হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

অবসরে বই ঘাঁটতে গিয়ে পেয়ে গেলাম আমোস টুটুওলার ‘তাড়িখোর’ বইটি। বইটি হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা আমাকে উপহার দিয়েছিল আমার এক গল্পকার বন্ধু।

বইটার কথা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম। পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে আরো দেখলাম একটা স্থানে আমার হাতে লেখা তারিখ। সেটা বইয়ের অর্ধেকস্থানে-সম্ভবত অর্ধেক পড়েছিলাম। আবার পড়া শুরু করলাম নতুনভাবে। বইটা অনুবাদ করেছেন জি. এইচ. হাবীব, আর প্রকাশ করেছে ‘সন্দেশ’ ১৯৯৫ সালের বইমেলায়। প্রথমেই অনুবাদকের কথা পড়লাম। এরপর পড়লাম মাইকেল থেলওয়েল-এর ভূমিকা (১৯৮৪)।

ভূমিকায় আমোস টুটুওলার (১৯২০-১৯৯৭) রচনারীতি সম্পর্কে লেখা আছে-যে ইংরেজিতে টুটুওলা লিখে গেছেন তা আমাদের চেনা ইংরেজির বাইরে। সমালোচকেরা বলেছেন ভুল ও কাঁচা ইংরেজি। অনুবাদক বলেছেন-তাড়িখোর’র গ্রোভ প্রেস ১৯৮৪ সংস্করণে মাইকেল থেলওয়েল (Michael Thelwell : জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯, জ্যামাইকান ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক-সমালোচক) লিখিত ভূমিকায় তিনি লিখেছেন: ‘This is not simply ‘young English’ but new English, an English whose vocabulary is bent and twisted into the service of a different language’s nuances, syntax, and interior logic. The result is original and often startling.’

তারপর আমোস টুটুওলা সম্পর্কে জানতে ইন্টারনেট সার্ফ করলাম। তাতে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত করেছে তা হলো-টুটুওলার ‘দি পাম ওয়াইন ড্রিকাংর্ড’ উপন্যাসটি ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তবতায় ভরপুর, যদিও টুটুওলার বইটি প্রকাশের বছর (ব্রিটেন, ১৯৫২ ও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৩) পর্যন্ত ম্যাজিক রিয়েলিজম টার্ম আবিষ্কৃত হয়নি। সেটা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে।

বইটি পুনর্বার পড়ার সময় মনে পড়ছিল টুটুওলার সম্পর্কে আমার পূর্ব পঠনের খানিকটা, এবং এটাও মনে পড়ল যে, আমি বইটা তখন পড়ার সময় এটাকে মনে হয়েছিল একেবারেই বাচ্চাদের শোনানোর মতো রূপকথা। এমনকি ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’র চেয়েও আজগুবি সব ঘটনার বর্ণনা। তবে, ভূমিকা পড়ে ভাবলাম, একটা রচনাকে বিচার করতে হবে এর কাল, সংস্কৃতি, সমাজ, শাসন ও ঐতিহ্য ও বিশ্বাস, ধর্ম ও রীতিনীতি দিয়ে। উপরন্তু নাইজেরিয়ায়, তথা আফ্রিকার অনেক দেশেই ঔপনিবেশিক শাসন ছিল, ছিল অন্ধবিশ্বাস ও ভূত-প্রেতের অস্তিত্বের ঘনঘটা। তাই এর মূল সাহিত্য রস উদঘাটনের জন্য বইটা আবারও পড়লাম। একট রসের আস্বাদন অবশ্য পেয়েছি। সেটা হলো জাদুবাস্তবতার উপকরণাদি।
তবে, আমি গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’ বা হোর্হে লুইস বোর্হেসের Doctor Brodie’s Report (ডক্টর ব্রডি’র প্রতিবেদন) পড়ে জাদুবাস্তবতাকে যেভাবে বুঝেছি, তেমনভাবে পাম-ওয়াইন ড্রিংকার্ড পুনঃপঠন করে এর সাহিত্য রসের আস্বাদন পাইনি।

‘ডক্টর ব্রডির প্রতিবেদন’-এও জীবজন্তু বা অদ্ভুত মানুষের বর্ণনা আছে আর তেমনিভাবে ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’-এও যুগমানস ফুটিয়ে তুলতে কাল্পনিকতার, তথা জাদুবাস্তবতার আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তবে টুটুওলায় জীবজন্তু ও কর্মকাণ্ডের বাহুল্য নেই। তাই ‘তাড়িখোর’ পড়ার পর নিজকে শুধু তাড়ি কেন, পৃথিবীর যে কোনো কুখ্যাত বা বিখ্যাত মদ্যরসে মত্ত হবার মতো দশা হবে।

একথা যখন লিখছি, তখনই জাদুবাস্তবতার মতো, টুটুওলার মতো অন্তত একটা বিষয় তড়িৎবেগে আমার মাথায় খেলে গেল, আর খুঁজে পেলাম একটা সাহিত্য রস! সেটা হলো, উত্তমপুরুষে বর্ণিত এই উপন্যাসে উত্তমপুরুষ মানে নায়ক একজন তাড়িখোর, আর সে যেমন তেমন তাড়িখোর না-এক বসায় সে চল্লিশ ঠিল্লা পর্যন্ত তাড়ি সাবাড় করে দেয়। এই তাড়ির প্রভাবে সে কল্পনাতীত ও আজগুবি অনেক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। আর সেসব আজগুবি ঘটনাগুলোর মূলসূত্র কিন্তু তখনকার সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের দেবদেবীর উপাসনা ও বিশ্বাস উদ্ভুত।

যেসব পাঠক জীবনে তাড়ির আস্বাদন পাননি, তারা তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলুন ‘তাড়িখোর’ আর ঘুরে আসুন চেনা-অচেনার মাঝখানের কোনো কল্পরাজ্যে।