ফরিদ আহমেদ : বাংলা সাহিত্যের উনিশ শতক হচ্ছে তুমুল এক আলোড়নের সময়। ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার পরে যেমন শুরু হয় কর্মব্যস্ত সময়, এই সময়েও বাংলা সাহিত্য জেগে উঠেছিলো আড়মোড়া ভেঙে। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগেরও সূচনা হয় এই সময়ে। মধ্যযুগ থেকে দৃপ্ত পায়ে আধুনিক যুগের সীমারেখা পা রাখে বাংলা সাহিত্য। কৈশোর পেরিয়ে শুরু হয় তারুণ্যের কাল। হুমায়ুন আজাদের মতে অভিনব এক আলোর ঝলকে জেগে উঠেছিলো বাংলা সাহিত্য। তিনি বলেন, “মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্য ছিলো সংকীর্ণ; সবগুলো শাখা বিকশিত হয়নি তাতে। উনিশ শতকে বিকশিত হয় তার সব শাখা, বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ সাহিত্য।”

সম্পূর্ণ সাহিত্য হওয়ার জন্য প্রয়োজন পড়ে গদ্যের মতো একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের। এই সময়ে জন্ম নেয় বাংলা গদ্যের। মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যের সবকিছুই লেখা হয়েছে ছন্দে। স্বাভাবিকভাবেই সেই সাহিত্য ছিলো সীমাবদ্ধ। মানুষের জীবনের সবদিক ছন্দের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব ছিলো না। গদ্যের বিকাশে সাহিত্য হয়ে ওঠে বিস্তৃত।

১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর লেখকেরা গড়ে তুলেছিলেন বাংলা গদ্য। এদের দেখাদেখি অন্যদের মাঝেও সেটা সংক্রমিত হয়ে যায়। গদ্য ভাষায় লেখা অসংখ্য বই বের হতে থাকে।

১৮২৩ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নববাবুবিলাস’ নামে একটা প্রহসন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পাদরি লঙ অবশ্য বলেছেনে বইটা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮২৫ সালে। এটাকে কেউ কেউ প্রথম বাংলা উপন্যাস বলে থাকেন। তবে, সেই দাবি খুব একটা ধোপে টেকে নাই। এখন এটাকে একটা বড় গল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়। একই সাথে বলা হয় বাংলা উপন্যাসের শিকড় এই বইয়ের মধ্যেই নিহিত ছিলো। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলালের’ সাথে এর একটা চারিত্রিক মিলও রয়েছে। দু’টোতেই বাংলার নব্য ধনী শ্রেণীর বিলাসী জীবন নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছিলো।

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ নামের একটা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক ছিলেন। তিনি ‘নববাবুবিলাস’ ছাড়াও আরো অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘কলিকাতা কমলাময়’ এবং ‘নববিবিবিলাস’ নামেও তাঁর আরো দুটি জনপ্রিয় প্রহসন রয়েছে। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ছদ্মনাম ছিলো। সেটা হচ্ছে, প্রমথনাথ শর্মা। এই নামেই ‘নববাবুবিলাস’ লিখেছিলেন তিনি। পুরো প্রহসনটা গদ্যে লেখা হয়। এর কিছু অংশ পদেও লিখেছিলেন তিনি। ‘নববিবিবিলাসের’ ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। প্রধানত গদ্যে লেখা হলেও সেখানে পদ্যও ছিলো।

ঊন-বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইংরেজি হাল-চাল, শিক্ষা-দীক্ষা বাঙালি সমাজে সবে আমদানি হওয়া শুরু হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদৌলতে বাংলায় একটা নব্য ধনী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। কোলকাতায় পঙ্গপালের মতো বংশ বিস্তার করেছে তারা। হঠাৎ করে পাওয়া এই ধন-সম্পদের কারণে এরা বিলাস-বাসনে মেতে ওঠে। শুরু হয় বাবু কালচার নামের এক নতুন কালচার। এটা মূলত ভোগের কালচার। বাবুদের সাথে সাথে তাদের পুত্ররা, নববাবুরাও বিলাসী জীবনে গা ভাসিয়ে দেয়। এদের টাকা ছিলো, ছিলো না শিক্ষা। ইংরেজদের অন্ধ অনুকরণের একটা আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো এই অর্ধশিক্ষিত ধনী বাঙালিদের মাঝে।

নিখিল সেন তাঁর ‘পুরনো বই’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ঊন-বিংশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় অর্ধশিক্ষিত ধণ্যাঢ্য ‘বাবু’ ও ‘নব-বাবু’দের এমনি ধারা বহু বাস্তব সামাজিক চিত্র তখনকার সাময়িক পত্রেও দেখা যায়। (দ্রষ্টব্যঃ ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ – ১ম খণ্ড- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।) ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৭৮৭-১৮৪৮)- ওরফে ‘প্রমথনাথ শর্মা’ ওরফে ‘ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ এর লেখা ‘নববাবুবিলাস’ ও ‘নববিবিবিলাস’ ইংরেজি শিক্ষা ভাল করে প্রচলিত হবার আগেকার কলকাতার হঠাৎ বড় মানুষ বনে ওঠা অর্ধশিক্ষিত এসব নব্যবাবুদের আচার-ব্যবহার ও নৈতিক জীবনযাত্রার প্রতি সেটায়ার বা ব্যঙ্গ-চিত্র।”
‘নববাবুবিলাসের’ মূল চরিত্র হচ্ছে জগদ্দুর্লভ বাবু। তার বাবা রামগঙ্গা নাথা। ইংরেজদের কৃপায় রামগঙ্গা নাগের হরেক রকমের সওদাগরি কারবার। টাকার কোন অভাব তাঁর নেই, বরং প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই আছে। জগদ্দুর্লভ ছাড়াও তাঁর আরো দুই ছেলে রয়েছে। এরা পড়ালেখা না করলেও তাঁর কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও এদের পড়াশোনার জন্য তিনি পণ্ডিত রেখে দেন। কিন্তু, ছেলেদের কারোরই পড়াশোনাতে কোনো মনোযোগ নেই। এদেরকে জোর করে যে পড়ানো হবে, সেটাও সম্ভব নয়। রামগঙ্গা নাগ সে ব্যাপারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে একদল তোষামোদকারী। তারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ছেলেদের শিক্ষার কথা গিয়ে রামগঙ্গা নাগকে বলেছে। ফলে, তাঁর ধারণা জন্মেছে তাঁর ছেলেরা সব ভালো রকমের শিক্ষিত হয়েছে। তারা যে ঘুড়ি, বুলবুল আর মুনিয়া নিয়ে মেতে থেকেছে, সেটা তিনি জানতেই পারেননি। জানলেও যে থামাতেন সেটাও না। কারণ, তিনি নিজেও ভোগের আর বিলাসের জীবন যাপন করেন।

পড়ালেখা শেষ হয়েছে বিধায় ছেলেদের বিষয়কর্মে লাগিয়ে দিলেন রামগঙ্গা নাগ। ছেলেরা নব্যবাবু থেকে এখন ফুলবাবুতে পরিণত হয়ে গেলো। আগে যেখানে বাবার টাকা নিয়ে উড়ানো লাগতো, এখন নিজেদের টাকায় যানবাহনে চড়ে, নিজেদের পছন্দ মতো পোশাক পরিচ্ছদ পরে যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া আসার শুরু করলো। জুটে গেলো খোসামুদে আর তোষামুদে ইয়ার বন্ধুর দল। কখনো বাগানে, কখনো নিজ ভবনে বিলাসিনীদের এনে চলতে লাগলো সমুদ্র মন্থনের খেলা।

যতো টাকাই থাকুক, এমন বিলাসী জীবন যাপন করতে গেলে সেটা শেষ হতে বাধ্য। নববাবু জগদ্দুর্লভের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। টাকায় টান পড়তে নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে তার সব স্বর্ণালংকার নিয়ে এলো। সেগুলো বিক্রি করেও আনন্দ স্ফূর্তি চললো আরো কিছু দিন। এর পরে শুরু হলো অন্যদের কাছ থেকে ধার নেবার পালা। সেই ধার যখন আর ফেরত দিতে পারছিলো না, তখন পাওনাদারেরা তাকে পাকড়াও করে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলো।
আগেই উল্লেখ করেছিলাম, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের সাথে এই প্রহসনের চারিত্রিক মিল রয়েছে। নিখিল সেন লিখেছেন, “হঠাৎ বড়লোক জমিদার বাবুরামবাবুর আস্কারা পাওয়া জ্যেষ্ঠপুত্র মতিলাল বিদ্যা শিক্ষার ব্যাপারে এবং চরিত্রহীনতার দিক থেকে যে নববাবু জগদ্দুর্লভের সগোত্রীয় অনুজ তা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠে জানা যাবে। দু’খানি বইতেই বড়লোকের ছেলেরা বাল্যকালে পিতামাতার অনুচিত প্রশ্রয় পেয়ে এবং সৎ শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয়ে কিরূপ বৃদ্ধি পেতে থাকে, বড়লোকের ছেলের সঙ্গে বদলোক জুটে তাকে অধঃপতনের দিকে কি ভাবে এগিয়ে দেয়- এ দু’বইতে তা সুন্দরভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।”

দুই গ্রন্থের এই আশ্চর্য মিল দেখে বলা যায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের আদর্শ ছিলো ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাস’ বইটা। রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর ‘বাংলা-ব্যঙ্গ-সাহিত্যের ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন, “পাঁচ বৎসর হইল মাসিক পত্রিকা নামক এক ক্ষুদ্র সাময়িক পত্রে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ শিরোনামে কএকটি প্রস্তাব প্রকটিত হয়, তাহা তদনন্তর সংশোধিত ও প্রকৃষ্টীকৃত হইয়া পুস্তকাকারে প্রকাশ হইয়াছে। ….. ঐ প্রবন্ধের আদর্শ নববাবুবিলাস…।”

‘নববাবুবিলাস’ উপন্যাস না হলেও, এটা চমৎকার একটা ব্যঙ্গ চিত্র বা প্রহসন। পাদরি লঙ ১৮৫৫ সালে এই বই সম্পর্কে লিখেছিলেন, “One of the ablest satires on the Calcutta Babu, as he was 30 years ago.”

শুধু পাদরি লঙ-ই না, অনেক সমালোচকই এই বইয়ের প্রশংসা করেছিলেন। বইটার উচ্চমানের ব্যঙ্গাত্মক গুণের কারণে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে। এর অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো। এমনকি এই প্রহসন কাহিনি অবলম্বনে নাটকও হয়েছে।

প্রায় দুইশো বছর আগে লেখা বই হলেও, এর ভাষা অত্যন্ত সরল। কাহিনিও আধুনিক। এই বাংলাদেশেও আমরা এখন জগদ্দুর্লভদের মতো অসংখ্য নব্যবাবু দেখছি, দেখছি তাদের বিপুল বিলাসী জীবনও। সময় পাল্টেছে, দূর অতীত থেকে বর্তমানে এসেছি আমরা, কিন্তু কিছু মানুষের ভোগের তৃষ্ণা এখনো কমেনি। সেটা রয়ে গিয়েছে অবিকৃত এবং অশ্লীল।