খুরশীদ শাম্মী : ভোট যেমন কোনো একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক অধিকার, তেমন তাদের জন্য একটি বিশেষ দায়িত্বও। তবে, ভোটের মাধ্যমে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয় নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর। সকল শ্রেণী ও গোত্রের নাগরিকদের প্রয়োজন ও দাবী বিবেচনা করে জনগণের পক্ষে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। এই কাজটি খুব সহজ নয়, তবে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের জন্য কাজটি কিছুটা হলেও সহজ হয়। কেননা সংসদে বিল উত্থাপন থেকে শুরু করে আইন পাশ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, চুলচেরা বিতর্ক শেষে জনপ্রতিনিধিদের ভোটে বিলটি পাশ করা হয়। এই কাজটি সম্পন্ন করার সময় নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধিদের চিন্তা থাকে যে নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পুনরায় নির্বাচিত হতে জনগণের মূল্যবান ভোট প্রয়োজন হবে।

আমরা নির্বাচন বলতে সাধারণত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বুঝে থাকি। আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচন একটি সহজ বিষয় বলে মনে হলেও বস্তুত নির্বাচন একটি যৌগিক বিষয়। প্রতিটি নির্বাচন শিক্ষণীয়। অতি সামান্য হলেও অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করার মতো বিষয় বিদ্যমান থাকে। এবং তা সকলের জন্যই; হোক ভোটার, প্রার্থী কিংবা দল। যদিও সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হবে ভোটারদের কাজ শুধু ভোট দেওয়া। মূলতঃ তা’ নয়। নির্বাচনের মূল শক্তিই ভোটদাতা, সুতরাং ভোট প্রদানে তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বচ্ছন্দতা গুরুত্বপূর্ণ। এবার ফিরে আসি মূল আলোচনায়, হ্যাঁ, ২০২২ সালের অন্টারিও প্রদেশের ৪৩তম সংসদ নির্বাচনের কথা বলছি। এই তো জুন মাসের দুই তারিখে শেষ হলো যে নির্বাচন, সেই নির্বাচন কেমন ছিল?

নিঃসন্দেহে অন্টারিওর ইতিহাস সৃষ্টি করা একটি নির্বাচন ছিল এটি। ১২৪টি আসনের ৮৩টি আসন জিতে আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করল কনজারভেটিভ দল। ভূমিধস বিজয় বলে দাবি করছে তাদের দলের অনেকেই। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণভাবে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি মনে দাগ কাটবে- তা হচ্ছে, গত চার বছরে কনজারভেটিভ পার্টি এমন কী করেছে যে জনগণ তাদের উপর এতটা ভরসা করতে পেরেছে? প্রশ্নটি যত সহজভাবে জন্ম নিয়েছে, উত্তরগুলো কিন্তু ততই বক্ররেখায় ধাপে ধাপে।

একটু পিছন থেকে যদি দেখি, ২০০৩ সাল থেকে পরপর চারবার অন্টারিও প্রদেশের সাধারণ নির্বাচনে লিবারেল দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আসছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও অন্টারিওতে লিবারেল দলের জয় জয়কার ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে হঠাৎ করে এমন কী হয়েছিল যে কনজারভেটিভ দল একটানে ৭৬টি আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করেছিল? শুধু কি তাই? দীর্ঘ পনেরো বছর একটানা সরকার গঠন করার পর লিবারেল দল মাত্র সাত আসন নিয়ে পার্টির অফিশিয়াল স্ট্যাটাস রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো, অর্থাৎ মর্যাদা যেমন হারালো তেমন অর্থনৈতিকভাবেও তাদের কোমর ভেঙে পড়ল। তখন চল্লিশ আসন জিতে সংসদের অফিশিয়াল বিরোধীদল ছিল নিউ ডেমোক্রেটিক দল। অবশ্য কানাডার ফেডারেল কিংবা প্রাদেশিক নির্বাচনগুলোতে হঠাৎ করে এই রঙ বদলের ঝাপটা, নতুন কিছু নয়। এর কারণ হচ্ছে, সাধারণ ক্যানাডিয়ান জনগণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা নেতা-নেত্রীদের থেকে বরং নিজের চরকায় তেল মাখায় ব্যস্ত থাকার প্রয়োজন বোধ করে অধিক। তারা কোনো দল কিংবা নেতার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে না। তারা তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের জন্য কাজ করার জন্য। সুতরাং যখন তারা মনে করে যে কোনো দল কিংবা নেতা পরিবর্তন দরকার, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তা তারা প্রমাণ করে থাকে। তুলনামূলক অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দলকে নির্বাচিত করে সুযোগ করে দেয়। সেইজন্য অবশ্য এইসব উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশের প্রার্থীদের ভোটারদের বাড়ি থেকে রিকশাভাড়া দিয়ে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয় না, নাগরিকেরা তাদের প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধ থেকেই ভোট দিতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের কানের কাছে মাইক ফাটিয়ে স্লোগান দিতে হয় না, কেননা তারা শব্দ দূষণ অপছন্দ করে। চা-নাস্তা খেতে লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের শত টাকার কড়কড়ে নোট দিতে হয় না, কেননা তারা নেতাদের কাছে বিক্রি হতে অনিচ্ছুক। এদেশে প্রচার পদ্ধতি উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক। কখনো কখনো একই বাড়ি কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লনে একাধিক দলের প্রার্থীর সাইন থাকতে দেখা যায়, একই বাড়িতে একাধিক দলের সমর্থক থাকে, অফিসে সহকর্মী কিংবা প্রতিবেশী ভিন্ন দল সমর্থন করলেও তারা পরস্পর লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধে নামে না; বরং আলোচনা করে গভীর থেকে গভীরতর সমস্যাগুলো। অবশ্য ইদানীং অনেকক্ষেত্রে ভিন্ন ধারায় বিভিন্ন বিষয় চালু হতে দেখলে ভয় হয়, কবে যেন কানাডার গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দেবো আমরা।

