বিদ্যুৎ সরকার : ‘নো উইম্যান নো ক্রাই…’ বব মার্লের গাওয়া প্রিয় গানগুলোর একটি, অনেক দিন পর শুনছি। বেশ ভাল লাগছে, মনে হয় আজই বুঝি প্রথম শুনলাম। অথচ, প্রায় ত্রিশ বছরেরও আগে গানটি শোনা হয়ে ছিল। সাথে, সে এলবামে থাকা অন্য গানগুলোও। এমন করে আমার শোনা সে সময়কার প্রখ্যাত শিল্পীদের গান খুঁজে খুঁজে বের করে শুনছি – যেমন নেইল ডায়মন্ড, স্যুজি কোয়াট্র, এলটন জন, ক্লিফ রিচার্ড সহ অন্যান্যদের একক গানগুলোও। প্রতিদিনের বিনোদনের তালিকায় আছে নতুন-পুরনো বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দী ছায়াছবি দেখা ও গানসমূহ শোনা। ট্রাংকের ভেতর আরো আছে নেপথেলিনের গন্ধমাখা কৈশরের ফটোগ্রাফ, বন্ধুদের চিঠি, মেয়ে বন্ধুদের দেয়া গোলাপের পাপড়ি বা সুগন্ধী মাখা নীল খামের চিঠি। চিঠিগুলো খুলে খুলে পড়ি ও স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে অ¤ø-মধুর ঘটনা প্রবাহ অনুধাবন করার চেষ্টা করি। পড়ে পড়ে অবাক হই, আজ কে কোথায় অবস্থান করছি, সময়ের ব্যবধানে বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই দানা বেঁধে চলছে পরষ্পরের মাঝে। এমন করেই একদিন আমরা একে অপরের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবো নিশ্চিত। অনেক বন্ধু সহপাঠীদের কথা মনে পড়ছে, তেমনি মনে পড়ছে নিজ মহল্লার খেলার সাথী ও পাড়া-পরশীদের কথা। নিজ পাড়ার খেলার সাথীদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল দৃঢ়, অটুট। ইচ্ছে হলেই যখন তখন পাড়ার বন্ধুদের বাসায় ঢুকে ওদের সাথে খেতে বসে পরতাম। এমন করে পারিবারিক বন্ধনেও আমরা পরস্পরের সাথে আবদ্ধ হয়ে যেতাম অজান্তেই। সমস্ত পাড়াটাই মনে হতো আমাদের একটা বিরাট পরিবার। হয়তো মফস্বল শহরগুলোর সামগ্রীক চিত্রটাই ছিল এমন। প্রতিটি শহরেই এমন অনেকগুলো পাড়ার সমষ্টি নির্ভর শিল্প চর্চা, শিষ্টাচর, খেলাধুলা বা বিনোদন কার্যক্রম লালিত হতো। যার দরুন নিজ নিজ পাড়ার প্রত্যেকেই একে অপরের খুউব কাছাকাছি থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম। সুখে-দুঃখে, যে কোন উৎসব পার্বনে সবাই মিলে একসাথে উদযাপন করে আনন্দের ভাগী হতাম আমরা।

আমাদের একজন বন্ধু ছিল যে আমাদের পথ দেখিয়ে দিতো পথ হারালে, আলো জ্বেলে দিতো ঘোর অন্ধকারে, সাহস জুগিয়ে দিতো দুর্যোগ- ঝঞ্ঝায়। আমাদের মেন্টর, গাইড, শুভাকাঙ্খি, রোল-মডেল ‘জয়াদি’। আমার দু’ক্লাশ উপরে পড়তো বলে স্বাভাবিকভাবেই সমীহ করতাম। কিন্তু, এতটাই বন্ধু বৎসল ছিল যে কখনো ভাবার সুযোগ হয়নি সে আমাদের বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু। প্রয়োজনে কিন্তু শাসন করতে কখনো ভুল করতো না জয়াদি। বিজ্ঞান শাখায় ছিলাম বলে পড়া-লেখায় তার সাহচর্য পেয়ে যেতাম যখন-তখন। যার দরুন জয়াদির অনেকটা কাছে যাবার সুযোগ হতো আমার। মাঝে মাঝে শাসন করতো প্রয়োজন হলে। কিন্তু আদরটাই বেশি বেশি আদায় করে নিতাম সুযোগ পেলেই। এভাবেই জয়াদি আমার কাছে এক অনন্য আপন জন হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। একই কলেজে পড়ার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই জয়াদি’র সাথে দেখা হতো। কলেজ বা পাড়ার অনুষ্ঠানগুলোতে জয়াদি’র একটি বড় ভূমিকা থাকতো। পাড়া ও কলেজের আমার অনেক বন্ধুই জয়াদিকে ভালোবাসে কিন্তু আমার ভালোবাসাটা মনে হয় বেশি, সে জন্য যেদিন পড়া শেষ করে সে কলেজ ছাড়লো সেদিন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়েছিল। পাড়াতেও তেমনটা আর দেখা হতো না। দ্বিতীয়বার মন খারাপ হয়ে ছিল যে দিন জয়াদি’র বিয়ে হয়ে এ পাড়া ছেড়ে, এ ছোট্ট শহর ছেড়ে বরের সাথে চলে গেল দূর দেশ আমেরিকার শিকাগো শহরে। সেখান থেকে জয়াদি প্রায়ই চিঠি লিখতো ভিউ কার্ডের একপাশে সীমিত পরিসরে। যেদিন জয়াদির চিঠি পেতাম মনটা ভাল হয়ে যেতো। প্রায় দু’বছর পর জয়াদি দেশে বেড়াতে এলো। কিছুদিনের জন্য এ পাড়ায় এলো মা-বাবার কাছে। তখন আমাদের সাথেও দেখা হয়েছিল। সেই আগের মতোই তার ব্যবহার, মোটেও বদলায়নি। ফিরে যাওয়ার দিন জয়াদি স্যুভিনর হিসাবে শিকাগো শহরের ছবি সম্বলিত একটি ছোট চাবির রিং দিয়েছিল আমাকে। সেটা যতœ করে রেখে দিয়েছিলাম ট্রাংকের ভেতর আমার অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর সাথেই। আজ যখন ট্রাংক খুলে সযতনে রক্ষিত স্কুল-কলেজের বন্ধুদের দেয়া বস্তুগুলো দেখছিলাম ও পুরনো স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাচ্ছিলাম, আমাদের পুরনো ফেলে আসা দিনগুলোতে, ঠিক তখনি পেয়ে গেলাম জয়াদি’র দেয়া ছোট্ট চাবির রিংটি।

জানো জয়াদি অনেকদিন পর তোমার কথা আবার নতুন করে মনে পরলো। কেমন আছো তুমি জয়াদি? কতো দিন তোমায় দেখি না। তোমার শিকাগো ফিরে যাওয়ার পর আমিও ল্যান্ডেড ইমিগ্রেন্ট হয়ে চলে এলাম পৃথিবীর অন্য একটি শহর ইটালিতে। এভাবেই বুঝি মানুষ তার প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রয়োজনের তাগিদেই। অন্য এক সুখ অন্বেষায় ভালোবাসাটা, হৃদ্যতা সেখানে গৌণ, উপেক্ষিত। এক স্বপ্নময় পৃথিবীর খোঁজে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছি প্রিয়জনদের কাছ থেকে, চির পরিচিত মাটির সোঁদা গন্ধের বুক ভরা নিশ্বাস থেকে! জয়াদিও তুমি ভাল থেকো। হয়তো, কোন একদিন দেখা হবে আমাদের ফেলে আসা ছোট্ট শহরে, সেই চির পরিচিত বন্ধু পাড়ায়।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা