অনলাইন ডেস্ক : কুয়েতের ইতিহাসে মানবপাচার বিষয়ক সর্ববৃহৎ এবং চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বাংলাদেশি এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। রিমান্ডে তিনি নিজেকে বরাবরের মতো নির্দোষ দাবি করেছেন। এও বলেছেন, তিনি ব্যবসা করেছেন, পাচার নয়। আর তার এ ব্যবসায় বাংলাদেশ এবং কুয়েতের অনেকের হিস্যা আছে। তিনি কেবল তা আদায় করেছেন। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় তিনি শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ নেয়া দেশি-বিদেশি অনেকের নাম বলে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত কুয়েতের ৩ জন এমপি এবং ৭ জন কর্মকর্তার নাম প্রকাশ পেয়েছে। পাপুলের স্টেটম্যান্টে কুয়েতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে।

করোনাকালেও সচল কুয়েতি পার্লামেন্টে পাপুলকাণ্ড নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। অন্তত অর্ধডজন এমপি এ নিয়ে কথা বলেছেন। তারা সব নাম জনসমক্ষে প্রকাশের জোর দাবি জানিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র ও কেবিনেটের দায়িত্বে থাকা কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল সালেহ বিবৃতি দিয়েছেন। আশ্বস্ত করেছেন বিশিষ্টজন অর্থাৎ এমপি-মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, আমলা যার নামই পাপুলের মুখ থেকে আসুক না কেন, কেউ আইনের আওতার বাইরে থাকবে না। পাপুলের কমান্ডে থাকা তার কুয়েতি সহযোগীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধান এবং তার দাবির সত্যতা যাচাইয়ে দেশটির এন্টি করাপশন কমিশনে একটি স্বতন্ত্র সেল গঠন করা হয়েছে। তারা বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছে এবং দালিলিক প্রমাণ হাজির করবে প্রসিকিউশনে। সূত্রের দাবি, পাপুল বাংলাদেশ থেকে কীভাবে শ্রমিক পাচার করেছেন? কোথায় কীভাবে অর্থ সরিয়েছেন? কুয়েত, গাল্ফ এবং ইউরোপ-আমেরিকায় তার কত সম্পদ রয়েছে তার হিসাব আগেই দিয়েছেন। শুরুর দিকে তিনি সব অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ভিকটিম-শ্রমিক, স্টাফ এবং তার অপকর্মের পার্টনার মিলে ১২ জনকে মুখোমুখি করার পর তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে তা কবুল করেছেন। শনিবার মধ্যরাত অবধি কুয়েত ও মধ্যপ্রাচ্যর সংবাদ মাধ্যমগুলো সিআইডির বরাতে তা প্রকাশ করেছে। সে সময় বলা হয়েছিল আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য আসছে। হ্যাঁ, সত্যিই তাই ঘটেছে। সূত্রের খবর সপ্তাহব্যাপী রিমান্ডের শেষ দিনে পাপুল রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি এ দিনে কুয়েতের কোথায় কত ইনভেস্ট করেছেন? কাকে কত দিয়ে কিনেছেন? সবই বলেছেন তিনি। তবে দাবি করেছেন কাউকেই তিনি ঘুষ হিসেবে কোনো অর্থ দেননি। যা দিয়েছেন তা সবই গিফট! উপহারপ্রাপ্তদের তালিকায় কুয়েতের বর্তমান দু’জন পার্লামেন্টারিয়ান এবং একজন সাবেক রয়েছেন। তারা দেশটির রাজনীতি ও প্রশাসনে বেশ প্রভাব রাখেন।

