আবুল খায়ের : মানসম্পন্ন সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার পরও করোনায় সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। গত শনিবার পর্যন্ত ৪৪ জন ডাক্তার, ছয় জন নার্স ও দুই জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী করোনায় যারা গেছেন। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭২ জন ডাক্তার, ৯৩৮ জন নার্স, ১ হাজার ৪২৭ জন টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য সেবাকর্মীসহ ৩ হাজার ৪৩৭ জন।

সর্বোচ্চ ঝুঁকি জেনেও জীবনবাজি রেখে করোনাযুদ্ধে এই ফ্রন্টফাইটাররা রোগীদের চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মনোবল ভাঙেনি, মৃত্যু ভয়েও ভীত নন তারা। শঙ্কিত পরিবারপরিজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু দায়িত্ববোধ, সেবাব্রত আর মানবিকতাবোধ তাদেরকে কর্মস্থলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাস জেনে-বুঝেও আক্রান্ত রোগীর গা ঘেঁষেই চলছে তাদের দায়িত্ব পালন।

আলাপকালে কয়েক জন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী বলেন, ‘মৃত্যু একদিন আসবে, সবাই মারা যাব। মৃত্যু তো অবধারিত। মৃত্যুর ভয়ে আমরা পিছপা হব না। করোনার এই দুর্যোগকালে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাব।’

এদিকে সুরক্ষাসামগ্রী বিশেষ করে পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহারের সঠিক নিয়ম অনুসরণ না করায় ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানা গেছে। করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত পাঁচ জন ডাক্তার, পাঁচ জন নার্স, তিন জন টেকনোলজিস্ট ও দুই জন ওয়ার্ড বয় জানান, অনেক হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন না থাকার পাশাপাশি সেন্ট্রাল এসি নেই। এমনিতেই গরমে আট ঘণ্টা ডিউটি করতে গিয়ে ঘেমে যাই। ডিউটি শেষ করে বাইরে বের হয়ে সঠিক নিয়ম না মেনে তাড়াহুড়া করে সুরক্ষা সামগ্রী খুলতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।

সম্প্রতি দেশে আসা চীনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, ‘একদল ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দেবেন। আরেক দল ডাক্তার চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তাররা সঠিক নিয়মে পোশাক খুলছেন কি না, সেবা দিচ্ছেন না কি না—এ সবকিছু মনিটরিং করবেন। নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।’ কিন্তু দেশে জনবল সংকটের কারণে সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দেশের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

তবে ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে নতুন ওষুধপথ্যের প্রেসক্রিপশন লিখে খালাস পেলেও রোগীর গা-ছুঁয়ে ইনজেকশন দেওয়া, ওষুধপথ্য সেবন করানোর দায়িত্ব পালন করছেন নার্সরা। নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে টেকনোলজিস্টরা আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও চরম ঝুঁকি নিয়েই করোনা রোগীর বিছানাপত্র, পোশাক, ব্যবহার্যসামগ্রীর সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে করোনা রোগীর আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশটাও গ্রহণ করছে না কেউ। কিন্তু সেখানেও এসব পেশার মানুষ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও মানবিকতা নিয়ে স্বজনদের মতোই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, ডাক্তারদের মনোবল ভাঙেনি। তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছি। তবে যেসব সিনিয়র ডাক্তার—যাদের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে, তাদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার কিংবা প্রাইভেট প্রাকটিস না করার জন্য বলা হয়েছে। তারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তারদের পেছন থেকে পরামর্শ দিয়ে সেবা দিয়ে যাবেন। আর যেসব ডাক্তারের কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি আছে, তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। চাহিদার তুলনায় বেশি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় কাজ করছে জাতীয় টেকনিক্যালি পরামর্শক কমিটি। এছাড়া আট সদস্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটিও কাজ করছে। এখন থেকে করোনা মোকাবিলায় এক সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করবে। সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। ইত্তেফাক