হাসান গোর্কি : নারিকেলের শাঁসের রঙ কী? সহজ উত্তর- ‘সাদা’। কিন্তু উত্তর হওয়া উচিত- ‘নারিকেলের শাঁস সূর্যের আলোয় সাদা রঙ ধারণ করার বৈশিষ্ট্য রাখে।’ সাদা এবং কালো আসলে কোন রঙ নয়; এরা যথাক্রমে সব রঙের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি। কোন উৎস থেকে আলো কোন বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের রেটিনায় পড়লে আমরা বস্তুটিকে দেখি। বস্তুটি যদি সব কয়টি মৌলিক রঙ প্রতিফলন ঘটায় তাহলে বস্তুটিকে আমরা সাদা দেখি; সব কয়টি রঙ শোষণ করে নিলে তাকে কালো দেখি; আর কোন একটা নির্দিষ্ট রঙ শোষণ করতে ব্যর্থ হলে আমরা বস্তুটিকে সেই রঙে দেখি। আপেলের গায়ে যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন সে লাল ছাড়া সব রঙ শোষণ করে নেয়। লাল রঙ প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে এবং আমরা আপেলকে লাল দেখি। কোন কারণে যদি আপেলের খোসা সবগুলো রঙ শোষণ করে নিতে শুরু করে তাহলে আমরা তাকে জামের মতো কালো দেখবো। সূর্যের আলোয় যদি লাল রঙ অনুপস্থিত হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর সব গোলাপের রঙ কালো হয়ে যাবে, তরমুজ কাটার পর ভেতরটা মিশমিশে কালো দেখাবে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ভেতরের বৃত্তটা কালো হয়ে যাবে, সনাতন ধর্মের মেয়েরা বিয়ের সময় কালো সিঁদুর পড়বে, কালো রঙের সরিষার তেলে ডিম ভাজা হবে।

শুরুর প্রশ্নে আসা যাক- নারিকেলের শাঁসের রঙ কী? নারিকেলের শাঁস সারাজীবন কালো-ই থাকে। নারিকেল ভাঙার পর খোলের মধ্যে আলো ঢুকলে তাকে সাদা দেখায়। আমরা যদি সাথে সাথে তাদের খেয়ে ফেলি তাহলে পেটে গিয়ে তাদের রঙ আবার কালো হয়ে যায়। জীবনে পাঁচ বা দশ মিনিট তার সাদা থাকার সুযোগ ঘটে। নারিকেলের শাঁসের জীবন একটা মায়া। এরকম অসংখ্য মায়ার মধ্যে আমরাও থাকি। ‘মায়া’ শব্দের প্রথম অর্থ মমতা বা ভালবাসা। দ্বিতীয় অর্থ ‘বিভ্রম’ (ইলুশন)। এখানে আমরা দ্বিতীয় অর্থে কথা বলছি। আমাদের যকৃতের রঙ টকটকে লাল বলে আমরা জানি। কিন্তু যাদের দাহ করা হয় তাদের বাদ দিলে ৯৯.৯৯% বা তারও বেশি মানুষের যকৃত জীবনে কখনও লাল রঙ ধারণ করতে পারে না। দুর্ঘটনায় বা অস্ত্রোপচারের সময় বক্ষ উন্মোচিত হলে যকৃত কিছু সময়ের জন্য লাল রঙ ধারণ করার সুযোগ পায়। যাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় এবং সমাহিত করা হয় তারা একটা গভীর কালো রঙের যকৃত নিয়েই জীবন পাড়ি দিয়ে ফেলে।

