বিদ্যুৎ সরকার : সে সময় ঢাকা থেকে শ্রীনগর যেতে একমাত্র নদী পথেই তা সম্ভব হতো এবং লঞ্চ ছিল দ্রæততম মাধ্যম। ঢাকা – শ্রীনগর রুটের হরিরাম পুরা লঞ্চ ঘাট পুরনো ঘাটগুলোর মধ্যে একটি। শুরুতে এর অবস্থান মজবুত ছিল, নদীর ভাংগনে এর অবস্থান ও আকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বাঁধানো ঘাট, যাত্রীদের উঠা-নামার সুবন্দোবস্ত ছিল শুরুতে, এখন শুধুই স্মৃতি। তখনকার হরিরাম চন্দ্র জমিদারের আমলেই লঞ্চ ঘাট ও অন্যান্য জন কল্যাণমূলক কাজগুলো সাধিত হয়েছে। হরিরাম চন্দ্র ছিলেন একজন জনদরদী, গরীবের একান্ত বন্ধু। তাই, জনগণের দাবির মুখে এ অঞ্চল ও লঞ্চ ঘাটের নামাকরণ হয় তারই নামানুসারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য সব কিছুর মতো হরিরামপুর গ্রামেরও পরিবর্তন আসে। সর্বত্রই জীর্ণতার ছাপ পড়তে থাকে হরিরাম চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই। তার মৃত্যুর প্রায় দেড় যুগের ভিতর পরিবারের অনেকেই স্বর্গবাসী হোয়েছেন। আর বাকী যারা ছিলেন অভাব অনটনের কারণে ওপার বাংলায় পারি দিয়েছেন। জীর্ণশীর্ণ দ্বীতল বাড়িটিই শুধু কালের সাক্ষী হয়ে এখনও কোনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুরকী, ইট-পলেস্তারা খসে পড়া দেয়ালে আগাছা পরগাছায় আচ্ছাদিত হতে হতে এক সময় ঢাকা পড়ে যায় হরিরাম চন্দ্রের আস্ত দোতলা দালান। জন মানব শূন্য পরিত্যক্ত একটি দালান হিসেবে অনেকদিন ধরে দাঁড়িয়ে। পরবর্তীতে ওখানেই নিচতলার কয়েকটি ঘরে কিছু ছিন্নমূল পরিবার বসবাস করতে থাকে। কলি সে পরিবারেই বেরে উঠা এক পিতৃহীন শিশু। সুখী বালার খুব ইচ্ছে ছিল তার হবু সন্তান যেন মেয়ে হয়। মেয়ে হলে তার নাম রাখবে কলি। যে একদিন পরিপূর্ণ ফুল হয়ে সুবাস ছড়াবে, ম ম করেবে চারিধার। ইশ্বর তার আশা অনেকটাই পূরণ করেছে। সত্যি সত্যি তার কোল আলোকিত করে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। কথা মতো সদ্য জন্মগ্রহণ করা সন্তানের নামও রাখা হলো ‘কলি’। সুখী বালার কতো না স্বপ্ন কলিকে নিয়ে। না না রঙের ফ্রক পড়বে ছোট ছোট দুটো বেনী দুলিয়ে প্রজাপতির মতো এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াবে তার সাথে, একটু বড় হলে সবার মতো সেও স্কুলে যাবে। লেখা-পড়া শেষে চাকরি করবে। কিছুতেই ওকে তার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে দেবে না সুখী বালা।

একদিন সে-ই তাদের ছোট্ট সংসারের মস্ত আকাশটাকে আলোকময় করে তুলবে। লালন সাহার গ্রোসারি শপ হরিরামপুর বাজারের মধ্যিখানে অবস্থিত। কম দামে ভালো মালামালের চাইতে ওর ভাল ব্যবহারের জন্য বেশির ভাগ লোক তার দোকানেই ভীড় জমায়। দোকান সময় মত বন্ধ করে সরাসরি ছুটে যাবে ছোট্ট পুতুল পুতুল মেয়ের কাছে। সারা দিনের অদেখায় ব্যকুল হয়ে উঠে লালন সাহার হৃদয়। কলি, সুখী বালা এ দু’জকে নিয়েই লালনের অসীম সুখের সংসার। ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসা, ছোট্ট ছোট্ট গল্প কথা, সুখের ছোঁয়া সেই খানেতে থাকে বুঝি সংগোপনে। লালনও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে ওদের কলিকে নিয়ে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে ছুটে যাবার স্বপ্ন। অলিই যেন ভবিষ্যতের সেই প্রজ্বলিত প্রদীপখানি। একদিন বড় হয়ে কলিই তাদের নিয়ে যাবে আলোকিত পথের সন্ধানে। কলি বুঝি একটু একটু করে পাপড়ি মেলে ধরার স্বপ্ন দেখায় ওর মাকে, ওর বাবাকে। স্বপ্নময় এক বৃত্তের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে দু’জন। স্বপ্ন কি শুধুই স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা? না কি কখনো কখনো বাস্তবের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়? প্রতিটি মানুষেরই একটি স্বপ্ন বিলাসী মন থাকে নিভৃতে। কখনো সে মনের মাঝেই লালন করে বেড়ায় আবার কখনো তা বাস্তবায়নে অনেকটাই উদগ্রীব হয়ে পড়ে। লালনকে প্রতি এক সপ্তাহ পর পর বন্দরে যেতে হয় দোকানের জন্য মালামাল ক্রয় করতে। শেষ বারে বন্দরে থেকে ফেরার পথে ভীষণ ঝড়ের কবলে পড়তে হয় তাকে বহনকারি নৌকাটির। মাঝ দড়িয়ায় সে নৌকায় উপস্থিত সবাই আতংকিত হয়ে পড়ে। এক দমকা হাওয়ায় নৌকা ডুবে যায়। এদের অনেকেই সাঁতরে তিরে এসে জীবন রক্ষা পায়। কিন্তু লালন সাহার শেষ রক্ষা হয়নি। দু’দিন পর তার ডেড বডি প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে ভেসে উঠে। শনাক্তর পর মরদেহ তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। লালন-সুখী বালা পরিবারের স্বপ্ন এমন করেই নদীর গভীর জলের আহ্বানে হারিয়ে যায়। ধুয়ে যায়, মুছে যায় কলির স্বপ্নে দেখা রাজ কন্যা হবার বাসনা। শীতের কুয়াশার মতো ধীরে ধীরে অভাব অনটন সুখী বালার ছোট্ট সংসারকে বড় চাদর হয়ে ঢেকে দিতে থাকে। দিনের আলো ক্রমশ দূরিভূত হয়ে রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। স্বামী হারা সুখী বালার নতুন ঠিকানা হয়ে যায় পলেস্তারা পড়া জীর্ণশীর্ণ দালানের নিচুতলার আলোবিহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহকোণ।

সুখী বালা-লালনের লালিত স্বপ্নগুলো আর ফিরে আসে না সুখী বালার নিদ্রাহীন দু’চোখের উঠোনে। কলির প্রজাপতি মন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। ফুল হোয়ে ফোটার প্রত্যাশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ভাঙা কাচের টুকরোর মতো। হরিরামপুর লঞ্চঘাট সুখী বালার একমাত্র ঠিকানা এখন। যেখানে সুখী বালার হৃদয় অলিন্দে দুঃখ বোঝাই একটি জাহাজ নোঙর করে আছ ভাগ্য-রেখা হয়ে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা