শুজা রশীদ : (পর্ব ৪৭)
সার্জারীর একদিন পরই হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হল রিমাকে। তার সার্বিক অবস্থা খুব ভালো বিধায় ডাক্তার অকারণে তাকে হাসপাতালে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী সময় রাখতে চান নি। রিমার মনে হয়েছে ওর মাথার উপর থেকে যেন একটা বিরাট বড় বোঝা নেমে গেছে। ভবিষ্যতে কি আছে কে জানে কিন্তু আপাতত এই ঝামেলা থেকে যে রেহাই পাওয়া গেছে তাতেই ও খুশী। নোমান একাই এলো ওকে হাসপাতাল থেকে নিতে। নোমানকে দেখে ওর দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। চারদিকে তাকায়, বাচ্চাদের খোঁজে। নোমান প্রতিজ্ঞা ভেঙে ওর কাছে রহস্যটা ফাঁস করে দেয়। ওর বাসায় ফেরা উপলক্ষ্যে বাচ্চারা বেলুন দিয়ে বাড়ীর ভেতর সাজাচ্ছে। আরোও নানা ধরনের পরিকল্পনা চলছে ওকে চমকে দেবার জন্য। রিমাকে কথা দিতে হল বাসায় গিয়ে ও খুব বিস্মিত হবার অভিনয় করবে।

বাসায় ফিরে দেখল চারদিকে নানা রঙের বেলুন আর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। ওকে স্বাগতম জানাতে লিয়াকত এসেছে তার পরিবার নিয়ে। জাফর এদিকেই বাড়ী দেখাতে এসেছিল। সেও হাজির হয়েছে। অনেকেই তার মঙ্গল কামনা করে ভয়েস মেইলে মেসেজ রেখেছে, টেক্সট করেছে। মিলা বাচ্চাদেরকে নিয়ে ওর সম্মানে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। রিমা হাসি মুখে বসে থাকল। খুব ক্লান্ত লাগছিল, বিছানায় গিয়ে এলিয়ে পড়তে পারলে ভালো হত, কিন্তু ওদের মনে কোন ভাবেই সে কষ্ট দিতে চায় নি। হিন্দি গানের সাথে সাথে সব বাচ্চাগুলোকে নিয়ে খুব নাচল মিলা। রিমার দুই চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রæ নামল। সার্জারির আগে ওর কেন যেন মনে হয়েছিল আর কোনদিন এদের সাথে দেখা হবে না। খুব সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে ওর অপারেশন থিয়েটারে। বাসায় ফিরে এসে মনে হচ্ছে যেন নব জীবন পেয়েছে।

অবশেষে অনুষ্ঠান শেষ হতে নিজের বিছানায় গিয়ে যখন শুলো তখন মিলা ওকে ভয়েস মেইল থেকে সব মেসেজগুলো একে একে শোনাল, বিশেষ করে পিন্টুরটা।
ভাবী, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয় আমকে জানাতে দ্বিধা কর না।
ভাবী! পিন্টু তাকে কখন ঐ শব্দটা ব্যবহার করে ডেকেছে কিনা মনে করতে পারে না রিমা। এতো দিন ধরে যেভাবে সারাক্ষণ কটু কথাবার্তা বলে এসেছে তার সাথে তুলনায় একটা সাধারণ ভাবী-ই অতিরিক্ত মধুর শোনায়।
রিমা বান্ধবীর দিকে তাকায়। “এটা কি আমাদের পিন্টুই?”

মিলা কাঁধ ঝাঁকায়। “মানুষ বদলায়। হয়ত বউ বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ায় ওর মধ্যে কোন একটা পরিবর্তন এসেছে। কে জানে?”
“ওকে বিশ্বাস করা যায় না,” রিমা বলে। “এটা ওর আরেকটা চাল হতে পারে।”
মিলা নোমানের দিকে তাকাল। সে কাছেই দাঁড়িয়ে রিমাকে দেখছিল। “নোমান! তোমার কি মনে হয়?”
নোমান নীরবে কাঁধ ঝাঁকায়। সে কি বলবে?
রিমা ঝট করে দু’জনার উপর চোখ বোলায়। নোমান! নোমান বয়েসে মিলার চেয়ে অনেক বড়। প্রথাগতভাবে ভাই বলে ডাকারই কথা। তাদের কি ইতিমধ্যেই নাম ধরে ডাকার মত ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে? নিজের বুকের ধুকপুকানিটা পরিষ্কার শুনতে পায় ও। বুঝতে পারে ওর ঈর্শা হচ্ছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই।

ওর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার কথা ছড়িয়ে পড়তে একে একে আরোও অনেকে এলো ওকে দেখতে। মরিয়ম দোলন আর মেয়েদেরকে নিয়ে এলো। অনেক্ষণ থাকল। নীতা এবং লাট্টু ছেলে দু’জনের জন্য কিছু খেলনা নিয়ে এলেন। মানিক তার দোকানের বিশাল এক বাক্স মিষ্টি হাতে হাজির হল। শেফালি আসেনি। ওর সার্জারির আগে দোকানের কাজটা ছেড়ে দেয় রিমা। ফ্যাশানের ব্যাবসায়ে পুরো মনযোগ দিতে চায় ও। শেফালি হয়ত সেই কারণে এখনও ওর উপরে ক্ষেপে আছে। কালাম এলো ওর দুই সহকর্মীকে নিয়ে- ঢাকা গ্রোসারির মিট কাটার রহমান আর আখন্দ। এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে ওর পরিচিত কিছু মহিলার এলো। রজনী কালামের মুখে শুনে ওর স্বামীকে নিয়ে এলো। আরিফা এক বন্ধুর মুখে শুনে পাবলিক বাসে চেপে ওকে দেখতে এলো। তাকে দেখে রবিন খুব খুশী হয়ে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকল। আরিফা এতো খুশী হয়ে গেল যে সে হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিল। এতো মানুষ ওকে দেখতে আসবে কখন কল্পনাতেও ভাবে নি রিমা। ও একটু হতভম্বই হয়ে গেছে। নিজের কাছেই স্বীকার করতে বাধ্য হল, ধীরে ধীরে যে এই শহরে এতো মানুষ ওর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে সেটা ও কখন চিন্তাও করেনি।

দুই দিনও পার হয়নি, রিমা দোকানে চলে গেল। দোকানটা চালু না করা পর্যন্ত ওর যেন শান্তি নেই। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকী। কালামকে বলেছে দোকানের জন্য আসবাবপত্র কোথায় কিনতে পাওয়া যায় তার খোঁজ খবর নিতে। একজন ছুতারমিস্ত্রিও দরকার দেয়ালের সাথে লাগোয়া কিছু শেলফ বানানোর জন্য। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ কিংবা ভারতে এমন একজন বা দুইজন বিশ্বস্ত মানুষ থাকা যারা ওকে রুচিশীল শাড়ি এবং অন্যান্য পোষাক-আষাক বেছে বেছে পাঠাবে। এই শহরে অধিকাংশ মহিলারা যারা এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তারা হয় নিজেরা দেশে গিয়ে কিনে নিয়ে আসে নয়ত তাদের কোন বন্ধু বা আত্মীয়া তাদের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। রিমার জানা শোনার মধ্যে তেমন কেউ নেই। ওর ভাইটা যদি বিয়ে টিয়ে করত তাহলে তার বউয়ের সাথে সে জোট পাকাতে পারত। কিন্তু রনকের সাথে আলাপ করে মনে হয়েছে বিয়ে টিয়ে করার তার এই মুহুর্তে কোন আগ্রহ নেই। তার এখনও বয়েস ত্রিশও হয়নি, এতো তাড়া কিসের? আচ্ছা, বউ না থাক, সে নিজে কি রিমার সাথে কাজ করতে আগ্রহী? এতো বছর পর রিমা যদি এই জাতীয় একটা প্রস্তাব তাকে দেয়, কিভাবে নেবে সে?

