রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

তিপ্পান্ন..
ত্রয়দশ অধ্যায়
সততা ও ন্যায়পরায়ণতা অমূল্য সম্পদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ডিজনি মানুষের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং বিশ্বাস করে মানুষের জন্য নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ । এটি আমাদের কোম্পানির একটা গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। কেউ নির্যাতিত হয়ে থাকলে বা কেউ কাউকে নির্যাতিত হতে দেখে থাকলে তারা নির্ভয়ে তাদের অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। তাদের অভিযোগ সমূহ গুরুত্ব সহকারে শোনা হবে। অভিযোগগুলো নিস্পত্তি করা হবে এবং তাদেরকে প্রতিপক্ষের আক্রশ থেকে প্রতিরক্ষার ব্যাবস্থা করা হবে।

আমাদের কোম্পানির সুনাম এবং মূল্যবোধ আমাদের কর্মীবৃন্দ কতটুকু বিশ্বাস করেন এবং মেনে চলেন তার একটা মূল্যায়ন করা জরুরি বোধ করলাম। আমি আমাদের মানব সম্পদ বিভাগকে এতদ সংক্রান্ত একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার জন্য আদেশ দিলাম। কোম্পানীর প্রতিটা স্তরে সংলাপের আয়োজন করতে বললাম এবং প্রত্যেকটা স্তরে একটা স্থান নির্ধারণ করে দিলাম যেখানে মানুষ তাদের অভিযোগ দাখিল করবে বা অকপটে নির্ভয়ে অভিযোগগুলো তুলে ধরবে। এবং যারা আসবে তাদের সুরক্ষার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতিকে শক্তিশালী করবে।

২০১৭ সালের শরৎকালে পিক্সারের নারী-পুরুষ সকলের কাছ থেকে আমরা জন ল্যাসেটার সম্পর্কে অভিযোগ শুনেছি, তারা সকলেই অবাঞ্ছিত শারীরিক যোগাযোগ হিসাবে বর্ণনা দিয়েছেন। সবাই জানত জন সকলের সাথে আলিঙ্গন করতে পছন্দ করেন এবং অনেকেই এটিকে নিরীহ আচরণ হিসাবে ধরতেন এবং তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতেন। আমি কয়েক বছর ধরে এই বিষয়ে জনের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু নতুনভাবে আবার এই অভিযোগ উন্থাপিত হলে আমরা গুরুত্ব সহকারে তা বিবেচনা করি।

আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তাকে এ বিষয়ে জবাবদিহী করতে হবে। অ্যালান হর্ন এবং আমি সেই বছরের নভেম্বরে জনের সাথে বসলাম। এবং আমরা একমত হয়েছিলাম যে তার এমন আচরণের জন্য ছয় মাসের জন্য তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হবে, যাতে করে আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার সুযোগ পাই। জন ছয় মাসের ছুটিতে যাওয়ার আগে তার দলকে উদ্দেশ্য করে একটা লিখিত বিবৃতি জারি করেন। তিনি লিখলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আপনারা সম্মিলিতভাবে আমার পৃথিবী। এবং আমি যদি কোনভাবে আপনাদের কাউকে হেয় করে থাকি তবে আমি গভীরভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। বিশেষ করে আমি যদি কারও সাখে অবাঞ্ছিত আলিঙ্গন করে থাকি অথবা অন্য যে কোন ধরণের অঙ্গভঙ্গি বা যে কোন উপায়ে মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকি বা কারও ব্যক্তিগত সীমা লঙ্ঘন করে থাকি তবে তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই। আমার উদ্দেশ্য যতই সৌম্য বা মহৎ হোক না কেন, প্রত্যেকেরই নিজস্ব সীমা নির্ধারণের অধিকার আছে এবং প্রত্যেকেই সে জন্য সম্মানিত হবার অধিকার সংরক্ষণ করেন।’

জনের অনুপস্থিতিতে পিক্সার এবং ডিজনি অ্যানিমেশন উভয় স্টুডিওর কয়েক ডজন মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলাম। সকলের মতামত সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের জন্য সেরা নেতৃত্ব কাঠামো নির্ধারণ করলাম।

পরের ছয় মাস আমার প্রধান কাজগুলো ছিল— সরাসরি ভোক্তার জন্য কাজ করার কৌশল নির্মাণ করা, উচ্চ-প্রোফাইল কর্মীদের সমস্যাগুলির সাথে লড়াই করা এবং ফক্স অধিগ্রহণ চুক্তি বিশ্লেষণ করা এবং অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা চালু রাখা। কাজগুলো অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই ছয় মাস আমার কর্মজীবনের যে কোনো টানাপোড়েনের সাথে তুলনা করা যায়। বিষয়বস্তু, বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ব্যাবসা, প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গের সমাগম এবং প্রযুক্তির দিক থেকে ফক্স অনূন্য ছিল। আমি ক্রমশ বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম ফক্স আমাদের কোম্পানিকে রূপান্তর করতে সক্ষম। যদি আমরা সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর কৌশল নির্মাণ কালে দ্রুততার সাথে তাদের অধিগ্রহণ করে মসৃণভাবে একিভূত করতে পারতাম তবে ডিজনি আগের চেয়ে ভবিষ্যতে শক্তিশালী অবস্থানে যেতে সক্ষম হবে।

অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা এগিয়ে যাওয়ার পথে রুপার্টের মনে তিনটি জিনিস কাজ করছিল। এক. সম্ভাব্য কোম্পানিগুলো যারা ফক্স কিনতে আগ্রহী তাদের মধ্যে ডিজনিই নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী সংস্থার অনুমোদনের সম্ভাব্য সঠিক পথ দেখিয়েছে। দুই. ডিজনি স্টকের মূল্য। তিনি প্রত্যাশা করছিলেন ফক্সের নিয়ন্ত্রণকারী মালিকানা পাবেন অথবা সম্মিলিত কোম্পানির একটা বড় অংশের মালিক হবেন। তিন. তার আত্মবিশ্বাস ছিল আমরা দুটি কোম্পানিকে মসৃণভাবে একীভূত করতে সক্ষম এবং একটা গতিশীল পথে কোম্পানিটি পরিচালনা করা আমাদের জন্য কোন ব্যাপার না।

২০১৭ সালের পুরো বর্ষা মৌসুম জুড়ে আমরা রুপার্টের অনেক চ্যালেঞ্জ আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বেশিরভাগ বাধা-বিপত্তি এসেছিল রুপার্টের দুই সন্তান লাচলান এবং জেমসের কাছ থেকে। তারা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন তাদের বাবা কিভাবে তিল তিল করে কোম্পানিটি গড়ে তুলেছেন। তারা আশা করেছিলেন একদিন তারাই কোম্পানিটির মালিক হবেন। এখন তিনি কোম্পানিটি আর একজনের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের কারও কাছে এটি সহজ বিষয় ছিল না। শুরু থেকেই আমার অবস্থান ছিল রুপার্টকেই তার পারিবারিক গতিশীলতা পরিচালনা করতে হবে এবং আমরা আমাদের ব্যবসায়িক আলাপ-আলোচনার চালিয়ে যাবো।

পুরো বর্ষা মৌসুম জুড়ে কেভিন মায়ার এবং আমি বেশ কয়েকজনের সাথে মিটিং করেছি, এরা হচ্ছেন রুপার্ট এবং তার সিএফও জন ন্যালেনের সাথে অনেক বার। আমরা অধিগ্রহণের জন্য একটি অল-স্টক অফার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। যখানে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ২৮ ডলার বা কোম্পানির মূল্য ৫২.৪ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হল। রুপার্টের সাথে আমাদের প্রাথমিক কথোপকথনের কয়েক মাস পরে তথ্য ফাঁস হয়ে গেল যে রুপার্ট তার কোম্পানি বিক্রি করার চিন্তা করছেন। ফলে অন্য কোম্পানিও টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি ফক্স অধিগ্রহণের কথা বিবেচনা করতে শুরু করল। কমকাস্ট আমাদের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হল। তারাও একটা অল-স্টক বিড তৈরি করল যেখানে আমাদের তুলনায় যথেষ্ট উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা ছিল। তবুও আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম কারণ কমকাস্টের প্রাথমিক বিড মূল্য বেশি থাকলেও ফক্স বোর্ড আংশিকভাবে আমাদের পক্ষে মত দিবে কারণ কমকাস্টকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। (তারা ইতিমধ্যেই এনবিসি-ইউনিভার্সালের মালিকানা পেয়েছে, সেই সাথে তারা দেশে বৃহত্তম বিতরণ কোম্পানি হিসেবে ব্যবসা করছে এবং তাদেরকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তীব্র যাচাই-বাছায়ের সম্মুখীন হতে হবে)।

কেভিন এবং আমি থ্যাঙ্কসগিভিং সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রুপার্ট এবং জনের সাথে বেলএয়ারে মদ প্রস্তুতকারী কারখানায় দেখা করতে গেলাম। আমরা চারজন দ্রাক্ষালতার সারি দিয়ে দীর্ঘ হাঁটতে বের হলাম। হাঁটা শেষে রুপার্ট বললেন যে তিনি শেয়ার প্রতি ২৯ ডলারের কমে বিক্রি করবেন না অর্থাত যে দামে আমরা ফক্স কিনতে চেয়েছিলাম তার চেয়ে ফক্সের মূল্য আরও প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের মত বেশি পড়ে যাচ্ছে। আমার অনুমান তিনি ভেবেছিলেন আমি কমকাস্টের অফার নিয়ে চিন্তিত এবং অপেক্ষাকৃত বেশি দামে কিনতে রাজি হব। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমি যে দামে কিনতে চেয়েছি সেটা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারলে বেঁচে যায়। আমি তাদের কোম্পানির অনেক বিষয়ে মোহিত ছিলাম এবং আমি বিস্তারিত কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম নতুন ব্যবসাটি আমাদের জন্য কি কল্যাণ বয়ে আনবে। কিন্তু কোম্পানিটি ডিজনির সাথে একিভূত করে চালু করতে বিপুল ঝুঁকি জড়িয়ে ছিল। সব কাজ সম্পন্ন করতে অনেক সময় আর শক্তির প্রয়োজন হবে। এমনকি আমরা যদি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে পারি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পাই এবং সফলভাবে দুটি কোম্পানি একিভূত করতে সক্ষম হই তারপরও বাজারে অজানা অনেক বিষয় আমাকে উদ্বিগ্ন করে। তাছাড়া আমি নিজেও খানিকটা বিধ্বস্ত, কারণ কোম্পানিতে আমি মাত্র তিন বছর আছি। এ অবস্থায় ফক্স ক্রয় আমার জন্য বা ডিজনির জন্য ভাল হবে কি? আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলাম না। আবার আমার চিন্তা করার জন্য বেশি সময়ও হাতে নেই। মিটিং শেষে আমি চিন্তা করলাম চুক্তি সম্পন্ন করার বাইরে থকে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম সেটিই পরম পাওয়া। তাই আমি রুপার্টকে না করে দিলাম, বললাম, ‘২৮ ডলারের উপরে আমরা যেতে পারবো না।’
দামের বিষয়ে আমি গোঁ ধরে থাকায় রুপার্ট অবাক হয়েছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু কেভিন চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, তার ধারনা আমরা দাম না বাড়ালে ফক্স কিনতে পারবো না, সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তখনও আমার বিশ্বাস আমরা জয়ী হব। আসলে কমকাস্টের কাছে বিক্রি করা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। সোমবার সকালে অফিসে এসে আমি কেভিনকে বললাম ন্যালেনের সাথে ফোনে কথা বলতে। তাকে বলতে বললাম আমাদের একটা উত্তর দরকার হ্যা অথবা না। দিন শেষে রুপার্ট ফোন করে আমাদের বিডমূল্য গ্রহণ করেন এবং আমাকে আবার তাদের মদের কারখানায় আমন্ত্রণ জানালেন। লাচলানও সেখানে ছিলেন এবং আমি ভাবছিলাম কিভাবে ক্রয় চুক্তির সমস্ত বিষয় নিসপন্ন করা যায়। পরের দুই সপ্তাহ আমরা ব্যায় করলাম একটা সূ² সামাধানে পৌঁছার জন্য। তারপর স্টার ওয়ার্সের দ্য লাস্ট জেডি চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করার জন্য ডিসেম্বরের ১২ তারিখে আমি লন্ডনে গেলাম। সে সময় রুপার্টের অফিসে তার সাথে দেখা করলাম। তার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুজনে হ্যান্ডসেক করা অবস্থায় একটা ছবি তুললাম। যেটি ১৪ই ডিসেম্বর অধিগ্রহণ চুক্তি ঘোষণার দিন অবমুক্ত করা হবে। (চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।