বন্ধুত্বের খাতিরে তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন এমনটা দাবি করে পাপুল জানান, তাদের সঙ্গে তার ফ্রেন্ডশিপ অনেক দিনের। তিনি এও স্বীকার করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ৩ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে প্রায় দেড় লাখ দিনার দিয়েছেন তিনি, যার প্রত্যেকের ভাগে পড়েছে ৫০ হাজার দিনার করে। পাপুলের দাবি তিনি ব্যবসা করেছেন, লগ্নি করেছেন। সবাইকে নিয়েই আমোদ ফুর্তি করে জীবনটা উপভোগ করতে চেয়েছেন। এটাকে তিনি কখনো অপরাধ মনে করেননি। তিনি এও বলেন, দেশে থেকে শ্রমিকদের কুয়েতে নিয়েছেন, কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন। তাদের অনেকের ভাগ্য বদল হয়েছে। এতে তিনি লাভবান হয়েছেন। ভাইটাল পয়েন্টে থাকা কুয়েতের লোকজনকেও তিনি মোটামুটি হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট দিয়েছেন। শস্য দানার মতো ছিটানো তার সেই অর্থ অনেকেই পেয়েছেন। পাপুল নাকি আফসোস করে এও বলেছেন তার সেই ‘বন্ধু’দের বেশির ভাগই তার বিপদে খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি! তবে আদতে তিনি কার সম্পর্কে কি বলেছেন তা এখনো অস্পষ্ট। পাপুল নিয়ে আলোচনায় সামপ্রতিক সময়ে কুয়েতের আপিল আদালতের দু’টি যুগান্তকারী রায়, যাতে একজনের যাবজ্জীবন এবং অন্যজনের ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল তা রেফারেন্স হিসেবে আসছে। বলা হচ্ছে তার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে সাজা ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আদালতের ওপর। সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, পাপুল এমপি হলেও তার কাছে এখনো গ্রিন পাসপোর্ট। ফলে এমপি হিসেবে নয়, বরং একজন মানবপাচারকারী বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তার কেসটি বিবেচনা হচ্ছে। কোনো কূটনৈতিক সুবিধা তিনি পাবেন না।

লাক্সারি কার ঘুষ দেয়ার অভিযোগ কবুল: ১৫ই জুন আরব টাইমস প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ৫টি লাক্সারি কার ঘুষ দেয়ার যে অভিযোগ প্রকাশ করছিল আল-কাবাস পাপুল রিমান্ডে তা কবুল করেছেন। যদিও সেই সময় কুয়েত থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি এটাকে মিথ্যা এবং অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ২০ হাজার শ্রমিক কুয়েতে পাচার করে তাদের কাছ থেকে মোটামুটিভাবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (যা ১৬৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ) হাতিয়ে নেয়া এবং তার বড় অংশ আমেরিকান বন্ধুর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেয়ার অভিযোগও রিমান্ডে স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে।

আরব টাইমস বলছে তাক লাগানো স্বীকারোক্তি: এদিকে বাংলাদেশি এমপি’র স্বীকারোক্তিতে কুয়েতের প্রশাসনের একের পর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসছে এবং এতে চাঞ্চল্য তৈরি হচ্ছে বলে রিপোর্ট করেছে কুয়েতের প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দৈনিক আরব টাইমস। আরব টাইমসের রিপোর্ট মতে পাবলিক প্রসিকিউশন ১২ জন ভিকটিমের সাক্ষ্য গ্রহণের পর মানবপাচার ও অর্থপাচারের দায়ে এমপি পাপুল এবং তার সহযোগী অন্য একজনকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রিপোর্ট বলছে, তদন্ত কর্মকর্তাদের পাপুল বলেছেন, কুয়েত সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন। যিনি একটি মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। তিনি তাকে এই মর্মে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেনো তার অধীন ক্লিনিং কোম্পানির সব কর্মীকে তিনি দেশে পাঠিয়ে দেন, যাতে তার বিরুদ্ধে কেউ চাক্ষুষ সাক্ষী হতে না পারে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যে এমপি পাপুলের অবৈধ লেনদেনের দালিলিক প্রমাণ অর্থাৎ চেক ও হিসাব বিবরণী এখন সিআইডি’র হাতে। ফলে তার অস্বীকার করার কায়দা নেই।

