ভজন সরকার : হঠাৎ এক বর্ষার দিনে আবিষ্কৃত হলো আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের আর্কিটেক্টচার ভবনের বিপরীত দিকে সিভিল আর ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাঝখানের গেইটের পাশে আছে কয়েকটি কদম গাছ। সে সাথে রবি ঠাকুরের গান “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান”। বর্ষার বর্ণনায় রবি ঠাকুর অতুলনীয়। জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”-এর পরে এত নিবিড় বর্ষার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে দিতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্যে?

বাংলা সাহিত্য বললাম এ কারণে যে,ওদিন দক্ষিণ আমেরিকার আরেক কবি পাবলো নেরুদার আত্মস্মৃতি “মেমোওরস” নিয়ে একটি লেখা পড়ছিলাম। মুগ্ধ হচ্ছিলাম নেরুদার বৃষ্টির বর্ণনা পড়ে। নেরুদার দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টি দারুণ ধীর-স্থির। নামছে তো নামছেই । চলে যাবার কোনো তাড়া নেই। নেরুদার বাড়ির সামনে সে ধৈর্যশীল বৃষ্টিতে আটকে পড়ে কী হেনস্তাই না হচ্ছে গরুর গাড়িগুলো?
পড়ছিলাম আর শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের সে বিখ্যাত “অবনী বাড়ি আছো”- কবিতার বৃষ্টির অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব বর্ণনা মনে করছিলাম,

“বৃষ্টি পড়ে এখানে বার মাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে”।

এ যেন দক্ষিণ-আমেরিকার আরেক কবি পাবলো নেরুদার কবিতারই সুর। যেন শক্তি চট্রোপাধ্যায় আর পাবলো নেরুদা ভিজে একাকার এক দীর্ঘ বৃষ্টিতে। বৃষ্টি কি শুধু বাইরে, বৃষ্টি কবির অন্তরেও। শক্তি চট্রোপাধ্যায় তাই বলেন,

“বৃষ্টি নামলো যখন আমি দৌড়ে গিয়ে একা
উঠান পানে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা
হয়ত মেঘে বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে
আজানু কেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নাই বাহিরে অন্তরে মেঘ করে
ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঘরে।”

আমিও লিখেছিলাম কবিতা একদিন বৃষ্টিকে নিয়েই। অনেকটা কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়কে মনে রেখেই লিখেছিলামঃ
“বৃষ্টি হলে কষ্ট বাড়ে কিন্তু সেতো প্রলেপটাও
পারতো দিতে জলের ছিটায়। জল গড়ালে কিংবা
রোদে স্পর্ষ খুঁজি, মধ্যদিনে দুপুর গড়ায়
বাতাস যখন স্তব্ধ বধির অরণ্যে গায় শূন্যতাও”।

পৃথিবীর তাবৎ কবি বৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতা ও গানে বর্ষাকে অতুলনীয় করে তুলেছেন। প্রকৃতি পর্যায়ের গানের মধ্যে বর্ষার গানই ১১৪টি। রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি ও বৃষ্টির আনুসংগিকতা অনেক রোমান্টিক; প্রেমে,প্রেম নিবেদনে এবং প্রেম-বিচ্ছেদে। আমাদের মতো স্বল্প সংগতিসম্পন্ন প্রেমিকদের কাছে তো বটেই; অন্তত চালচুলাহীন ছাত্রজীবনে, যখন বুকের গভীরের অসীম ইচ্ছেটা ছিল বুক পকেটের সংগতিটার কাছে বাধা।
তাই বর্ষার প্রায় বিকেলেই কদম গাছের ডাল ভেঙে গোটা পাঁচেক কদম ফুল নিয়ে প্যারোডি করে বললতাম, “এক গোছা কদম ফুল হাতে নিয়ে বললাম,চললাম”।
পথ চলতে চলতে প্যারোডিটা কখন বদলে যেত। আবার ভর করতো চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ। কখনো ঘন ঘোর বরষায়, কখনো বৃষ্টি স্নাত ঝকঝকে সন্ধ্যায়। এক আকাশ শুভ্রনীলকে সাক্ষী করে সব প্রেমিকের মতো শাশ্বত কন্ঠে বেজে উঠতো, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছো দান”।

অনেক দূরে ফেলি এসেছি কদম ফুল। আষাঢ়ও সেভাবে আর নেই এ মুল্লুকে। কিন্তু বৃষ্টির ধারাপাত আছে। নানান রকমের মেঘ-কালো আকাশ আছে তেমনি ছায়াময় এখানেও। আর ছায়ার মতো ছুঁয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গান এবং প্রকৃতি পর্যায়ের বর্ষার গানগুলো।
গীতবিতান পড়তে পড়তে আজকেই একটি না-শোনা গানের কথায় চোখ আটকে গেল। “কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ় মেঘের ছায়া খেলে”। আভোগ বা দ্বিতীয় অন্তরার কথাগুলো যখন পড়ছিলাম, তখন সামনের উঠোনে দূরের বন থেকে সূর্যের শেষ আলোটুকু এসে পড়ছিল। আকাশের অন্যপ্রান্তে কালো মেঘ জমেছে। যেকোন সময়ে বৃষ্টি পড়বে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

“ঝিল্লিমুখর বাদল-সাঁঝে কে দেখা দেয় হৃদয়-মাঝে,
স্বপনরূপে চুপে চুপে ব্যথায় আমার চরণ ফেলে\”

লাইন দু’টো পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম ফেলে আসা আষাঢ়, আষাঢ়ের বৃষ্টি আর রবীন্দ্রনাথের গানের সেই কদম ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সময়টিকে।
প্রতিবারের মত আবার আষাঢ় এসেছে। এবারেও নির্জনতায় ভরে যাবে মন। ভালোবাসায় উথলে উঠবে সব প্রেমিক মন; কখনো কুড়িয়ে পাওয়া নতুনে, কখনো ফেলে আসা পুরাতনে। রবি ঠাকুরের আষাঢ়ে এবারেও হয়তো নামবে শক্তি চট্রোপাধ্যায় কিংবা পাবলো নেরুদার বৃষ্টি। হয়তো এবারেও কদম ফুল ফুটবে। গাওয়া হবে গান। উত্তর আমেরিকার এক শহরে বসে আমিও বলে উঠবো, “I first opened my eyes to life, love, the land, poetry and the rain”।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)