হিমাদ্রী রয় : সময় আর সৃজন সাথে সাথে চলায় যেটা বিঘ্ন ঘটায় তা হলো মনোযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। কেচ্ছায় যতটা আমাদের মনোযোগ আছে মহত কীর্তিতে ততটা নেই। তাই অনেককেই শুধু আবিষ্কার করি, কোনকিছু নির্মাণ করতে পারছি কই?

ইট সুড়কির সভ্যতা শৈশব চুরি করেছে অনেক আগে আর ফাইভ জি সভ্যতার কাছে আমরা বিক্রি হচ্ছি নিজেরাই মানে আমাদের মনযোগ বিক্রি হচ্ছে। সিলিকন ভ্যালি প্রযুক্তির এমন নক্সার পশরা সাজিয়ে বসেছে যাতে ভবের হাটে বিনে পয়সায় আমাদের মনোযোগ বিক্রি হয়। কনটেন্টে যত বেশি ক্লিক তত বেশি তাদের ব্যাবসা। বিভিন্ন দিবসে প্রোফাইল পরিবর্তন এর সহজ উদাহরণ।

সেদিন এক বাবা-মা বারো তেরো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে লাঞ্চ করতে এসেছেন আমি সার্ভ করছিলাম। দেখলাম ছেলেটি বই পড়ছে। দৃশ্যটা অনেকদিন পর দেখলাম আর আমারও কথোপকথন তৈরির সুযোগ হয়ে গেলো বললাম আমি মুগ্ধ যে তার হাতে বই, ডিভাইস নয়। ছেলেটির বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক তিনি যে সমীক্ষা দিলেন তা চমকে উঠার মতো।

আমাদের যে কোন কাজে সেটা পড়াশুনা কিংবা গবেষণা অথবা দৈনন্দিন রুটিন কাজে, ফোনের নোটিফিকেশন তাত্ক্ষণিকভাবে যে মনঃসংযোগ কেড়ে নেয় তা ঐ কাজে আবার প্রতিস্থাপন করতে প্রায় বারো মিনিট সময় লাগে তাতে করে আমাদের নিজেদের এবং সন্তানদের মনোযোগ একাগ্রতা থেকে সরে যাচ্ছে। এখন আমরা শর্টকাট এ সবকিছু পাবার চেষ্টা করি।

মনে আছে আজ থেকে দশবছর আগে আমার এক কলিগ প্রতিদিন সাবওয়েতে লর্ড অব দ্যা রিংস পড়ে পড়ে কাজে আসতো এবং বইটি শেষ করার পর সে থিয়েটারে যেয়ে মুভিটা দেখে। আমাদের প্রবণতা হলো গোড়া না পড়ে এ নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মান হয়েছে তা দেখে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ধরে ফেলা আর সত্যজিত রায়ের অসামান্য সৃষ্টি পথের পাঁচালীতে বিভূতি ভূষণকে জানা।

আজ বিকেলটা ছিলো মায়াময়, দখিনা বাতাস ক্লান্তির গন্ধ দিলো তাড়িয়ে, রাস্তার ওপারের ম্যাগনোলিয়া আচ্ছন্ন করলো হৃদয়। আজ সারাটা বিকেল প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলাম। কদিন থেকেই লক্ষ করছি শুকনো গাছের বৈরাগ্য দূর করে ঘন সবুজ পাতারা জেগে উঠেছে। কোথা থেকে উড়ে আসে রঙ বেরঙের কয়েকটি পাখি হঠাত মনে হলো এদের খাবারের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করলে কেমন হয়। সেই মতো আঙিনার তিন কোনে তিনটি বার্ড ফিডার এর ব্যাবস্থা হলো। কিন্তু মনের আসক্তি সে থোড়াই আমার পরোয়া করে আবার সেই ডিভাইস হাতে নিয়ে দেখা কার মিসকল কতটা লাইক, কার কোন গৌরবের কেচ্ছা, সুখী দেখানোর পদাবলী।

তবু মাথার উপর দিনান্তের রবি, পাশেই হলুদ-কমলার গাঁদা ফুটেছে গায়ে মাটির সোঁদা গন্ধ মাখি। আশা জাগায় বুকে
‘নুতন দেখা জাগাবে আমার চোখে’।