চিত্র-১

কোন কিছু দেখার ক্ষেত্রে আরও অনেক বিভ্রান্তি কাজ করে। খালি চোখে আমরা ০.০৪ মিলিমিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বস্তুকে দেখতে পাই। একটা চুল থেকে ০.০৪ মিলিমিটার কেটে নিলে তার যে আকৃতি দাঁড়াবে সবচেয়ে ভালো চোখের মানুষরা সেটা দেখতে পাবে। কিন্তু ০.০২ মিলিমিটার কেটে নিলে সেটাকে আর দেখা যাবে না। একারণে পদার্থের অণু-পরমাণু, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া, আমাদের দেহ কোষ আমরা খালি চোখে দেখি না। আমাদের শরীরের দিকে তাকালে আমরা যে মসৃণ চামড়া দেখি সেটা আসলে ততখানি মসৃণ নয়। আমাদের চোখের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা এরকম দেখি। আমাদের চোখ কয়েক লাখ গুণ বেশি শক্তিশালী হলে আমাদের চামড়াকে আমরা পাহাড়ি উপত্যাকার মতো এবড়ো থেবড়ো দেখতাম। চিত্র-১ এ আড়াই মিলিয়ন গুণ বিবর্ধন ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তোলা ১০টির মতো দেহকোষের ছবি দেখা যাচ্ছে।

চিত্র-২

আমাদের দেহের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো অণুজীবদের কাছে দৃশ্যটা হয়তো এরকম। এক কোষ থেকে অন্য কোষে পাড়ি দিতে তাদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ পাড়ি দিতে হয়, মাঝখানে ঘুম বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া সারতে হয়। চিত্র-২ এ ইনজেকশন দেওয়ার পর শরীরে যে ফুটোর সৃষ্টি হয় তার ছবি দেখা যাচ্ছে। আমরা খালি চোখে এটা দেখি না; কিন্তু অণুজীবরা হয়তো এটাকে একটা বিশাল পাহাড়ি গুহার মতো দেখে। আমরা যদি অণুজীবদের মতো ক্ষুদ্র আকার ধারণ করে অন্য কারো রক্তনালীর দেওয়ালের ভেতরের অংশে গিয়ে বসতে পারতাম তাহলে দেখতাম সামনে দিয়ে যমুনার মতো বিশাল রক্তের নদী কলকল শব্দে তরঙ্গ তুলে বিপুল বেগে বয়ে চলেছে। তার অর্থ আমরা যা দেখছি তা-ই একমাত্র সত্যি নয়; বরং অনেকগুলো সত্যের একটা রূপ, অবস্থান ভেদে যা বদলে যায়। কেউ যদি এভারেস্টের সমান বড় হয়ে যায় তাহলে সে বাঁকি মানুষদের পিঁপড়ার মতো হেঁটে বেড়াতে দেখবে।

আমাদের চিন্তা ও ধারণার বিষয়গুলো আরও অস্পষ্ট। ঢাকায় থাকতে আমি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কয়েকজনকে চাকরি পেতে সাহায্য করেছি। এ কাজে আমার সাধ্যের বাইরেও তাদের জন্য শ্রম দিয়েছি। তাদের প্রশংসার সাথে নিজের বিশ্বাস মিলিয়ে তখন নিজেকে খুবই পরোপকারী ভাবতাম। কিন্তু আমি কোন ভালো চাকরির জন্য আবেদন করলে সে খবরটা এমন কাউকে দিতাম না যে আমাকে টপকে চাকরিটা পেয়ে যেতে পারে। আর চাকরি পেতে আমি তাদেরই সাহায্য করেছি যারা আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করে এবং চাকরি পাবার পর আরও বেশি করে পছন্দ করবে।

ব্যাপারটা আসলে এই যে আমি যা করেছি তার সবটুকু নিজের স্বার্থে করেছি; নিজের উপকারের জন্যই করছি। কেউ যদি প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতার আশা না করে মানুষের উপকার করে যায় তাহলেও তাকে পুরোপুরি নিঃস্বার্থ বলা যাবে না। অন্যের উপকার করার মধ্যে যে আত্মশ্লাঘা বা আত্মতৃপ্তি আছে সেটাই তার প্রতিদান। এটা পেতেই সে অন্যের উপকার করে। সেটা অবশ্য আমাদের চেয়ে ভালো। মাদার তেরেসা সারাজীবন কোলকাতার বস্তিবাসীর জন্য কাজ করেছেন। আমরা তার পরার্থপরতার দিকটি দেখছি। কিন্তু আমরা জানি না ঈশ্বরের কাছে অনেক বড় প্রতিদান (স্বর্গ) পাবার আশায় তিনি পার্থিব জীবনটা কষ্ট করে পার করেছেন কিনা। হয়তো তিনি বড় স্বার্থের জন্য ছোট স্বার্থগুলোকে বিসর্জন দিয়েছেন।

আমরা নিজেদের ন্যায়বিচারক ভাবতে পছন্দ করি। এটাও একটা বড় বিভ্রম। আমি অর্ধ শতাব্দীর জীবন পার করে এসেও খুব কম সংখ্যক ঘটনার কথাই মনে করতে পারি যেখানে আমার নিজেকে দায়ী মনে হয়। যে কয়টা বের করতে পারি সেগুলোর এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাই যাতে আর সেগুলো অপরাধের মধ্যেই থাকে না। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই বিষয়টা সম্ভবত এরকম-ই। আমাদের সবার ধারণা সত্যি হলে তো পৃথিবীতে অন্যায়, অনাচার, হিংসা, হানাহানি, অপূর্ণতা— এসবের কোনকিছুই থাকার কথা নয়; পৃথিবীটাই স্বর্গ হয়ে যাবার কথা। আসলে আমাদের প্রত্যেকের আলাদা করে বুঝতে ভুল হচ্ছে এবং আমাদের সন্মিলিত বিভ্রান্তি পৃথিবীতে অশান্তি টিকিয়ে রেখেছে। বিভ্রান্তির একটা ঘটনা বলি : ২০০৭ সালের এক সন্ধ্যায় ঢাকা নিউমার্কেট থেকে রিকশা করে ধানমন্ডি যাচ্ছি। রিকশাচালক অবাঙালি বয়স্ক একজন মানুষ। প্রথম থেকেই লক্ষ করলাম সে বেশ অসহিষ্ণু; মাঝে মাঝেই অন্য চালকদের গালিগালাজ করছে। মাঝে মাঝে একটা স্ল্যাং এর সাথে ‘বাঙাল’ বলছে।

মনে মনে ভাবলাম ১৯৭১ সালে এই লোকটা হয়তো বাঙালিদের গলা কেটেছে। আমি কিছু বললাম না। ভিড় এড়াতে তাকে মিরপুর রোড দিয়ে যেতে বললাম। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে আমরা জ্যামে পড়লাম। সে তখন বলতে শুরু করলো এরকম ঘটেছে আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। আমি তাকে বললাম, “আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল সেটা যদি আপনি আগেই বুঝে থাকেন তাহলে আমার নির্দেশ মানলেন কেন?” সে চুপ করে থাকলো। বাসার গেটে পৌঁছার পর সে ১০ টাকা বেশি দাবি করলো। আমি বেশি দিতে অস্বীকার করলে সে এবং চিৎকার করে লোক ডেকে বিচার দিতে শুরু করলো । আমি তাকে চড় মেরে মাটিতে ফেলে দিলাম। সে কাকুতি মিনতি করে মাফ চেয়ে টাকা নিয়ে চলে গেলো। তার এবং আমার আচরণের নিজ নিজ পক্ষে যুক্তি আছে। আমি ভাবছি তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে আমি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু নিরপেক্ষ কোন আদালতে বিষয়টা উত্থাপন করলে বিতর্কাতীতভাবেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো। তার অর্থ এক্ষেত্রে আমার ন্যায়বিচারের ধারণা ভ্রমাত্মক ছিল।

খ্রিস্ট ধর্মে সাতটি গুরুতর পাপের প্রথমটি হলো অহংকার। আমরা বলতে পছন্দ করি যে, আমাদের কোন অহংকার নেই। “আমি নিরহংকার”- এই কথাটার মধ্যেই অহংকার লুকিয়ে আছে। আমি কেন এটা ঘোষণা করতে যাচ্ছি! ২০১৪ সালে ফেসবুক খোলার পর আমি বিভিন্ন জনের পোস্টে গিয়ে ভুল ধরতাম। তাদের বেশিরভাগ-ই ছিল নিরীহ মানুষ। আমার তথ্য ভান্ডারের সাথে যুদ্ধ করে তাদের টিকতে পারার কথা নয়; প্রায়-ই তারা হেরে যেতো। এবং আমি শান্তিতে ঘুমাতে যেতাম। কাজটা আমি এখনও করি। তবে অনেক সাধনা করে কমিয়ে দিয়েছি। অন্যকে বুঝানোর জন্য আমার এই কু-কাজের যুক্তি হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেওয়া হলে তা থেকে অনেক মানুষ ভুল শিখবে। আমি আমার সাধ্যমতো সেটা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করি। বাস্তবে ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। আমি ফেসবুকের ঐ বন্ধুদের কাছে আমার জ্ঞানের স্বীকৃতি চাই, যা আমার অহংকে তৃপ্ত করে। ফেসবুকের ঐ বন্ধুরা আমার সম্পূর্ণ অচেনা হলেও ক্ষতি নেই। আমার চাই জয়, স্বীকৃতি ও প্রশংসা। ভার্চুয়াল পাবকিল স্ফেয়ারের সুবিধা হলো এখানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করার ঝুঁকি নাই। ফলে আমাদের ভাবনাগুলোকে আমরা সাবলীলভাবেই প্রকাশ করে দিতে পারি। এতে আমাদের ভেতরে জমে থাকা এমন অনেক কথাও বের হয়ে আসে যা আমরা অন্যদের সামনাসামনি বলতাম না।

আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি ঈর্ষা আছে। সেটা আমরা খুব কম-ই বুঝতে পারি। বিবর্ধন কাঁচ দিয়ে দেখলে হয়তো সেটা দ্বিতীয় ছবির সূচ ফোটানো গহ্বরের মতোই বড় দেখাবে। আমি সবাইকে বলি, কারো প্রতি আমার কোন ঈর্ষা নেই। এটা পুরা সত্য নয়। লেখালেখির কথাই ধরা যাক— এই জগতে আমার বেশ ক’জন বন্ধু আছে। আমার কাছাকাছি মেধার সব লেখকের সাফল্যকে আমি ঈর্ষা করি। আমার চেয়ে দুর্বল কাউকে মনে করলে তাকে পরামর্শ দিয়ে বা অন্যভাবে সাহায্য করি। কিন্তু তাদের কেউ যদি আমাকে অতিক্রম করে যায় তাহলে সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে ঈর্ষা করতে শুরু করি। তিথি আফরোজ বয়সে আমার অর্ধেক। সে কবিতা লেখে। আমার লেখা গল্প পড়ে সে একটা গল্প লিখলো। দুর্বল গাঁথুনির গল্প। আমি তাকে দুর্বলতাগুলো বুঝিয়ে দিলাম। পরে সে তিনটা গল্প লিখে পাঠালো। দেখলাম সে আমার চেয়ে ভালো লিখেছে। তার গল্প তিনটির দুটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নামকরা দুটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে, যেখানে আমি কয়েকবার গল্প পাঠিয়েও ছাপতে পারিনি। আমি ঈর্ষা করতে শুরু করলাম।

তাহলে আমার কেনো মনে হলো কারো প্রতি আমার কোন ঈর্ষা নেই! এটা আত্ম-বিভ্রান্তি। এরকম মনে হবার কারণ হলো, যে লেখকরা আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে তাদের আমি ঈর্ষা করি না। আমি নিজের কাছে মহান থাকার জন্য শুধু সেই টুকুই বিবেচনায় নিয়েছি। এতে তো প্রমাণ হয় না যে আমি ঈর্ষাপরায়ণ নই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জাকির তালুকদার, ইমতিয়ার শামীম বা ফাইজুল ইসলামের প্রতি তো আমি জোর করেও ঈর্ষা নিয়ে আসতে পারবো না, যেমন তারা পারবেন না রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশের প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে।