যাক্! ফিরে আসি মূল বিষয়ে। অনেকেই মনে করে যে ২০১৮ সালের অন্টারিও প্রদেশের নির্বাচন ছিল প্রমাণিত একটি পরিবর্তন জরুরি নির্বাচন। তবুও, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড বিভিন্ন সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। করোনা মহামারীতে তার অবস্থান যতটা প্রশংসনীয় ছিল, ঠিক ততটাই নিন্দনীয় ছিল কোনো কোনো বিশেষ পেশাজীবীদের কাছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রতিশ্রুতি জ্বালানী তেলের মূল্য হ্রাস তো দূরের কথা বরং বর্তমানে জ্বালানী তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া। তিনি কিংবা তার সরকার জ্বালানী তেলের মূল্যহ্রাসে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। গত দুইবছরে বাড়িভাড়া, খাদ্য, বস্ত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়েছে বহুগুণ। সাধারণ কর্মজীবীদের জন্য মৌলিক চাহিদাগুলো মিটিয়ে বসবাস করা অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। বিরোধীদল হিসেবে এনডিপি গত চার বছর চেষ্টা করেছে সরকারকে সর্বদা প্রবল চাপের মুখে রাখতে। তারপরও তারা ২০২২ সালের নির্বাচনে নয়টি আসন হারালো এবং কনজারভেটিভ দল কীভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করে এত বড় একটা বিজয় অর্জন করল?

একটু সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই বিজয়কে বিজয় নয়, বরং জনগণের অভিমান, অভিযোগ হিসেবে দেখতে হয়। মহামারীর কারণে এবার নির্বাচনের নির্ধারিত দিনের পূর্বে পাঁচদিনের পরিবর্তে দশদিন অগ্রিম ভোট গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়াও, বিশেষ বিবেচনায় মেইলে করে ভোট, বাসস্থানে বসেও ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তবুও তেতাল্লিশতম অন্টারিও সংসদ নির্বাচনে মাত্র তেতাল্লিশ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। বাকি সাতান্ন শতাংশ মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকে তাদের অভিমান, অভিযোগ পেশ করেছে। নির্বাচনের পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকগণ পথের মাঝে জনগণ থামিয়ে যে ছোট ছোট ইন্টারভিউ নিয়েছেন, সেখানে অনেকে অভিযোগ তুলেছে যে প্রার্থীদের তাদের পছন্দ ছিল না। অনেকে বলেছে যে সকল রাজনৈতিক নেতা-ই সমান, সুতরাং কে নির্বাচিত হলো, কে হারলো, তা’ খুব একটা তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে না। আবার অনেকে অভিযোগ তুলেছে যে সবকিছুর মূল্য এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, অথচ রাজনীতিবিদরা সঠিক কোনো কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে বাকী বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স সংগ্রহ করে নিজেদের বেতনটা ঠিক রাখা। অনেকে অভিযোগ তুলেছে যে তাদের একাধিক কাজ করতে হয় জীবিকার জন্য, ভোটের জন্য সময় নেই তাদের হাতে। এই অভিযোগগুলো নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন জনের সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ ও আলোচনার বিষয়ের সাথে মিলে যায় অনেকটাই। অর্থনৈতিক চাপে রাজনীতিবীদদের প্রতি সাধারণ মানুষ বিশ্বাসটা হয়তো হারাতে বসেছে।

ভাটার পর জোয়ার আসে, নতুন পলি ফেলে যায়। নির্বাচন শেষে লিবারেল দলনেতা স্টিভেন ডেল ডুকা ও এনডিপি দলনেতা এন্ড্রিয়া হরওয়াথ উভয়ের নিজ নিজ দলের দলনেতা পদ থেকে সরে দাঁড়ানোটা অনেকটা তেমনই ইতিবাচক একটা বিষয় বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত হয়তো অন্টারিও রাজনীতিতে বিরাট একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নতুন দলনেতা আসবে দল ও জনগণের জন্য নতুন নতুন আইডিয়া ও সুযোগ নিয়ে। রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নাগরিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে হয়তো তাদের সিদ্ধান্ত একটা বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

জন্ম থেকে মানুষ পদে পদে শিখে। এরপরও বলা হয় শেখার শেষ নেই। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। বিভিন্ন দলের দলনেতা নির্বাচনে হেরে গিয়েও নির্বাচিত প্রিমিয়ারকে অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি। প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড তার বিজয়ী বক্তব্যে জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য বিরোধী দলের দলনেতাদের প্রশংসা করেছেন, তিনি তাদের হেয় করেননি ভিন্ন দল ও ভিন্ন মত প্রকাশ করার জন্য, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্য। এবারের অন্টারিও নির্বাচনকে ঘিরে অনেকেই হয়তো নাগরিকদের নির্বাচন প্রত্যাহার বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, বিশেষ করে আমার মতো ক্ষুদ্র আয়তনের উন্নয়নশীল কিন্তু ভোট-কারচুপিতে পাকা দেশে বেড়ে ওঠা অভিবাসীগণ। আশাকরি কানাডার মতো গণতান্ত্রিক একটি দেশে নতুন রাজনীতিবিদেরাও এবারের অন্টারিও নির্বাচন থেকে নিজেদের থলায় কিছু সংগ্রহে রাখবেন।