ফরিদ আহমেদ : সুচিত্রা সেনকে একবার সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায় প্রশ্ন করেছিলে। বলেছিলেন, কেনো সে তার জীবনী লিখছে না। তাঁর বক্তব্য ছিলো, “তুমি দুইশোরও বেশি ফিল্মে অভিনয় করেছো। বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা তুমি। জীবন্ত কিংবদন্তী বলে সবাই তোমাকে। এই অভিজ্ঞতা কি কম কিছু? এগুলোই মানুষকে জানিয়ে যাও।”
এর উত্তরে সুচিত্রা সেন যা বলেছিলেন তা এ রকম, “আমার জীবনের কথা লিখতে গেলে অনেক বদমায়েশের কথাও যে লিখতে হবে। ফুল ফুটলে শুধু মৌমাছিই আসে না, কালো ভ্রমরও ঘোরে চারপাশে। আমার চারপাশেও এরকম কালো ভ্রমরের অভাব ছিলো না। তুতু হঠাৎ মারা যাবার পরে মেয়েটাকে নিয়ে একা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সুন্দরী একটা মেয়ের জন্য খুবই ভালনারেবল সময় ওটা। সেই সময়ে সুযোগ নিতে কম লোকে চেষ্টা করে নাই।”
সুচিত্রা তাঁর জীবনের কথা লিখে তাঁর ভাষায় ওইসব ‘রাস্কেলদের’ বিখ্যাত করতে চান নাই। যে কারণে তিনি জীবনী লেখার দিকে আগ্রহ দেখাননি। এটাই অবশ্য মূল কারণ কিনা আমরা জানি না। তবে, এর বাইরে আর কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই তাঁর জীবনী না লেখার পিছনে।

সুচিত্রা সেনের মতো ‘রাস্কেলদের’ নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তা করেন নাই অবশ্য কাননবালা দেবী। তিনি তাঁর জীবনী লিখেছেন। আর সেই জীবনীতে ওইসব রাস্কেলদের কথা বলতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁর জীবনী গ্রন্থটির নাম ‘সবারে আমি নমি’। এটা অবশ্য তিনি সরাসরি লেখেন নাই। সন্ধ্যা সেন অনুলিখনের কাজটা করেছেন। যদিও সন্ধ্যা সেন বলেছেন তিনি চেষ্টা করেছেন কাননবালার ভাষাটাকেই বহাল রাখতে। তাঁর ভাষায়, “আমি যতদূর সম্ভব ওঁর ভাষা, কথা বলার সুবিখ্যাত মধুর ভঙ্গি এমনকি সুষমামণ্ডিত ম্যানারিজমও রাখবার চেষ্টা করেছি।”

সুচিত্রা সেনের ঠিক আগেই বাংলা সিনেমার সুপারস্টার নায়িকা ছিলেন কাননবালা দেবী। শুধু নায়িকাই না, পরবর্তীতে তিনি চরিত্রাভিনেত্রী হিসাবেও কাজ করেছেন। নিজের প্রডাকশন হাউজও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেখানে শুধু ছবিই তৈরি করেননি তিনি, ‘সব্যসাচী’ ছদ্মনামের আড়ালের তিন পরিচালকের এক পরিচালকও তিনি ছিলেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সুপারস্টার হওয়াতো অনেক দূরের কথা, ছোটবেলাতে জীবন সংগ্রামে আদৌ তিনি টিকে থাকতে পারবেন কিনা, তা নিয়েই প্রচণ্ড রকমের সংশয় ছিলো। ছোটবেলায় বাবাকে হারান তিনি। অবশ্য আদৌ সেটা তাঁর বাবা ছিল কিনা সে নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। তিনি নিজে অবশ্য সেই সংশয়ের কথা কিছু বলেন না। শুধুমাত্র তাঁর মা তাঁর বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলো কিনা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

তাঁর বাবা মারা যান বিশাল পরিমাণ ঋণ রেখে। তাঁর মা সেই ঋণ পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তাঁকে নিয়ে আশ্রয় নেন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তারা প্রসন্ন মনে তাঁদের স্থান দেয়নি। অনেক কাকুতি মিনতিতে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিলো। মা-মেয়ে সেখানে আশ্রয় নেবার সাথে সাথেই বাড়ির ঝি এবং রাঁধুনি দু’টোকেই ছাড়িয়ে দেয় তারা। মা আর মেয়ে সেখানে সেই ভূমিকাতে কাজ করতে থাকে। কাজ করার পরেও শান্তি ছিলো না। দিবারাত্র তর্জন গর্জন এবং কটুবাক্য বর্ষিত হতো তাঁদের প্রতি। লাঞ্ছনা এবং অপমান সহ্য করেও তাঁরা সেখানে রয়ে গিয়েছিলেন যাবার অন্য কোনো জায়গা আর ছিলো না বলে।
একদিন অবশ্য বাধ্য হয়ে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হয়। সামান্য একটা চায়ের প্লেট তাঁর মায়ের হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিলো অসাবধানতায়। কিন্তু, সেটার জন্য বাড়ির প্রায় সবাই তাঁর মাকে তেড়ে মারতে গিয়েছিলো। মায়ের এই লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারেন নাই তিনি। মাকে নিয়ে বের হয়ে যান ঐ বাড়ি থেকে। সামান্য ভাড়ায় নিজেরাই একটা আশ্রয় জুটিয়ে নেন।

প্রবল আত্মসম্মানবোধ এবং টিকে থাকার লড়াই করার জন্য নেমে পড়েন চলচ্চিত্রে। ম্যাডান থিয়েটারে কাজ করার সুযোগ আসে। একজন অসহায় কিশোরীর জন্য সুযোগ বলার চেয়ে বিপদে পড়া বলাটাই বেশি শ্রেয়। এ যেনো হরিণ শাবকের ব্যাঘ্র বেষ্টিত বনে গিয়ে তাদের মাঝখানে কাজ করা। এই কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য নখরাঘাত সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। অসংখ্য শার্দূলের লোলুপ লালসার থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা লেগেছে। যে পরিচালককে তিনি বাবার মতো সম্মান করতেন, সেই জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত তাঁর অসহায় অবস্থার সুযোগ নেবার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে কিছু না বলে নায়ককে বলে দিয়েছেন শুটিং এর সময়ে চুমু খেতে। ফলে, দৃশ্য শেষ হবার পরেও যখন নায়ক তাঁকে না ছেড়ে চুমু খাবার চেষ্টা করেছে, তিনি অপমানিত হয়েছেন, আক্রান্ত-বোধ করেছেন। তখন ভেবেছেন নায়ক হয়তো নিজেই এই কাজ করেছে। পরে জেনেছেন নায়ক সেটা পরিচালকের আদেশেই করেছে।

শুধু শুটিং এর সময়েই না, শুটিং এর বাইরেও পরিচালক, প্রযোজক বা প্রতিষ্ঠিত নায়কদের লালসার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে নানা সময়ে। সেগুলোকে সামাল দিয়েই একটু একটু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা লেগেছে চলচ্চিত্র-জগতে।
কাননবালার এই সংগ্রামের সাথে ক্যাবারে ডান্সার ‘শেফালি’ ওরফে আরতি দাসের জীবনীর প্রচণ্ড রকমের মিল রয়েছে। শেফালিও ভাগ্য-বিড়ম্বিত এক পরিবারের মেয়ে ছিলেন।
দেশভাগের সময়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁদের পরিবার চলে যায় কোলকাতায়।

