মনীষ পাল : কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থায় গত একশো বছরের ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয় এবং ঘটনাবহুল। বিশ শতকের একেবারে গোড়ার কাহিনী। সেই ১৯০০ সালে বাইরের পৃথিবী থেকে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিল অনেক মানুষ। পূবের অতলান্তিক, পশ্চিমের প্রশান্ত আর উত্তরের সুমেরু মহাসাগর ঘেরা এই দেশটির উপক‚ল হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়েছে তাদের, যারা নিজ বাসভূমিকে শেষ বিদায় জানিয়ে বেরিয়েছিল নতুন এই পৃথিবীর সন্ধানে। কিন্তু দশক যেতে না যেতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং মহামন্দা অভিবাসনের এই জোয়ার কিছুটা থমকে দিয়ে যায়। কিন্তু সেই অচলায়তন ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। আজ বিশ শতকের শেষে এসে নতুন পৃথিবীর উদ্দেশে মানুষের মিছিল আবার ঠিক একশ বছর আগের জোয়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়।

হঠাৎ মনে হতে পারে, ঘটনাবহুল এই শতকটিতে শুরু এবং শেষের অভিবাসনে অনেক মিল কিন্তু এর মধ্যে গড়িয়ে গেছে অনেক জল, সময় অভিবাসনের ধরণ পাল্টে দিয়েছে আমূল। নিয়ম নীতির সতত পরিবর্তন তো আছেই, তাছাড়া পৃথিবীর নানান প্রান্তে যুদ্ধ এবং রাজনীতির পাশাখেলায় বিপুল এক জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুতি, অর্থনীতির কখনো তেজীভাব আবার কখনো দেউলিয়াত্ব, আবার এদিকে মানুষে মানুষে যোগাযোগ। পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন অভিবাসনের খোলনলচে একেবারে বদলে দিয়েছে।

শেষমেশ ফল দাঁড়িয়েছে এই, গেলো একশো বছরে ঘটেছে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর দোলাচল, কখনো বেড়েছে সীমানা পেরোনো মানুষের সংখ্যা, আবার কখনোবা কমেছে। সময় যত গড়িয়েছে, অভিবাসীরা উত্তরোত্তর থিতু হতে শুরু করে কানাডার বড়ো শহরগুলোতে, ক্রমে বাড়তে থাকে পারিবারিক অভিবাসন, আর তাতে অভিবাসীদের সংখ্যায় পুরুষের যে আধিপত্য ছিল, সে গেছে কমে। অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি আজ নারী, সেই সাথে এসেছে নিত্য নতুন জাতি স¤প্রদায়। আর এখন তো জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতি কৃষিকে ঠেলে দিয়েছে পেছনে আর সে সুযোগে অভিবাসীরাও পূর্বপুরুষদের কৃষিকাজ ছেড়ে ছুটতে শুরু করে উৎপাদনমুখী কারখানা এবং সেবা খাতে।
অভিবাসনের এসব যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়েই আজকের এ গল্প।

১৯০০ সালে মাত্র বিয়াল্লিশ হাজার অভিবাসী নিয়ে শুরু হয় ঘটনাবহুল এই শতকের, মাত্র তেরো বছরের মাথায় ১৯১৩ তে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় চারলক্ষ ও কানাডার অর্থনীতির শনৈ শনৈ উন্নতি সেই সময় আর তা হাতছানি দিয়ে যায় বাইরের দেশগুলোতে। উন্নত জীবনের আশায় অভিবাসীরা আসতে শুরু করে দলবেঁধে। আন্তমহাদেশীয় রেল নির্মাণ, প্রেইরীর উর্বর তৃণভূমিতে বসবাসের সুযোগ আর বর্ধিষ্ণু শিল্প কারখানা শ্রমের নতুন চাহিদা নিয়ে আসে। সেটি মেটাতে কানাডার সরকার শ্রম অভিবাসনে তোড়জোড় বেঁধে লেগে যায়। ১৯০০ এবং ১৯১৪ সালের মধ্যে প্রায় তিরিশ লক্ষ লোক এই সুযোগে কানাডায় অভিবাসন গ্রহণ করে যা আগের শতকের শেষ চৌদ্দ বছরের তুলনায় চারগুন।

পশ্চিমে বসতি গড়বার জন্য তখন বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করা হতো।
সৌজন্যে : কানাডিয়ান মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি

একেবারে শুরুর দিকে বাইরে থেকে আসা মানুষের অধিকাংশই তখন ওন্টারিওতে বাস করতে শুরু করে যদিও পরবর্তীতে অনেকেই পশ্চিমে যেতে শুরু করে। মাত্র এক দশকের মাথায় বাইরে থেকে আসা মানুষের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি প্রেইরীতে স্থায়ীভাবে চলে যায়। আলবার্টার পশ্চিম সীমান্তের সাথে যেখানে মিশেছে প্রশান্ত মহাসাগরের উপক‚ল, সমতল অথচ তৃণভূমি আচ্ছাদিত এই অঞ্চল অভিবাসী মানুষের বেছে নেবার জন্যে ছিল খুবই উপযুক্ত একটা জায়গা, যেখানে কৃষিই ছিল মানুষের অন্যতম জীবিকা। কানাডার পশ্চিমে মানুষের এই ধেয়ে আসা সেখানকার জনগোষ্ঠীর উপর ভীষণ এক প্রভাব ফেলে যায়।
স্বভাবতই, প্রথম দু দশকে অভিবাসী মানুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে পুরুষের সংখ্যা ছিলো বেশি, একটা হিসেবে দেখা যায়, সেই সময় প্রতি একশজন নারীর মধ্যে পুরুষ ছিল একশো আটান্ন জন। একশো বছর আগের সেই সময়টিতে লিঙ্গের অসমতা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও অসমতা ছিলো একই রকম। শ্রমের যোগানদাতা হিসেবে পুরুষরাই এগিয়ে ছিলো তখন, তাছাড়া ভাগ্যের মোড় ফেরাতে যারা এদেশকে বেছে নিয়েছিল, তারা এবং তাদের পরিবাবের কাছেও এই ব্যাপারটি ছিল সাময়িক, কাজের খোঁজে অজানা অচেনা বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাতে গিয়ে পুরো পরিবারকে উপড়ে নিয়ে আসার কোনো মানে নেই। ভেবেছিলো, আগে গিয়ে নিজেরা থিতু হই, তারপর না হয় পরিবারকে আনবার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু এটা ভাবার অবকাশ নেই যে, শ্রমের জন্য পুরুষরাই শুধু এদেশমুখী হয়েছিল, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে শ্রমের জন্য মেয়েদের প্রাধান্য ছিল, যেমন আজকের যেটা গ্রেট ব্রিটেন, তার কিছু দ্বীপপুঞ্জ যেমন স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর ওয়েলস থেকে এসেছে প্রচুর গৃহকর্মী, গৃহকর্মে মেয়েদের শ্রমের ছিল অগ্রাধিকার।

আগেই যেমন বলেছি, অভিবাসী পুরুষরা শ্রমের যোগান দিত কিছুটা দক্ষ বা অদক্ষ কাজে, কৃষিকাজেও পুরুষের শ্রমের যোগান ছিল। তবে সময় যতো এগিয়েছে, পুরুষেরা। তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে কুন্ঠা করেনি, সুযোগ পেলে কলকারখানা এবং নির্মাণ কাজের সাথেও জড়িয়েছে তারা। যদিও সেই সময় অনেকেই পশ্চিমে বসত গড়েছে, কিন্তু ছুটে গেছে রেল লাইন তৈরির কাজে অন্য দূর বড়ো শহরে, খোরাক জুগিয়েছে সেই সব শহরের প্রবৃদ্ধিতে।
যদিও বিশ শতকের শুরুতে অধিকাংশ অভিবাসী ছিলো মার্কিনি এবং ব্রিটিশ, কিন্তু ষাট এবং সত্তর দশকে ইউরোপীয়রা সেই জায়গা দখল করে নেয়। তাই এ দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের অভিবাসন হয়েছে ইউরোপীয়দের। শুরুটা

হয়েছিল এরকম, ঊনিশ শতকের শেষের দিকে রাশিয়া, হাঙ্গেরিয়া থেকে আসতে শুরু করে দুখবোর (doukhobor) ক্রিষ্টান এবং ইহুদী শরণার্থী, আর ইতালি এবং ইউক্রেন থেকে আসে মর্মন (আরেক সংখ্যালঘু ক্রিস্টান স¤প্রদায়)। এভাবে চলতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত যা এক সময় জন্ম দেয় রাজনৈতিক বিতর্কের – কানাডায় ঢোকবার অনুমতি পাবে কারা। একদল সুশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্যে শ্রমজীবি মানুষের আমদানিটাই ছিল মুখ্য, অভিবাসীদের উৎস নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু অন্য অনেকেই দক্ষিণ বা পূর্ব ইউরোপীয়দের চেয়ে ব্রিটিশ এবং মার্কিনিদের প্রাধান্য দিতে চাইতো।

একশো বছর আগে, এশিয়া থেকে আসা মানুষের সংখ্যা একেবারে নগন্য বললেই চলে। অথচ, একশো বছর পর, কি নাটকীয় পরিবর্তন। এই ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদেরকে আরো পেছনে তাকাতে হয়। উনিশ শতকে একেবারে শুরুতে অভিবাসন আইনের গোড়াতেই ছিল গলদ; সেই আইনে দারিদ্র্য, মানসিক অক্ষমতা ছিল অযোগ্যতার মূল কারণ; সেই সাথে ছিল আরো একটি হাস্যকর ব্যাপার – ইউরোপীয় নয়, এমন কাউকে অভিবাসন দেয়া হবে না। যদিও আন্তমহাদেশীয় রেল লাইন নির্মাণে চীনা শ্রমিকদের অবদান ছিল , ১৮৮৫ সালে ভবিষ্যৎ চীনা অভিবাসন ঠেকাতে প্রথম যে আইনটি হয়, তাতে ছিল, চীনা বংশোদ্ভূত প্রতিটি মানুষকে এ দেশে ঢুকতে হলে পঞ্চাশ ডলার করে দিতে হবে। ভাবা যায়, আজকে থেকে একশো বছরেরও আগে এমন বড়ো একটি অংকের জরিমানা? সেটি পঞ্চাশ ডলারে থেমে থাকেনি, ‘হেড ট্যাক্স’ নামের কুখ্যাত সেই আইনে সেই জরিমানা বাড়িয়ে ১৯০০ সালে করা হয় একশো ডলার, আর আরো তিন বছরের মাথায় ১৯০৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচশো ডলারে। চীনাদের আগমন ঠেকাতে এটি করা হয়েছিল, তাতে পরিবার পরিজনকে সাথে নিয়ে আসবার সামর্থ্য তাদের ছিল না।

মাতৃভূমি থেকে না আসলে ঢোকবার অনুমতি আইন করে বন্ধ করা হয় ১৯০৮ সালে। এই আইনে মূলত ভারতীয়রা বাদ পড়ে যায় কেননা তখনকার দিনে কলকাতা থেকে ভ্যানকুভার আসবার সরাসরি কোনো জাহাজ ছিল না, ভারতীয়দের আসতে হলে ঘুরে অন্য দেশ থেকে জাহাজ নিতে হতো। আর জাপান থেকে আসা বন্ধ করবার জন্যে কানাডার আরো ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ আয়োজন ছিল; উনিশ শতকের একেবারে শুরুতেই জাপান সরকারের সাথে কানাডার সরকার একগুচ্ছ চুক্তি স্বাক্ষর করে যাতে জাপানিদের এ দেশে আগমন সহজেই বন্ধ করা যায়।
মনীষ পাল: লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো, কানাডা

পরবর্তী সংখ্যায়-যুদ্ধ এবং মহামন্দার দিনগুলোতে অভিবাসন