আমরা যে বড় মাপের আত্ম-বিভ্রান্তিতে ভুগছি তার নমুনা পাওয়া যায় ফেসবুকে। কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক লিখেছেন, “আমার শ’খানেক বন্ধুর মধ্যে এক জনকেও পেলাম না যে পরচর্চা করে না। তারা কি জানে না।” এরপর একটা ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতি। যিনি এটা লিখেছেন তিনি বুঝতে পারেননি যে তিনিও তার বন্ধুদের বিপক্ষে পরচর্চা করছেন (যেমন আমি এই বেনামি ব্যক্তির বিরুদ্ধে করছিৃ)। এই পোস্টে চার/পাঁচশ’ মানুষ লাইক/লাভ সাইন দিয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাও যে একই এরকম সেরকম মন্তব্য লিখেছে একশ’র বেশি মানুষ। (আমি কী লিখেছি সেটা বলছি না। দুই প্যারা উপরে গেলে আপনি সুত্র পাবেন)। তাহলে বিষয়টা কি এরকম দাঁড়াচ্ছে না যে অন্য মানুষের নিন্দা করেন না এমন মানুষরাই ফেসবুক ব্যবহার করেন! সব বিবেচক, ন্যায়পরায়ণ, দূরদর্শী ভালো মানুষের সমাবেশ ঘটেছে ফেসবুকে! কিন্তু আমরা জানি বাস্তবে সেটা ঘটার কারণ নেই। বরং এটা ভাবাই যুক্তিযুক্ত যে আমরা সবাই আত্ম-বিভ্রান্তিতে ভুগছি, যেমনভাবে নারিকেলের শাঁসের রঙ নিয়ে আমরা দীর্ঘ বিভ্রান্তিতে থাকি।

আত্ম-সমালোচনার কাজটা কঠিন। আমরা তো পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র একটা প্রাণী মাত্র। ইশ্বর নিজেও তার স্তুতি গান। সাইক্লোনে গর্ভবতী নারী, শিশু সহ এক মিলিয়ন মানুষ মরে গেলে তার পক্ষে যুক্তি দেন। সূর্যের আলো না পেয়ে গুল্ম মরে গেলে বিটপ তার জন্য অনুতপ্ত হয় বলে মনে হয় না। লোকালয় ভাসিয়ে নেওয়া নদীর কাছে তার শৌর্যের স্বাক্ষর রেখে বয়ে চলাই বড় কথা। আমি যদি আমার সকল ক্ষুদ্রতাকে সন্মান করে বেঁচে থাকি তাতে কার কী ! আমি নিজেকে অপরাধী ভাবার চেয়ে এই বোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই যে আত্মসমালোচনার ক্ষমতা প্রকৃতি/ইশ্বর আমাকে খুব নগণ্য মাত্রায় দিয়েছে/ন, তাহলে সমস্যা কোথায়! আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক অধ্যাপক সালেহ আহমেদ ক্লাসে বলেছিলেন, “কারো ক্ষতি না করার চিন্তায় সৎ থেকে কাজ করে যাও। এরপর যে ভুলগুলো হবে তার জন্য নিজেকে তিরস্কৃত করে নিজের কাছে নিজেকে এতোটা ছোট করে ফেলো না যে তাতে তোমার জীবনী শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।”

আমার মস্তিষ্কের যে কোষগুলো আমাকে চালায় বা যারা সন্মিলিতভাবে ‘আমি’ নামের একটা সত্তা তৈরি করে তাকে আমি চিনি না অথবা তারা নিজেদের চেনে না। ৮৫০০ কোটি নিউরন সেল, যারা প্রত্যেকে জীবন্ত, প্রাণবান চিন্তার আকর, তাদের কাউকেই না দেখেই বা তাদের উপস্থিতি আলাদা করে উপলব্ধি না করেই আমরা মরে যাই। এতো বড় বিভ্রম, এই সীমাহীন সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাস করে আমরা যা করছি তার বাইরে কিছু করা হয়তো সম্ভব নয়। হিংসা, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, ক্রোধ পরিত্যাগ করা সম্ভব নয় যেমন সম্ভব নয় ভালবাসা, মায়া, সহমর্মিতা পরিত্যাগ করা। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে ততোদিন নৈরাজ্য ও বিন্যাসের (anarchy and order) এই বৈচিত্র্যহীন-অবিকার, অতল মিশ্রণে খাবি খাবে আর মহান নিষ্কলঙ্ক একটা জগতে বাস করার স্বপ্ন দেখতে থাকবে। হয়তো এ কারণেই জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়াকে আদি পাপ বলা হয়।

hassangorkii@yahoo.com
এপ্রিল ০৮, ২০২২। রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।