নাদিরা তাবাস্সুম : শেষ বিকেলে লেকের পাশের লম্বা রাস্তা ধরে সুজাত হাঁটছে আর ভাবছে সামারের রৌদ্রজ্জ্বল গরম আবহাওয়ায় আসলেই ঘরে বসে থাকা যায় না। তাই বিকেল বেলা লাকের ধারের নির্মল বাতাসের টানে এত মানুষের আনাগোনা। পশ্চিম কোণে বিরাট অগ্নিগোলক সদৃশ সূর্যটা সারা দিনে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদক‚লের মাঝে প্রখর আলো ও উত্তাপ ছড়িয়ে ক্রমে ক্রমে দিগন্ত কোণে মনে হয় যেন পানির অতল তলে ডুবতে চলেছে। খন্ড খন্ড সাদা কালো হাল্কা মেঘেরা আশপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহা কি অপরূপ সৌন্দর্য! সারাদিন এত বড় একটা দায়িত্ব পালন শেষে সূর্য কি এক তৃপ্তিময় শান্তি নিয়ে আপন ঠিকানায় চলে যায় আবার পরের দিন নতুন দিনের বার্তা নিয়ে উদিত হয় পূর্ব কোণে। কারও কাছে কোন চাওয়া পাওয়া নেই; শুধুই মানুষ ,প্রাণীক‚ল ও অন্যান্য সকল সৃষ্টির জন্য তাপ ও আলো বিকিরণ করে তাদের বাঁচিয়ে রাখা! পৃথিবীর সকল সৃষ্টিই তো একই উপাদান দিয়ে তৈরী তাহলে মানুষ ও প্রাণীক‚ল এত স্বর্থান্ধ, হিংস্র ও লোভী হয় কেন? – আর সে কারণেই পৃথিবীজুড়ে এত যুদ্ধ বিগ্রহ হানাহানি।

অথচ প্রত্যক মানুষই কোন না কোন মহৎ দায়িত্ব পালনের জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। আমাদের বাবা-মায়েরা এমনই নিঃসবার্থ ভালোবাসা দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন এবং তাদেরকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন, বিনিময়ে কিছুই আশা করেন না। সুজাতের বাবা-মা একই কথা বলেছিলেন “বাবা, তোমাদের আমরা মানুষ করেছি যাতে তোমরা নিজেরা ভালো থাকো; তোমরা আমাদের বুড়ো বয়সে দেখাশোনা করবে এই আশা নিয়ে নয়”। এখন তাদের বয়স বেড়েছে কিন্তু কাছে দেখাশোনা করার কেউ নেই। ভাই-বোনেরা সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সুজাতের সবসময় তাদের কথা মনে হয় কিন্তু দূর থেকে যেটুকু সাপোর্ট করা যায় সেটুকুই করতে পারে। যে বাবা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে অনেক শক্ত সামর্থ ছিলেন। প্রায়ই বলতেন “জীবনের যেকোন পরিস্থিতিতে হাসিখুশি থাকবে, ধীর স্থির ভাবে চিন্তা করবে, দেখবে সমাধান খুঁজে পেয়ে যাবে। আমরা জীবনে সাফল্য বলতে সাধারনভাবে সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি, প্রচুর অর্থ সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা অথবা বড় চাকুরী এগুলো বুঝি কিন্তু এগুলো এক ধরণের মাপকাঠি হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো মনে কতখানি শান্তি দেয়, পরিবার প্রতিবেশী সমাজ সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় আছে কিনা, শরীরে সুস্থতা ও মনে সন্তুষ্টিবোধ আছে কিনা, আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা কতটুকু, পাপ ও অন্যায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ কিনা, প্রকৃত ধার্মিকতা বজায় রাখা যায় কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে সাফল্য নির্ভর করে। ‘Success is a journey , not a destination’. সাফল্য লাভে প্রয়োজন হয় বুদ্ধিমত্তা, সাহস, ধৈর্য ও অধ্যবসায়।

সেইসাথে যদি থাকে সততা ও সদাচরণ”। সুজাত ভাবতে পারছে না যে এই বাবা বেশ কিছুদিন যাবত শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। করোনা মহামারী চলাকালে কিছু বয়োবৃদ্ধ আত্মীয়ের পাশাপাশি কিছু কম বয়সী আত্মীয়ের অকাল মৃত্যু দেখে তিনি খুউব হতাশাগ্রস্থ। স্ত্রী এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে সেদিন যে আত্মীয় পৃথিবী ছেড়ে অকালে বিদায় নিলো তা পরিবারের সকলকেই মর্মাহত করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সী টগবগে তরুণ – লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেছে। শহরে চাকুরী করছে, সুন্দর একখানা বাড়িও কিনেছে। স্ত্রী এবং দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই সংসার কাটছিল। হঠাত রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। এরপর থেকে ক্রমেই জটিলতা বাড়তে থাকে। কয়েক বছর রোগে ভোগার পর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো।

সুজাত বাবাকে বলেছে “বাবা, তুমিই তো প্রায়ই বলে থাকো ‘Life is a journey towards death” সুতরাং জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা ভবে! তারপর এও বলো যে ‘এমন জীবন হবে করিতে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’! তুমি বলতে যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আবার যখন সময় হবে তুলে নেবেন; কেউ আগে কেঊ পরে- এই আরকি। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন “বরকতময় সেই সত্ত¡া, যার হস্তে নিহিত রয়েছে সর্বময় কর্তৃত্ব। তিনি সর্বশক্তিমান। যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করলেন, তোমাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য?” (সূরা মূলক ; আয়াত ১-২)।

“আর আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কারও মৃত্যু হ্তে পারে না; যেহেতু প্রত্যেকের মেয়াদ নির্ধারিত” (সূরা আল ইমরান; আয়াত ১৪৫)।
“জীব মাত্রই মৃত্যবরণ করবে; অবশ্যই কিয়ামতে তোমাদের পূর্ণ প্রুস্কার দেয়া হবে। যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে নেয়া হবে, সেই সফলকাম। দুনিয়াবী জীবন শুধুমাত্র ছলনাময়, ক্ষণিকের ভোগের সামগ্রী মাত্র” (সূরা আল ই্মরান; আয়াত ১৮৫)”।
তাই বলি বাবা, এখন আমরা শোকে হতাশাগ্রস্থ না হয়ে বরং সেই পরিবারকে কিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

তুমি আমাদের জানাও যে ,আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে কিভাবে সাহায্য করতে পারি। বাবা এসব শুনে খুশী হয়েছেন এবং বাবাকে বোঝাতে পেরে সুজাতও মনে শান্তি পেয়েছে। বিকেল বেলা তাই একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে একাই লেকের ধারে হাঁটতে এসেছে।