ভজন সরকার : ঘুম থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে ঘুম রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই চক্রাকার একটি রেললাইন। টিলার উপরে উঠে গেছে রেল লাইনটি। টিলা সদৃশ্য এ জায়গাটার নাম ‘বাতাসিয়া লুপ’। প্রচন্ড হাওয়া দেয় এ জায়গাটি আর রেললাইনটিও চক্রাকার বৃত্তের মতো। বাতাস থেকে ‘বাতাসিয়া’ এবং ইংরেজি লুপ নিয়ে ‘বাতাসিয়া লুপ বা বাতাসী লুপ’। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো এ জায়গাটি। এখান থেকে দার্জিলিং শহরকে ক্যামেরায় ধরা যায় এমন সুন্দর ব্যবস্থা ফটো তোলার। ও খঙঠঊ উঅজঔঊঊওঘএ লেখা সাইনের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে দার্জিলিং শহর নিয়ে ফটো তোলার বিরাট লাইন। আমিও দাঁড়ালাম ফটো তোলার সে লাইনে।

চৈত্র মাসের রোদ। বাতাসী লুপের প্রচন্ড বাতাসে অনেকদিন পরে একটু স্বস্তি পেলাম। বাতাসি লুপে তৈরী করা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোরখা ইউনিটের শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। সা¤প্রতিক সময়ে কাশ্মীর থেকে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় পর্যন্ত গোরখা ইউনিটের শহীদ সেনাদের নাম লেখা আছে স্মৃতি স্তম্ভে। নামগুলো পড়তে পড়তে এক সময় থমকে দাঁড়ালাম। ভারত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধকে “অপারেশন জ্যাকপট” নাম দিয়েছিল। এই “অপারেশন জ্যাকপট”-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় গোরখা বাহিনীর নিহত সেনাদের নামের তালিকা দেখে মনটা বিষাদে ভরে গেল। দার্জিলিংয়ের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের কত মায়ের বুক খালি হয়েছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামে। বাংলাদেশ কি এই নিহত সেনাদের পরিবারের কাছে কোনোদিন ঋণ স্বীকার করেছে? রাষ্ট্রীয় ভাবে হয়ত করেছে কিন্তু এই পরিবারের কাছে সে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা কি পৌঁছেছে কখনো?

দার্জিলিং-য়ে দেখার জায়গা অনেক। পর্যটকের ভীড় এবং অপ্রতুল যানবাহন – সমস্যা প্রধানত দু’টো। পাহাড় কেটে তৈরী করা সরু রাস্তাগুলোতে অসংখ্য যানবাহন পর্যটকদের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার প্রধান অন্তরায়। এসব কিছু মাথায় নিয়েও দু’দিনের দার্জিলিং ভ্রমণে বেশ কয়েকটি স্থান দেখার সুযোগ হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রটি হলো রক গার্ডেন, দার্জিলিং।

শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের প্রায় কয়েক শ’ ফুট নিচুতে অবস্থিত এ মনোরম স্থানটিতে যাওয়ার রাস্তাটিও খুব সুন্দর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। দার্জিলিং এলাকার দক্ষ গাড়ি চালকদের নৈপুন্য দেখা যায় রক গার্ডেনে যাওয়ার পথে। পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে ওঠা এ রক গার্ডেনটি সত্যি পর্যটনবান্ধব করেই পরিপাটি করে রাখা আছে। পাহাড়ি ঝর্ণা, জলপ্রপাত, চক্রাকার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ঘাড়উঁচুকরা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা, পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় তৈরী করে রাখা বেঞ্চ এবং পাহাড় কেটে তৈরী করে রাখা ভাস্কর্য; এক কথায় অপূর্ব সুন্দর। রক গার্ডেনের একেবারে উপরের বেদিতে বসে আশেপাশের সুউচ্চ পাহাড় এবং উপত্যকা দেখার অভিজ্ঞতা প্রত্যেক মানুষের একবার হলেও থাকা উচিত। দূর্গম পথের ভয় এবং ক্লান্তি রক গার্ডেনে এসে কর্পূরের মতো উবে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলাই যায়।

দার্জিলিং ঘুরতে এসেছেন অথচ টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখার চেষ্টা করেননি এমনটা ভাবা অবান্তর। দার্জিলিং শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের এ স্থানটি থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়। ২,৫৯০ মিটার উচ্চতার এ টাইগার হিল থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃংঘ মাউন্ট এভারেস্ট ( ৮,৮৪৮ মিটার) এবং কাঞ্চনজংঘা (৮,৫৮৬ মিটার) স্পষ্টভাবে দেখা যায়। উচ্চতার জন্য সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি কাঞ্চনজংঘা উপরে পড়ে এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হয়। কিন্ত টাইগার হিলের প্রথম সূর্যোদয় এবং কাঞ্চনজংঘা দেখার সৌভাগ্য নাকি অনেক পর্যটকের কয়েকবার চেষ্টাতেও হয় না।

আমাদের চেষ্টা আংশিক সফল হয়েছিল। সূর্যোদয় দেখেছি কিন্তু সূর্যের আলো কাঞ্চনজঙার চূড়ায় প্রতিফলিত হয়ে যে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তা মেঘের জন্য দেখা যায় নি। এতোটুকু অপূর্ণতা সত্বেও টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখা সত্যি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা । রাত আড়াইটায় ঘুম থেকে জেগে উঠে টাইগার হিলে ঘন্টা দুই দাঁড়িয়ে থাকা। একটি লাল বিন্দু থেকে ক্রমে ক্রমে গোলাকৃতির সূর্য হয়ে ওঠার মুহূর্তটা প্রত্যক্ষ করে প্রায় সবাই এ কষ্টটুকু ভুলে যান।

চৈত্র মাসের প্রচন্ড দাবদাহেও টাইগার হিলের সকালে প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমাত্রা। ভাগ্যিস গরম জামা কাপড় নিয়েছিলাম সাথে। দীর্ঘদিন কানাডায় বাস করে শীতের সাথে ঘর-গেরস্থালিতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মার্চের শেষ সপ্তাহেও দার্জিলিং এবং টাইগার হিলে এসে যেন সেই আবেশই পেলাম।

দার্জিলিং বেড়াতে এসে সন্ধ্যায় মল রোডে হাঁটেননি এমন লোকও কম পাওয়া যাবে। দার্জিলিং শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এই মল রোড। মূলত পর্যটকদের কেনাকাটা এবং খাবার দোকান দিয়ে সাজানো এই মল রোড। মল রোড দিয়ে হেঁটে উপরে উঠলেই মল স্কয়ার। বিরাট স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে নামি-দামি শিল্পীদের গান। প্রায় সবই নেপালী ভাষায়। মল স্কয়ারের দু’পাশে মল মার্কেট। ছোট ছোট দোকান। শীতের কাপড়-চোপড় থেকে স্যুভেনিরসহ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে এখানে। দরাদরি চলে কেনাবেচায়। দরদামে পারদর্শী না হলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা তো আছেই। মল স্কয়ারের এক পাশে পাহাড়ের চারপাশে চক্রকার হাঁটার রাস্তা। রাতে কিংবা খুব ভোরে এই চক্রাকার রাস্তা দিয়ে হাঁটলে অনেক উঁচু থেকে দেখা যায় দূরের পাহাড়ের গা-ঘেষে বানানো লোকালয়। দেখা যায় বহু দূরের কোনো সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় মিটমিট করে জ্বলা আলোকমালা। মল স্কয়ারের তৈরী করা আছে একটা আবক্ষ মূর্তি। নেপালি পোষাক পরা এ ভাস্কর্যটি নেপালের জাতীয় কবি ভানু ভক্ত আচারিয়ার। আগে নাম শুনিনি। ভাস্কর্যটির বেদী মূলে লেখা আছে ভানু ভক্ত আচারিয়া নেপালি ভাষায় রামায়ণের রচয়িতা।

এ তথ্যা জানা ছিল যে, আদি রামায়ণ, যা মহামুনী বাল্মিকী-সৃষ্ট, সেখান থেকেও হাজার বছরের বিবর্তনে রামায়ণ ও রামচরিত্র অনেক পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় প্রত্যেক ভাষিক-প্রদেশে আছে তাদের নিজস্ব রামায়ণ। আছে নিজস্ব রাম চরিত্র। বলাই বাহুল্য এ ভিন্ন ভিন্ন রামায়ণে চরিত্রগুলো নিজ নিজ এলাকার ঘটনাপ্রবাহ মতে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত-পরিতাজ্য হয়েছে আদি রামায়ণ অর্থাৎ বাল্মিকীর রামায়ণ থেকে। এমনকি অনেকে ব’লে থাকেন যে, এক সময়ের আদি পাঁচকান্ড রামায়ণের শ্লোক সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন দাঁড়িয়েছে সাতকান্ড রামায়ণ।

বাঙালিরা রামায়ণের যে রামকে জানেন, তা হুবহু বাল্মিকী-সৃষ্ট রাম নন; সে রামের কাহিনিকার কৃত্তিবাস ওঝা ( ১৩৮১ খ্রিঃ – ১৪৬১ খ্রিঃ)। হিন্দি বলয়ের রামের কাহিনিকার মূলত তুলসীদাস গোস্বামী (১৫৩২ খ্রিঃ – ১৬২৩ খ্রিঃ)। তামিলনাড়ুর রামায়ণ কম্বনের (১১৮০ খ্রিঃ-১২৫০খ্রিঃ) রামায়ণ। তেলেগুদেশমের রামায়ণ রংগনাথনের (১৩শ শতক) রামায়ণ। কাশ্মীরের রামায়ণ দিবাকর ভট্টের রামায়ণ। নেপালি ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন ভানু ভক্ত আচারিয়া ( ১৮১৪ খ্রিঃ – ১৮৬৮ খ্রিঃ)। দার্জিলিং-য়ের পর্যটন কেন্দ্র ‘মল স্কয়ার’-এ কবি ভানু ভক্ত আচারিয়ার আবক্ষ ভাস্কর্য আছে। নেপালের জাতীয় কবির ভাস্কর্যের সামনে ছবি তোলার সৌভাগ্য হয়েছিল এবার। (চলবে)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)