই অনেকে অনেক মোহিত করে। নীলও চায় এমনতর মনোরম পরিবেশ যেখানে, বায়নাবিলাসি মন ছুঁয়ে যায় অন্য একটি মনকে। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই মোটেও। কিন্তু, তাই বলে কি এতটা সময় অব্দি ওখানেই থাকতে হবে! আমারও তো কখনো কখনো কোথাও যেতে ইচ্ছে করে, সময় কাটাতে ইচ্ছে করে বন্ধুদের সাথে। কই, আমিতো অমন করে চলে যাই না ওকে রেখে বা ওকে না বলে। তা হলে ও কেমন করে পারলো?

হঠাৎ বাইরে একটি সরগোল শুনতে পেল পলি। বেলকনিতে গিয়ে দেখে একটু দূরেই রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় একটি প্রাইভেট কারকে ঘিরে জনতার ভীড়। নিশ্চয়ই কোন বড় রকমের এক্সিডেন্ট তা না হলে এতো লোক জমবে কেন? পলি হুরমুর করে নিচে নেমে অনেকটাই দৌড়ে গেল। তার সন্দেহ পরিচিত কেউ নয় তো? ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখলো আশেপাশের সবাই নিচু হয়ে গাড়ির চাকার দিকেই তাকাচ্ছে। চাকার তলদেশ থেকে একটি সরু রক্তের ধারা বাইরে আসছিল। পলি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি আসলে চাকার নিচে কে বা কি চাপা পড়েছে যার দেহ থেকে এমন রক্তের ধারা বের হয়ে আসছে? কিছুটা নিচু হয়ে দেখেই পলি আর্ত চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো ‘আমার জান,আমার নীল। আমার আদরের কুকুর ছানা।’

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা