শুজা রশীদ : (পর্ব ৫১)
মরিয়ম যখন রেস্টুরেন্টে পৌঁছাল লাঞ্চের সময় ততক্ষণে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। লাঞ্চের পর ঘন্টা খানেকের বিরতি দিয়ে চারটা থেকে ডিনারের আয়োজন শুরু হয়। শীতকালে রেস্টুরেন্ট তেমন ব্যাস্ত থাকে না সাধারণত কিন্তু তারপরও রাতে বেশ কিছু নিয়মিত খদ্দের আছে যারা ডিনার খেতে আসে। অতীতে এমন সময়ও ছিল যখন এখানে লম্বা লাইন পড়ে যেত। ইদানীং কোন রাতে যদি রেস্টুরেন্ট অর্ধেকও ভর্তি থাকে তাহলে সেটাকে মোটামুটি ভালো বলে ধরা হয়।

পিন্টু একেবারে সদর দরজায় এলো ওকে অভ্যর্থনা জানাতে। ব্যাপারটা মরিয়মের খুব ভালো লাগল। মন মনে স্বীকার করতেই হল জীবন সঙ্গীর কাছ থেকে এই জাতীয় সম্মান এবং ভালোবাসার নিদর্শন দেখলে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

ওকে দেখে দিনার এবং সুফি ছুটে এলো আলাপ করতে। লরা প্রথমে একটু দ্বিধাদ্ব›েদ্বর মধ্যে ছিল। বুঝতে পারছিল না দোলনের সাথে ওর দল বেঁধে বাইরে বেড়াতে যাবার ব্যাপারটা মরিয়ম কেমনভাবে নিয়েছে। মরিয়ম ঐ প্রসঙ্গ তুল্লই না। সে লরাকে হালকা করে একটা আলিঙ্গন দিয়ে রেস্টুরেন্টে ওর কাজের প্রশংসা করল, তারপর পিন্টুর পিছু পিছু অফিস রুমে গিয়ে ঢুকল। পিন্টু ডেস্ক থেকে সব কাগজ পত্র সরিয়ে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছে। সেখানে লাঞ্চ পরিবেশন করা হয়েছে। বড়সড় একটা প্লেট ভর্তি চিকেন কাবাব, সাথে দুই গ্লাশ ম্যাংগো লাস্যি এবং আরেকটা প্লেটে কিছু দেশী মিষ্টি। মরিয়মের এতো ভালো বহুদিন লাগেনি। ওর চোখের কোন ভিজে এলো আনন্দে কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে আবেগটুকু লুকিয়ে রাখল। পিন্টু অফিসের দরজা লাগিয়ে দিল। “বাইরে টেবিলে বসে খাওয়া যেত কিন্তু তাহলে আবার মন খুলে কথাবার্তা বলা যেত না,” সে অপরাধী মুখে বলল।
“এখানেই ভালো লাগছে,” মরিয়ম দ্রæত বলল। “প্রাইভেসী পাওয়া যাবে।”
“আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। বস। জলি আর হ্যাপি জানে তুমি যে এখানে এসেছ?”
“না। বললে সাথে আসতে চাইত। দিনারের কাবাবের ভীষণ ভক্ত ওরা।”
“আমি দিনারকে বলেছি বেশি করে বানাতে,” পিন্টু বলল। “তুমি যাবার সময় ও তোমার কাছে দিয়ে দেবে।”
ওরা দুজন পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ খেল। তারপর এক সুযোগে প্রথম প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মরিয়ম, “অবস্থা কত খারাপ, পিন্টু?”

“খারাপ। সেই কারণেই অতো পাগলামি করছিলাম,” পিন্টু খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে বলে।
“হিসাব কিতাব করেছ কিছু?” মরিয়ম নরম গলায় জানতে চায়। পিন্টু পারিবারিক ব্যবসার হিসাব কাউকেই দেখায় না, এমনকি তার বাবাকেও না। একমাত্র যে একাউন্ট্যন্ট ওর ট্যাক্স ফাইল করে সেই সম্ভবত সমস্ত খোঁজ খবর রাখে। পিন্টু অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে আলাপ করতে কতখানি প্রস্তুত নিশ্চিত হতে পারছিল না মরিয়ম।
পিন্টুর এক বান্ডিল কাগজ আছে যেখানে সে তার সমস্ত হিসাব কিতাব লিখে রাখে। পুরো বান্ডিলটা মরিয়মের দিকে এগিয়ে দিল। “এখানেই সব লেখা আছে। গত কয়েক দিন ধরে এইসব নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম। তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বেশি দেরী করা যাবে না।”
“তোমার বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করেছ?” মরিয়ম কাগজগুলোর উপর চোখ বোলাতে বোলাতে বলল।
“না। এইসব নিয়ে তাদেরকে বিরক্ত করতে চাইনি। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর নাহয় কথা বলব।”

“তাদের সাথে আগে আলাপ না করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হবে না,” মরিয়ম বলল। “তারা ইতিমধ্যে নিশ্চয় সব কিছুই জেনে গেছেন। তোমার এই খসড়া হিসাব দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না। বরং তোমার মুখেই শুনি, অবস্থা কতখানি খারাপ?”
পিন্টু গলা পরিষ্কার করল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “সংক্ষেপে বলি। প্রতি মাসে আমরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডলার শর্ট। গত বছর দুই ধরে এই ভাবেই চলছে।”
“দুই বছর?” মরিয়ম বিস্ময় ঢাকতে পারে না। “আমাকে এই সব নিয়ে কোনদিন কিছু বলনি কেন?”
পিন্টু কাঁধ ঝাঁকাল। “ভেবেছিলাম নিজেই সব সামলাতে পারব।”
“এখন কি প্ল্যন তোমার?”

“হাতে একবারে বেশ কিছু টাকা পয়সা না পেলে ব্যাংকরাপসি। চ্যাপ্টার থারটিন ঘোষণা দিয়ে দেশের যা জমি জমা এখনও আছে সেগুলো আর্ধেক দামে হলেও বিক্রি করবার চেষ্টা করতে পারি। আত্মীয় স্বজনদের কাছে বেঁচলে মনে হয় না কোন টাকা পয়সার মুখ দেখব।”
মরিয়ম এক মুহুর্ত চিন্তা করল। “মাসে পাঁচ ছয় হাজার ডলার তেমন বিশাল অংক নয়। আমি যদি কাজে যাই তাহলে ঐ পরিমাণ অর্থ তো আমিই উপার্জন করতে পারব।”
“আগে তো উপযুক্ত একটা চাকরী পেতে হনে তোমার,” পিন্টু দ্বিধা নিয়ে বলল। “রেস্টুরেন্টের বাইরে তুমি তো কখন কোন কাজ কর নি। তাছাড়া মাও হয়ত ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করবে না। আব্বা হয়ত হ্যাঁ-না কিছু বলবেন না।”

“আমার তো ধারনা ছিল আমরা কোন কিছু সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাদেরকে কিছু বলছি না,” মরিয়ম খোঁচা দেবার জন্য বলল। মাথার মধ্যে নানান ধরণের সমাধান নিয়ে ভাবছে ও। ভালো বেতনের একটা কাজ পেতেও সময় লাগে। ওর ডিগ্রী আছে কিন্তু তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। আগে ছোট কোন কাজ দিয়ে শুরু করতে হবে। কিন্তু অর্থ ক্ষরণটা এখনই বন্ধ করা দরকার।
“আমাদের পরিবারে এই একটা অদ্ভুত ট্রেডিশন। মহিলাদেরকে বাইরে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয় না,” পিন্টু চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল। “তুমি কাজ করতে গেলে আব্বা-আম্মা সমস্যা করবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ধর আমরা কোনভাবে ব্যপারটা সামাল দিলাম। নতুবা তুমি রেস্টুরেন্ট সামলাতে পারো, আর আমি নাহয় গেলাম চাকরী করতে। যদিও কি চাকরী পাবো কে জানে। আমার যে যোগ্যতা চাকরীর বাজারে তার কোন মূল্য নেই।”
“আমাকেই চেষ্টা করতে হবে চাকরী-বাকরীর জন্য,” মরিয়ম একটু ভেবে বলল। “কিন্তু আগে ক্ষয়-ক্ষতিটা বন্ধ করা দরকার। ব্যাংকরাপসি ঘোষনা করার কোন দরকার নেই এখনই। তাতে আমাদের ক্রেডিট হিস্ট্রিটা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমে ডাউনসাইজ করা যাক।”
পিন্টু ভ্রূঁ উঁচিয়ে ওকে দেখল। “কি ডাউনসাইজ করব? রেস্টুরেণ্ট? আমার তো মনে হয় আমাদের উচিৎ আরোও বড় করে করা। তাহলে অন্যদের সাথে পাল্লা দিতে পারব। আবার আগের মত চালুও হয়ে যেতে পারে।”
“কিভাবে বড় করবে?” মরিয়ম জানতে চাইল।
পিন্টু দুই হাত বাতাসে ছূড়ল। “এখনও জানি না।”
মরিয়ম কাগজের বান্ডিল থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে সেখানে কিছু লিখল, তারপর সেটা পিন্টুর দিকে ঠেলে দিল। পিন্টু সামনে ঝুঁকে কাগজটা পড়লঃ

বাড়ী
পর্শা
পিন্টূ বিড়বিড় করে কয়েক বার পড়ল শব্দ দুটো যেন তাদের অর্থ সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
“বাড়ী, পর্শা – কি বোঝাতে চাইছ?” শেষে প্রশ্ন করল।
মরিয়ম একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল। “অত বড় একটা ম্যনসনের মত বাড়ী আমাদের দরকার নেই। ঐ বাড়ীর মর্টগেজ অতিরিক্ত বেশী। এই মুহুর্তে বাড়ীর বাজার খুবই ভালো। আমরা এই বাড়ী বিক্রী করে একটা মাঝারী সাইজের বাড়ি কিনতে পারি। তার ফলে আমাদের মর্টগেজ অর্ধেক হয়ে যাবে। তোমার পর্শা। এই কাগজে হিজি বিজি যা লিখেছ সেখান থেকে মনে হচ্ছে ওটার মাসিক ইনসটলমেন্ট পেমেন্টই এক হাজারের বেশী। আমাদের আরোও দুইটা গাড়ি আছে। তাদের জন্য আরোও পনের শ দিতে হচ্ছে মাসে মাসে । সব মিলিয়ে খুব বেশী হয়ে যাচ্ছে। তোমার পর্শা থাকাটা জরুরী নয়। ওটা পালটে একটা সাধারণ গাড়ী নিতে পারো। এই দুইটা পরিবর্তন যদি আমরা করি তাহলে মাসিক গচ্চাটা বন্ধ হবে। তারপর আমরা রেস্টুরেন্টের দিকে মনযোগ দিতে পারি। এখনও এটা লাভজনক ব্যবসা। সুতরাং রেস্টুরেন্ট আমাদের মূল সমস্যা নেই। নতুন করেও কোন ইনভেস্টমেন্ট এই মুহুর্তে করা যাবে না।”
মরিয়ম ইচ্ছে করেই পিন্টুর দিক থেকে নজর অন্য দিকে সরিয়ে রাখল। এতো মারাত্বক পরিকল্পনা হজম করতে তার সময় লাগবে। ও জানে পিন্টু ম্যনসনের মত বাড়ি আর ওর পর্শা নিয়ে কত গর্ব বোধ করে। নিজেকে সফল হিসাবে প্রদর্শন করাটা ওর জন্য জরুরী। ওর সারা জীবন ধরে ও যা করেছে, মরিয়ম এক মিনিটে তাকে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা পথে যাত্রা করতে বলছে।
পিন্টু একটা দীঘির্œশ্বাস ছাড়ল। কিছু বলল না।

৭৫

“রবিন! রবিন! সোনা মনি! আরেকটা চাও?” নীতা গোলাকার কুকির বাক্স থেকে আরেকটা চকলেট কুকি হাতে তুলে সামনে ঝুঁকে পড়ে সাধলেন। রিমার লিভিংরুমে একটা সোফায় বসে আছেন তিনি। রবিন সামনেই বসে এখনও আগের কুকিটাকেই চিবাচ্ছে, তার সম্পূর্ণ মনযোগ একটা লাল নীল ডোরা কাটা ছোট্ট রেসিং কারের উপর।

লাট্টু স্ত্রীর পাশেই আরেকটা সোফায় বসেছিলেন, তার দৃষ্টি ছেলেটার উপর স্থির , মুখে স্নেহার্দ্র বিশাল এক টুকরো হাসি। ফায়জা নিজের কামরায় পড়াশুনা করছে। জিব্রান ভাইয়ের পাশে বসে আছে, মাঝে মাঝে রেসিং কারটা দু’ জনে ঠেলাঠেলি করে খেলেছে। আজ তারা হঠাৎ করে আসবেন ভাবে নি রিমা। কিন্তু লাট্টু যখন ফোন করে জানতে চাইলেন আজ রবিনকে একটু দেখতে আসা যাবে কিনা তখন আর না করতে পারে নি। ফোন করার পর মাত্র ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তারা এসে হাজির হয়েছেন। বেশ একটু সময় লেগেছে রবিনকে তাদের উপস্থিতিতে সহজ করতে। গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদেরকে দেখছে রবিন কিন্তু এখনও দেখলে এমন আচরণ করে যেন তাদেরকে সে নতুন দেখছে।
রিমা রান্নাঘরে যাবার দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা যেহেতু রাতে খাবার সময় এসেছেন ও ভাবছিল তাদেরকে ওদের সাথে রাতের খাওয়া খেয়েই যেতে বলবে। ডিপ ফ্রিজের কয়েকটা ফ্রোজেন চিকেন ছিল সেগুলো বের করে ডিফ্রস্ট করেছে। একটা তরকারী রান্না করে ফেলবে ঝট করে।
রবিন যখন তার অনুরোধে কোন সড়া দিল না তখন নীতা তার কন্ঠস্বর আরোও চিকন করে ডাকলেন, “রবিন! কুকি! সোনামনি!”

রবিন এবার তার দিকে ফিরে তাকাল এবং খানিকটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতে ধরা কুকিটাতে একটা কামড় দিল। এই নিয়ে তৃতীয় কুকি হতে যাচ্ছে। “বেশী মিষ্টি খাওয়াটা ওর জন্য ভালো না,” রিমা সংযত কন্ঠে বলে। “খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। রাতে ঘুমাতে পারে না। পরদিন খুব ক্লান্ত হয়ে থাকে। শরীর খারাপ হয়ে যেতেপারে।”
নীতা কানে নিলেন না। “এটা নিয়ে মাত্র তো তিনটা হবে। আর কুকিগুলো কত ছোট ছোট দেখেছ? ওর মত একটা ছেলের তো এই রকম অনেকগুলো খেতে পারার কথা।”
“তিনটা ঠিক আছে,” লাট্টু মধ্যম ভূমি নিলেন। “আমার ধারনা এতোদিনে ও আমাদেরকে বেশ ভালোভাবেই চিনে গেছে, তাই না? আমাদেরকে দাদুভাই, দাদীবু বলে ডাকলে খুব ভালো লাগত। কখন ডাকতে পারবে মনে হয়?”
প্রশ্নটা তিনি বিশেষভাবে কাউকে লক্ষ্য করে করেননি কিন্তু এই বাড়ীতে রবিন সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে স্পেশিয়ালিস্ট হল জিব্রান। উত্তরটা সেই দিল। “আমার মনে হয় ও বলতে পারবে। ও আমাকে ব্রো বলে, ফায়জা আপুকে আপু বলে আর মাকে মা বলে। আমি ওকে শেখাব। তোমরা পরের বার যখন আসেব তখন আমার ধারনা ও তোমাদেরকে ডাকবে। কি বল রবিন? বল দাদুভাই! দাদীবু!”
রবিনকে দেখে মনে হল না সে আদৌ কোন শব্দ করতে আগ্রহী। সে কুকিতে আরেকটা কামড় দিয়ে তার রেসিং কারে ফিরে গেল। একটা জোর ধাক্কা দিয়ে সেটাকে জিব্রানের দিকে ঠেলে দিল।

“আমি ভাবছিলাম কি,” নীতা রিমার দিকে তাকিয়ে সামান্য দ্বিধা করে বললেন, “ও আমাদের বাসায় এসে যদি থাকত তাহলে খুব ভালো লাগত। প্রথমে হয়ত এক রাতের জন্য। পরে আস্তে আস্তে আরোও বেশী দিন। তাহলে আমাদেরকে ও সত্যি সত্যিই চিনবে, আমরাও ওকে ভালো করে চিনব।”

রিমার মাথায় বিপদ সংকেত বেজে উঠল। ভেতরে ভেতরে ও জানত একদিন এই জাতীয় একটা অনুরোধ আসবেই। সমস্যা হল আহমেদ পরিবারের আদৌ ধারনা নেই রবিনের মত একটা বাচ্চার দেখভাল করাটা কতখানি দুষ্কর হতে পারে। তারা মাঝে সাঝে বেড়াতে এসে দেখেন বেশ একটা হাসিখুশী ছেলে যে ছুটাছুটি করছে, খেলনা দিয়ে খেলছে আর ভাবছেন সব সময় বোধহয় এভাবেই থাকে। তারা যদি দেখতেন ওর যখন মেজাজ খারপ থাকে কখন কেমন চীৎকার করে কাঁদে, জিনিষপত্র ছোঁড়ে তাহলে দৌড়ে পালিয়ে যেতেন।
“একা একা?” প্রশ্নটা এলো জিব্রানের কাছ থেকে।
“সেটাইতো ভালো হবে, তাই না?” নীতা রিমার দিকে তাকিয়ে বললেন। “আমাদের সাথে একাকী থাকলে আমাদেরকে ও বেশী তাড়াতাড়ি চিনবে। তুমি কি বল?” তিনি এবার তার স্বামীর দিকে ফিরলেন। লাট্টু মাথা দুলিয়ে নীরব সমর্থন জানালেন।

“ওকে সামলানো সহজ না,” রিমা শান্ত কন্ঠে বলল। “ওকে একা আপনাদের সাথে পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। যদি ঝামেলা করতে শুরু করে আপনারা জানবেন না কি করতে হবে। এখন যেভাবে চলছে এটাইতো ভালো। আপনাদের যখন ইচ্ছা তখন চলে আসবেন ওকে দেখতে।”
নীতাকে দেখে খুব একটা খুশী মনে হল না। “এইভাবে যে চলবে না সেটা তো আমরা সবাই জানি। তুমি থাকো দোকানে, বাচ্চারা স্কুলে। আমাদের ইচ্ছা হলেই আমরা যখন তখন চলে আসতে পারি না। আমাদেরও বয়েস হয়েছে। বিশেষ করে আমার জন্য বাসার বাইরে যাওয়াটাই একটা সমস্যা হয়ে উঠছে। রবিনকে আমাদের বাসায় রাখতে পারলে ওর সাথে সম্পর্কটা ভালো হত আমাদের।”
“আপনারা চাইলে আমি উইক এন্ডে ওকে ঘন্টা দুয়েকের জন্য আপনাদের বাসায় আনতে পারিৃ” রিমা নরম গলায় বলল। “উইক ডেজে ও স্কুলে যায়।”

“ও স্কুলে যায়?” নীতা অবাক হয়ে বললেন। “আমি ভেবেছিলাম তুমি ওকে কোন চাইল্ড কেয়ার ফ্যাসিলিটিতে দিয়েছ। ও তো কথাই বলতে পারে না। স্কুলে কি করে?”
“স্পেশীয়াল নিড টিচার আছে। রবিনের মত বাচ্চাদেরকে সামলানোর জন্য তাদেরকে বিশেষভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। স্কুলে যেতে পছন্দ করে রবিন।”
নীতা কয়েক মুহুর্তের জন্য নিশ্চুপ থাকলেন। “উইক এন্ডে কয়েক ঘন্টার জন্য আসলে মন্দ হয় না। সেটাই করা যাক না হয়।”
“ওর সাথে জিব্রানও আসতে পারে,” লাট্টু উৎসাহ নিয়ে বললেন।
নীতা মুখ কুঁচকালেন। “না! আমরা তো ওকে একাকী চাই, তাই না। তাতে আমাদেরকে সাথে ওর বন্ডটা ভালো হবে।”
রিমা কিছু বলল না। যখন সময় আসবে তখন ও পুরো ব্যাপারটা ভালো করে ব্যাখ্যা করবে।
তারা ডিনারের জন্য অপেক্ষা করলেন না। ইদানীং নীতার হজম সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে। তিনি বাসার বাইরে কিছু খান না। রিমা চাপাচাপি করল না। দেখা যাবে ওর বাসায় খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সে আরেক সমস্যা হয়ে যাবে। সবাই বলে বেড়াবে প্রথমে ছেলেটাকে মেরেছে, এবার শ্বশুর- শ্বাশুড়ীকেও মারবার চেষ্টা করছে! মানুষের এতো মনযোগ ওর দরকার না।

বাইরে প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে রিমার। ও পড়েছে ধনবান পিতামহ-পিতামহীরা বানোয়াট যুক্তি দেখিয়ে পোতা-পুতনী নিয়ে যায়। বলে মা অবহেলা করে। তারা বড় উকিল ধরে। সেই উকিল জাজের কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা কথা বলে। বাচ্চাকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে, ভালো মত দেখভাল করা হয় না, মায়ের অর্থনইতিক সমস্যা আছে ইত্যাদি। লাট্টু এবং নীতাও কিছু দিন পর তেমন এক উকিল নিয়ে এসে হাজির হলে ও একেবারেই অবাক হবে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল অবিষ্যতে তাদের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করতে হবে। এদেরকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।