এতকিছুর পরও বাংলাদেশি এমপির আইনজীবী নাসের আল হাসবাস আদালতে তার জামিন আবেদন করেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে কাজী পাপুল বাংলাদেশের একজন সম্মানিত সংসদ সদস্য। তাকে যেকোনো শর্তে জামিন দেয়া হলে আর যাই হোক তিনি পালাবেন না।

পার্লামেন্টে বিবৃতি কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রীর

এদিকে সিআইডির হাতে আটক বাংলাদেশি এমপি পাপুলসহ অন্য অভিযুক্তরা জিজ্ঞাসাবাদের ভিসা বাণিজ্যে তাদের সহযোগী কুয়েতি যেসব নাগরিকের নাম বলেছে তা প্রকাশের দাবি জোরালো হচ্ছে। এ নিয়ে গতকাল পার্লামেন্ট সেশনে স্বারাষ্ট্র ও কেবিনেট দেখভালের দায়িত্বপাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দেশটির প্রভাবশালী সংসদ সদস্য আবদেল ওহাব আল বাবতেন। জবাবে উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল সালেহ সংসদে প্রদত্ত বিবৃতিতে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ভিসা বাণিজ্যে রাষ্ট্র হিসাবে কুয়েতের নিরাপত্তা বা অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। এ সংক্রান্ত পূর্ব নির্ধারিত চূড়ান্ত সতর্কতা বা রেড লাইনেই যেনো দেশটির অবস্থান। সেই প্রেক্ষাপটে এই সময়ে অনৈতিক ওই বাণিজ্য নির্মূল তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার বলেও জানান তিনি। এর আগে এমপি বাবতেন এক টুইট বার্তায় বলেন, যেসব কুয়েতি কর্মকর্তা অর্থ পেয়ে বাংলাদেশি মানবপাচারকারী কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে সহযোগিতা করেছেন তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কারণ তারা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য আমাদের দেশ, জাতি-ধর্ম সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছেন।তাদের শাস্তি পেতেই হবে। পাপুলকে জিজ্ঞাসাবাদে তার কমাণ্ডে কাজ করা যেসব কুয়েতি নাগরিকের নাম সিআইডি পেয়েছে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু করতে বাবতেন দেশটির দুর্ণীতি দমন কমিশনের প্রতি আগেই আহ্বান জানান। পার্লামেন্টে দেয়া মঙ্গলবারে বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব থাকা উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস সালেহ বলেন, তথাকথিত ভিসা ট্রেডারদের নাম প্রসিকিউশনের কাছে আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য টিম সেই নামগুলো ক্রস চেক করছে। প্রশ্নে জর্জরিত অভিযুক্তরা নানা কারণে বিভিন্ন জনের নাম বলতে পারে। তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মন্ত্রী সংসদকে আশ্বস্ত করেন, প্রসিকিউশনে রক্ষিত একটি নামও তারা পরবর্তী বিস্তৃত তদন্তের বাইরে রাখছেন না। কারও নাম তারা গোপনও করছেন না। তিনি নিশ্চিত করেন যে, তদন্তে প্রমাণিত সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। দু’দিন আগে এক টুইটট বার্তায় উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে গ্রেফতার এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদে মানবপাচার, ভিসা বাণিজ্য এবং অর্থ পাচারে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপাটমেন্টের চৌকস কর্মকর্তাদের স্যালুট জানান। সেদিন তিনি বলেন, গত সপ্তাহে মানবপাচারসহ বহু অভিযোগে এশিয়ান ওই অভিবাসীকে নিজেদের কব্জায় নেয়ার মধ্য দিয়ে অন্যতম বৃহৎ এবং চাঞ্চল্যকর একটি মামলার রহস্য উন্মোচনে তারা সফল হয়েছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব বিষয় উদ্ভাবন হয়েছেন, যেখানে সন্দেহজনক বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেনের উপস্থিতি তথা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মিলেছে।