সাড়ে চার মাস পর, জুলাই মাসের মাঝামাঝি এখানে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সেটা সবচেয়ে বড় উত্সব। ওর ইচ্ছা ঈদের আগেই দোকানটা চালু করে ফেলা। ঐ সময়েই দেশী পোশাক আষাক সবচেয়ে বেশী বিক্রী হয়। দেশী মানুষদের জন্য এই ঈদ হচ্ছে ক্রিসমাসের মত যখন পশ্চিমা দেশগুলোতে অধিকাংশ ব্যবসাই তাদের সারা বছরের প্রায় আশী ভাগ ব্যবসা করে। রিমা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ- এই ঈদ তাকে ধরতেই হবে।

৬৮
ডানফোর্ত রোড আর কক্সয়েল রোডের সন্ধিক্ষণে যে ম্যাকডোনাল্ডসটা অবস্থিত সেখানে দুপরের একটু পরে এসে হাজির হল দোলন। গাড়ি পার্কিং করে, দোকানে ঢুকে এক কোনে একটা টেবিল নিয়ে বসল ও। এবার অপেক্ষার পালা। ওর বুক কাঁপছে, কপালে দুশ্চিন্তার ঘাম। এর আগে এমন টা সে আর কখন করেনি। আদতেই এভাবে এখানে আসাটা উচিত হয়েছে কিনা সে নিশ্চিত নয়। কেউ যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে? মানুষ সব সময় অন্যের দোষ ত্রুটি ধরবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা হয়ত বুঝবেও না এভাবে লুকিয়ে দেখা করতে আসার পেছনে ওর কি কারণ থাকতে পারে। মাঝে মাঝে প্রিয় কোন বন্ধুকে সাহায্য করবার জন্য একটু ঝুঁকি তো নিতেই হয়, তাই না?

সমস্যা হয়েছে, কালাম যে আসতে এতো দেরী করবে ও বুঝতে পারেনি। ঠিক দুপুরে এখানে দুজনার দেখা করার কথা ছিল। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে হয়েছে দশ, দশ হয়েছে বিশ, কালামের কোন দেখা নেই। গেল কোথায় পাগলাটা? ফোন দিয়েছিল। যখন ড্রাইভ করেন তখন আবার জনাব ফোন ধরেন না। চমত্কার! একটা ব্লু টুথ কিনতে কি হয়? দোলন ভাবছে এবার ও নিজেই একটা কিনে দেবে।

শেষ পর্যন্ত কালাম যখন হাঁপাতে হাঁপাতে নাটকীয়ভাবে দৌড়ে ভেতরে ঢুকল তখন বারোটার পর প্রায় পঁচিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। দুই হাত করজোড় করে ম্লান হাসি দিয়ে ক্ষমা চাইল। “এতো অসম্ভব ভীড় ছিল রাস্তায়!” দম নিতে নিতে বলল। “পাগলের মত হর্ন দিচ্ছিলাম সবাইকে। জানি তুমি এখানে এসে বসে থাকবে। এবারে মত মাফ করা যাবে?”

দোলন খিল খিল করে হেসে ওঠে। ছেলেটা জানে কিভাবে মানুষের মন গলিয়ে ফেলতে হয়। “আচ্ছা যাও, মাফ করে দিলাম। এবার খাবারের অর্ডার দাও। ক্ষিধায় আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে।”
“জ্বী, ম্যাডাম। কিন্তু প্রশ্ন হল আমরা কি আরেকটু ভালো কোন রেস্টুরেন্টে যাবো? লাহোর কাবাবে যাবে? কাছেই।”

দোলন মাথা নাড়ল। “কালাম, এটাই ঠিক আছে। আমি বেশি ঘোরাঘুরি করতে চাই না। কেউ দেখে ফেলবে।” নিজের চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে।
“একজন বন্ধুর সাথে বাইরে দেখলেই বা কি সমস্যা? তুমি অযথা ভাবছ, দোলন ভাবী!” কালাম বলে। ছোটাছুটি করে রেস্টুরেন্টে ঢোকা অবধি এই প্রথমবারের মত দোলনের দিকে ঠিক ভাবে তাকায় সে। একটা সুন্দর ফুল দেয়া কামিজ আর সাদা সালোয়ার পরেছে দোলন, গলায় ম্যাচিং কাজ করা ওড়না, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই সেজেছে আজ। খুবই সুন্দর লাগছে তাকে। কালাম দুই চোখ বড় বড় করে ফেলল। “ও খোদা! তোমাকে যে কি সুন্দর লাগছে! পাগল হয়ে যাবার মত!”

দোলন লজ্জা পেয়ে গেল। “একদম চুপ! যাও, আমার জন্য কিছু ফ্রাইস, আর একটা চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়ে এসো। ও, আর কোক।”
“যাবো আর আসবো।” কালাম ছুটল। আজ এভাবে দোলনের আসার পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। এখান থেকে পিন্টুর রেস্টুরেন্ট বেশি দূরে নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আহমেদ’স। এটা কালামের নিজেরই করতে পারা উচিত ছিল কিন্তু সেই দিন মারপিট করার পর থেকে ঐ রেস্টুরেন্টটার ধারে কাছেও যেতে চায় না ও। সুফির সাথে অবশ্য এখনও যোগাযোগ আছে। হয়ত তাকেই অনুরোধ করা যেত কিন্তু দোলন যখন রাজী হয়ে গেল তখন অন্য কাউকে বলার তো কোন কারণই থাকতে পারে না।

অর্ডার খুব দ্রুতই চলে এলো। কালাম ট্রেতে করে খাবার নিয়ে টেবিলে নিয়ে এলো। “ভাবী, কথা দিচ্ছি পরের বার আমি তোমাকে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবো।”
দোলন হাসল। “যদি কাজ হয় তাহলে।” দোলন মুখে এক টুকরো ফ্রাইস ভরে, ঠান্ডা কোকে চুমুক দিল। “ফ্রাইসটা খুব মজার। আমার ফাস্ট ফুড যা ভালো লাগে! কিন্তু ওনার পছন্দ না। বলে এসব নাকি অস্বাস্থ্যকর।”
কালাম জানে দোলন কখন তার স্বামীর নাম নেয় না। লক্ষ্য করেছে বাংলাদেশের অনেক মহিলারাই এই রীতিটা মেনে চলেন। স্বামীকে তারা হয় সে, নয় উনি, কিংবা বড় সন্তানের নামের পর বাবা যোগ করে ডাকেন।

কালাম নিজের স্যন্ডউইচে বড় একটা কামড় দিল। “তোমার নিজেরই তো গাড়ী আছে। তোমার ইচ্ছা হলে তো তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো, যা ইচ্ছা তাই খেতে পারো।”
দোলন মাথা নাড়ল। “আমি ঐ রকম করতে পারি না। মনে হয় যেন ওনাকে ধোঁকা দিচ্ছি। উনি ঠিকই বলেন। এই সব খাবারে অনেক চর্বি, সুগার আর সোডিয়াম। কোনটাই বেশী পরিমাণে শরীরের জন্য ভালো না।”

“তোমার স্বামী কি কখন তোমার সাথে রেগে যান?” কালাম কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়।
“কক্ষন না। আমার চেয়ে তার বয়েস অনেক খানি বেশি, জানই তো। খুব ঠান্ডা-ঠুন্ডা স্বভাব। ভালো মানুষ। সহজ সরল পেয়ে অনেকেই সুযোগ নেয়। পিন্টু আর তার মা ওনাকে অনেক অসম্মান করেছে। তারপরও উনি মুখ বুঁজে ছিলেন। মানুষটা ঐ রকমই।”
“তুমি তাকে ভালোবাসো?” কালাম ঝট করেই প্রশ্নটা করে বসে।

“মনে হয়,” দোলন দ্বিধা নিয়ে বলে। “কেন বাসবো না?” তাকে চিন্তিত দেখায়। তারপর হঠাত কালামের দিকে ফিরে জানতে চায়, “এই ছেলে, তুমি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছ কেন? আমার বরং তোমার ইন্টারভিউ নেয়া উচিত। মেয়েটাকে যদি এতই ভালো লেগেছিল তাহলে যখন এখানে কাজ করছিলে তখন তার কাছে প্রেম নিবেদন করনি কেন? হ্যাঁ?”
“চেয়েছিলাম তো,” কালাম লাজুক মুখে বলে। “কিন্তু কাজ করতে এসেছিলাম তো অন্য কারণে। ঐ মেয়ের পেছনে ছুটলে আমার আসল উদ্দেশ্য সফল হত? তাছাড়া ওর সাথে যখনই কথা বলতে যেতাম আমার বুকের মধ্যে এমন ধড় ফড় করত যে কথা বলতেই ভয় লাগত।”

দোলন হাসতে লাগল। “ভীতুর ডিম একটা! আচ্ছা, তাকে গিয়ে আমি কি বলব?”
“শুধু ওর ফোন নাম্বারটা নিয়ে এসো। আমাকে পছন্দ করত। আমার নাম বললে নাম্বার দেবে। আমি রাস্তার অন্য পাশে থাকব। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ব। তার চেয়ে বেশী কাছে যেতে চাই না। পিন্টু যদি আমাকে দেখে ক্ষেপে বোম হয়ে যাবে। তার সাথে আমি কোন ঝামেলায় যেতে চাই না।”
“কিন্তু যে সমস্ত ছেলেরা মারপিট করে মেয়েরা তাদেরকে খুব একটা পছন্দ করে না,” দোলন বলল। “ভাবতে পারে তুমি অযথা ঝামেলা পাকাও।”
“জাহানকে কেউ পছন্দ করত না। আমি যে ব্যাটাকে ধরে ধোলাই দিয়েছি, তাতে হয়ত মেয়েটা খুশীই হয়েছে।” কালাম গর্ব ভরে বলল।

“আপনি নিজেও পিটানি খেয়েছিলেন!” দোলন মুচকি হেসে তাকে স্মরণ করিয়ে দিল। “কিন্তু মেয়েটা যদি কোন কারণে আমার উপর ক্ষেপে টেপে যায় তাহলে তোমার নিতম্বে আমি গদাম করে লাথি মারব। মনে থাকে যেন।”
হাসল কালাম। “যত খুশী মেরো।”
“কোন দিন কাউকে বলতে পারবে না আমি এই কাজ করেছি,” দোলন সতর্ক করে দিল। “আমার শ্বশুর, শ্বাশুড়ী আমাকে মেরেই ফেলবে। আর উনিও মনে অনেক ব্যাথা পাবেন।”
“আমার বয়েই গেছে কাউকে বলতে। এই মুখে কুলুপ এঁটে দিলাম।” কালাম নিশ্চিত করল।
দোলন নীরবে কিছুক্ষণ খেল। “একটা কথা কি জান, আমার না কখন কোন ছেলে বন্ধু ছিল না।” দোলন হাসতে হাসতে বলে। “প্রেমিক নয়, স্রেফ পুরুষ বন্ধু। কয়েকটা ছেলে আমার পেছন পেছন ঘুরত, কিন্তু বদমাশ ছিল সেগুলো। কথা বলার সাহস ছিল না। তারপর হঠাত করেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। তখন আমার বয়েস মাত্র আঠারো।”
“মাত্র আঠারো? তোমার তো তাহলে অনেক কম বয়েসে বিয়ে হয়েছে।”
“তোমার কাহিনী কি?” দোলন জানতে চায়। “গার্লফ্রেন্ড ছিল?”

“নিশ্চয়! অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল কিন্তু কোন প্রেমিকা ছিল না। কেউ প্রেম করতে চায় না।”
“সত্যিই? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।” দোলন এক গাল হাসি নিয়ে বলে। “তুমি যা কিউট! অনেক মেয়েই নিশ্চয় তোমাকে পছন্দ করত। তোমার লাজুকলতা স্বভাব দেখে পিছিয়ে গেছে। যাই হোক, আমার খাওয়া শেষ। চল, কাজটা সারা যাক। আমাকে আবার তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। মরিয়ম আপা দুইটার মধ্যে ফিরে আসবে। সে আসার আগেই আমি বাসায় ফিরতে চাই।”

“ভাবী খুব ভালো মানুষ। উনি কোন ঝামেলাই করবেন না।” কালাম দৃঢ় স্বরে বলল।
দোলন হাসল। “এই পাগলা, তাকে তুমি কয়দিন চেন? আমার চেয়ে বেশী নিশ্চয় নয়।”
কালাম লজ্জা পেয়ে গেল। “ভুলেই গিয়েছিলাম, তোমার ননদ হয়। আচ্ছা, তুমি যদি রেডী থাকো তাহলে যাওয়া যাক। হেঁটেই যেতে পারি। মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ।”
“চল, হেঁটেই যাই। একটু ঠান্ডা থাকলেও রোদটা ভালো লাগবে।” দোলন তার ভারী শীতের জ্যাকেটটা পরে গলা পর্যন্ত চেইন লাগিয়ে দিল। “আমার ঠান্ডা একেবারেই সহ্য হয় না। একটুতেই সর্দি লেগে যায়।”
তারা দুজনে ম্যাকডোনাল্ডস থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পূর্ব দিকে হাঁটে। রাস্তার অন্য পাশে আহমেদ’স। আঙ্গুল তুলে দেখায় কালাম। “সাবধানে রাস্তা পার হয়ো। আমি এপাশেই আছি।”

দোলন রেস্টুরেন্টটাকে ভালো করে দেখল। “কথন আসি নি এখানে। ভালোই তো দেখাচ্ছে। শুনেছি অনেক নাকি লোকসান হচ্ছে কিন্তু ভেতরে তো বেশ ভীড় দেখছি।”
“পিন্টুই টাকা পয়সা সব উলটা পাল্টা খরচ করেছে। রেস্টুরেন্টটা খারাপ চলছে না। এইবার রাস্তা পার হও। দৌড়াও!”

গাড়ীর স্রোতে ক্ষনিকের বিরতি দেখে এক দৌড়ে রাস্তার ওপারে চলে গেল দোলন। খুব একটা ভয় করছে না ওর। স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। ওকে অভ্যর্থনা জানাল লরা, কালাম যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই মেয়েটাই। তাকে সরাসরি বলল কালামের কথা। লরা হেসে ফেলল। ভ্রূঁ নাড়িয়ে জানতে চাইল কালাম কোথায়। দোলন রাস্তার অন্য পাশ দেখিয়ে দিল। মেয়েটা ঘাড় উঁচিয়ে কালামকে দেখল। আসলেই দেখতে পেল নাকি কিছু একটা আন্দাজ করে নিল কে জানে, কিন্তু সে একটা কাগজে দ্রæত নিজের ফোন নাম্বারটা লিখে দিল। তারপর দোলনের কানে কানে বলল, “ওকে বল আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তারপরও কথা বলতে আপত্তি নেই।”

পিন্টু নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল। দোলনকে দেখার আগেই দ্রæত রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো সে। পিন্টু তাকে দেখুক সেটা চায় নি। যদি সবাইকে বলে বেড়ায় খুব অপমানজনক একটা ব্যাপার হয়ে যাবে।
ফোন নাম্বার পেয়ে কালাম খুব বাক বাকুম করছিল কিন্তু দোলন যখন বয়ফ্রেন্ডের রহস্যটা ফাঁস করল তখন সে একবারেই চুপসে গেল। “কি হে প্রেমিক প্রবর, একেবারে যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো মুখে!” দোলন খোঁচা দিল।
“আমার কপাল,” কালাম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল। “যাই হোক, চেষ্টা তো চলিয়ে যেতেই হবে, নাকি?” দোলনের সাথে তার গাড়ীর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল। “তুমি এসেছ সেই জন্য খুব ভালো লেগেছে।” একটু পরে যোগ করল।
“হ্যাঁ! সময়টা ভালোই কেটেছে।” দোলন বলল। “পরের বার কোন মেয়ের পেছনে আর ছুটতে পারব না। মজার কিছু একটা করতে হবে।”
“ঠিক আছে।”

দোলন গাড়ীতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। কালামকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামল। মনে মনে হাসল। বেশ একটা ডেট ডেট মনে হয়েছে এই সাক্ষাতটা ওর কাছে। ওর জীবনে স্বামী ব্যাতিরেকে এটাই প্রথম কোন ছেলের সাথে একাকী দেখা করা। আবুল যদি শোনে তাহল তার নিশ্চয় একটা স্ট্রোক হয়ে যাবে!