ইউসুফ কামাল : সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই যেন সময় দৌড়ায়, আর সেই সাথেই ধীরে ধীরে অপসৃয়মান হয়ে যায় জীবনের মধুর স্মৃতিগুলো। চলে যায় মনের অনিচ্ছা সত্বেও ধরা ছোয়ার বাইরে, চলে যায় হারিয়ে যায় কিন্তু মনের বাইরে কি কখনো যেতে পারে? পারে না। ছাত্র জীবনের শেষ অধ্যায়ের দীপ্ত পদক্ষেপে মুখরিত স্বপ্ন ময় অধ্যায়গুলো জড়িয়ে রাখে জীবনের পরতে পরতে। ছাত্র জীবনের শেষ অধ্যায়ের সাথেই জীবনের মধুর একটা পর্বের যবনিকাপাত হয়ে যায়। শুরু হয় জীবনের কঠোর দ্বিতীয় ইনিংসের, যেখানে শুধু কঠোর অস্তিত্বের লড়াই। শুরু হয় টিকে থাকার সংগ্রাম। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। কার্জন হলের নীচ তলার সেই ঐতিহাসিক হল রুমে আমার সীট পরলো। অনার্সের সীট পরলো ‘এ্যানেক্স’ বিল্ডিং এ। কয়েকদিন বুলার সাথে দেখা হলো না, পরীক্ষা শেষে ও হলে চলে যায় আর আমারাও পরীক্ষা শেষে যার যার মতো বাসায় বা হলে চলে যেতাম। ইচ্ছে করেই দেখা করলাম না, আগেই বলে দিয়েছিলাম, তোমার তো অনার্সের ফাইনাল তাই আমি চাই পরীক্ষাটা যেন মন দিয়ে দিতে পারো। হেসে বলেছিলো, দেখা না হলেই কি মনোযোগ বেশি হবে? কথা সত্যি নয়, তবু তখন আর যুক্তি খন্ডন করতে যাইনি। অবশ্য এর মধ্যে দুই দিন বিকালে ওর সাথে ওর হল গেটে দেখা হয়েছে, মুখ্য বিষয়ই ছিলো পরীক্ষার খবর নেওয়া। কথা হলো শেষ দিন বিকালে একটু ঘুরবো। শেষ দিন পরীক্ষা দিয়ে আমার মনটা হাল্কা হয়ে গেলো, দুপুরে বাসায় যেয়ে একটা ঘুম দিলাম। বুলার পরীক্ষার শেষ দিন দেখা করার কথা, চিন্তা করে বিকালে চলে এলাম ওর হল গেটে। দোতলার রেলিং এ দাঁড়িয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে ছিলো হাত ইশারায় দাঁড়াতে বলে নীচে নেমে এলো। পাশে এসে দাঁড়াতেই সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধটা পেলাম বল্লাম, কোথায় যেনো যেতে চেয়েছিলে? হেসে উঠলো, চলো তোমাকে আজ আমি খাওয়াবো। কোথায় খেতে চাও বলো? খানিক চুপ থেকে বল্লাম, ইন্টারকনে হলে ভালো হয়। তখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার এক নম্বর পাঁচ তারকা হোটেল।
বুলা একটু থমকে গেলো বল্লো, বেশি টাকা তো কাছে নাই তা হলে কালকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিই, কালকে খাবো। কত লাগতে পারে? ভাবলাম ও সত্যিই মনে করেছে আমার বলা কথাটা। একবারও চিন্তা করলো না আমি ঠাট্টা করতে পারি। এটাকে ও সিরিয়াসলীই নিয়েছে। বল্লাম আমি তো দুষ্টুমি করেই বলেছি, পাগল একটা। রিক্সা ডেকে উঠে রিক্সাওয়ালাকে বল্লাম, ষ্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের কথা শুনে বুলা হেসে ফেল্লো। জানি আমার মতো বুলাও ‘প্রভিন্সিয়ালের’ বিরিয়ানী পছন্দ করে। বল্লাম, আজকেও সেই পারফিউমটার গন্ধ পাচ্ছি, আমার ফেভারিট। হেসে বল্লো, তুমি সাথে যে তাই। তোমার ভাল লাগে তাই ব্যবহার করি। জন্ম দিনে তোমার দেওয়া আংটিটা আর ইন্ডিয়া থেকে আনা লকেট ওয়ালা চেন টাও আজই প্রথম পড়েছি, কেমন লাগছে দেখো, বলে খুশীতে হাতটা উঁচু করে আর হাত দিয়ে গলার চেনটা দেখালো। দেখলাম সত্যিই ভালো লাগছে। ফর্সা গলায় কাল স্টোনের লকেটটা অপূর্ব লাগছে, আজকে মনে হোল বুলা আসলেও দেখতে বেশ সুন্দর। প্রভিন্সিয়ালের পাশেই একটা দোকানে তখন মিষ্টি পান পাওয়া যেতো বল্লাম, মিষ্টি পান খাবে? হেসে বল্লো, পান তো খাই না, তুমি বলছো যেহেতু আজ খেতে পারি।

পরীক্ষার পর পাঁচ দিন ক্লাশ বন্ধ। হল ভর্তি ছাত্র ছাত্রী, ক্লাশ না থাকায় সবাই একটু রিলাক্স মুডে। বিদ্যুৎ বাসাবো থেকে রোজই চলে আসে সারাদিন হলে, আমাদের সাথে থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যায়, আবার ২/১ দিন রাতে থেকেও যায়। একদিন সকালে আমার বাসায় এসে হাজির, বুঝলাম ২/৩ দিন দেখা হয় না চলে এসেছে। বাসা থেকে বের হয়ে পপুলার এ নাস্তা সেরে ওকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম কলা ভবনের দিকে। টিএসসি’র কাছে আসতেই বিদ্যুৎ বল্লো, বুলা’কে ডেকে নিয়ে আসি, চলো। সামসুন্নাহার হলের গেটে দাঁড়াতেই অনার্সের এক ছাত্রীকে পাওয়া গেল, বুলার কথা বলে রুম নাম্বার বলে দেওয়ার দশ মিনিট পরই বুলা চলে এলো। ও বুঝে ফেলেছে আজকে ম্যারাথন আড্ডা চলবে।
শরীফ মিয়ায় ঢুকে তিন জন চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেজিষ্টার ভবনের সামনের মলের একটা বকুল গাছের ছায়া দেখে বসলাম। পরিবেশটা ভালো লাগলো, গরম হাল্কা কিন্তু বাতাসের জন্য ভালোই লাগছে। বিদ্যুৎ বল্লো একটা গান হলে ভালোই হয়, গাইবে নাকি? অনেকদিন শোনা হয় না। বুলা হেসে বল্লো, দাদার সৌজন্যে তাহলে –
দুজনে দেখা হলো মধু যামিনী রে
কেন কথা কহিল না শুনিয়া গেলো ধীরে
মধু যামিনী রে দুজনের আখি বারি গোপনে গেল বয়ে
দুজনের প্রানের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে
আর তো হলো না দেখা জগতে দোহে একা
আর তো হলো না দেখা চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনা তীরে-

তিনজনই চুপ। পরিবেশটা কেমন যেনো স্তদ্ধ হয়ে গেলো। কারো মধ্যেই কোনো ভাবান্তরের প্রকাশ নাই নিস্তদ্ধতা ভেংগে বুলা বল্লো, ভাই ফোন করেছে, সামনের সপ্তাহে ব্রিটিশ হাইকমিশনে মূল পাসপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বলেছে। স্থায়ী ঠিকানা বরিশালের বাড়ির ফোন নাম্বারে ওরা জানিয়েছে। বল্লাম, ঠিক আছে যাবে সমস্যা কি। যেতে তো হবেই। ভিতরে ভিতরে আমি বুঝতে পারছিলাম স্বপ্নীল সোনালী দিন গুলি বোধ হয় আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গভীর ভাবে তাকালাম ঐ প্রিয় চেনা মুখটার দিকে, ভাবলাম ও চলে গেলে কেমন হবে? বেশি ভাবতেও পারি না। না জানি নিয়তি কোথায় নিয়ে যাবে? আমার চাহনি দেখে হয়তো আমার মনের কথাটা পড়ে ফেল্লো, পরক্ষনেই বুলার মুখের রংটা পরিবর্তিত হতে শুরু করলো। আষাঢ়ে মেঘের আভাষ পাচ্ছিলাম মুখের মধ্যে। পরিস্থিতি ঘুরিয়ে নিতে বল্লাম, বাদাম খাবে? সাথে সাথে বিদ্যুৎ বলে উঠলো, চলো নিজামের ওখানে যাই। ভালো প্রস্তাব, অন্তত: পরিবেশটা বদলে যাবে। নিজাম আমাদের বন্ধু নিউ মার্কেট ও রমনা ভবনের তখনকার প্রসিদ্ধ দেশী-বিদেশী পোষাকের দোকানের মালিক যদিও মুল মালিক ওর বড় ভাই কিন্তু সব কিছু ঐ দেখে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার প্রবল আগ্রহেই ও আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছিলো। ব্যবসার ঝামেলায় ঠিক মতো ক্লাশ করতে পারতো না। তবু ও অনিয়মিত হলেও মাঝে মাঝে ক্লাস করতে আসতো।

আমাদের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক, বিদ্যুৎ বল্লো, তোর খবর নিতে আসলাম। তুই তো আর খবর নিবি না। নিজাম হেসে বল্লো একজন খবর নিলেই হয়। এসেছিস যখন দুপুরের খাবার আনবো? খাবি তো? আগে খাওয়া তারপর অন্যান্য খবর। বন্ধুদের ব্যাপারে নিজাম সবসময়ই দুর্বল। ব্যাস্ততার মধ্যেও একটু সময় পেলেই কলাভবনে চলে আসতো। শুধু মাত্র সবার দেখা করা আর কিছুক্ষন গল্প করেই আবার চলে যেতো ব্যবসা স্থলে। এমন বন্ধু ভাবাপন্ন মানুষ কমই পেয়েছি জীবনে। বর্তমানে কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় শেরপুরে পরিবারের সাথে অবসর জীবন যাপন রত। বুলা ও আমার ব্যাপারে নিজাম সব জানতো, বুলাকে বল্লো, তুমি কি খাবে? বুলার সলজ্জ উত্তর, আমি তো আপনাদের বাইরের কেউ না। আপনাদের যা পছন্দ আমারও তাই। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র