সেখানে গিয়ে কাননবালার মতোই একই ধরনের লড়াই তিনি করেছেন। অন্যের বাড়িতে দাসীর কাজ করেছেন। সেখান থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাড়নায় নাম লিখিয়েছিলেন ক্যাবারেতে। ক্যাবারেতে তখন কোনো বাঙালি মেয়ে নাচতো না। শেফালি শুধু নেচেছেন, তাই নয়, শেষ অবধি তিনি সব প্রতিক‚লতাকে ডিঙিয়ে একেবারে শীর্ষে গিয়েও পৌঁছেছিলেন। তাঁকেও এই পথ-পরিক্রমায় অসংখ্য লালসার নদীকে অতিক্রম করতে হয়েছে। এই দিক দিয়ে আরতি দাসের ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ আর কাননবালা দেবীর ‘সবারে আমি নমি’-র মধ্যে আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে।

কাননবালা দেবীর ক্ষেত্রে শুধু নিজের রূপ-যৌবনই বাধা ছিলো না, নবাগত হিসাবেও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার তাঁকে হতে হয়েছে। যেমন তাঁর প্রথম কাজে বেতন ছিলো পঁচিশ টাকা। কিন্তু, তিনি হাতে পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ টাকা। কম বেতন, বেতন চুরি, কাজের বৈরী পরিবেশ, এগুলো নিত্যই তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর বাইরে চুক্তি নামের দাসখতের পাল্লাতেও তিনি পড়েছেন। প্রমথেশ বড়ুয়া যখন তাঁর ‘দেবদাস’ ছবির জন্য তাঁকে পার্বতী চরিত্রে নিতে চেয়েছিলো, তিনি সেটা করতে পারেন নাই ম্যাডান থিয়েটার তাঁকে ছাড়েনি বলে।

এর বাইরেও কানন দেবীকে আরেকটা চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়েছিলো। সেটা অবশ্য শুধু তিনি একা নন, আরো অনেককেই ফেস করতে হয়েছিলো। তিনি যখন চলচ্চিত্রে নামেন, তখন সেটা ছিলো নির্বাক যুগ। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবাক চলচ্চিত্র শুরু হয়। তখন প্রায় সব শিল্পীদের অডিও টেস্ট করানো হয়। এতে করে নির্বাক যুগের অনেক নামী দামী শিল্পীই বাদ পড়ে যান। কাননবালা দেবীকেও অডিও অডিশন দিতে হয়েছিলো। তিনি সেই চ্যালেঞ্জে উতরে গিয়েছিলেন।

উতরে যাবারই কথা। কারণ, শুধু অভিনয় নয়, অসাধারণ কণ্ঠ নিয়েও জন্মেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে শুধু অভিনয়ই করতেন না তিনি, গানেও কণ্ঠ দিতেন। তাঁর গান অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। সুশ্রী মুখ এবং সুকণ্ঠের জন্য অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন সকলের হার্ট থ্রব। পিছনের সংগ্রাম-মুখর দিনগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠতে থাকেন একটা প্রতিষ্ঠানে। অভিনয়ের পাশাপাশি গড়ে তোলেন নিজস্ব প্রডাকশন হাউজ, শ্রীমতি পিকচার্স। এখানে পরবর্তীতে তাঁর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্যও সংযুক্ত হয়েছিলেন। ‘সব্যসাচী’ নামের একটা ছদ্ম পরিচালকের নাম তৈরি করা হয়েছিলো। এই নামের আড়ালে অনেকেই ছবির পরিচালনা করতেন শ্রীমতি পিকচার্সের ব্যানারে।

কাননবালা দেবী অত্যন্ত সাহসের সাথে তাঁর জীবনের অনেক কিছু প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’-তে। এই বইয়ের কল্যাণে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার নায়িকা এবং গায়িকার সংগ্রাম-মুখর জীবন জানার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। কোনো ধরনের পারিবারিক পটভূমিকা এবং শক্তির অনুপস্থিতি থাকা সত্তে¡ও একজন কিশোরী কীভাবে শুধুমাত্র নিজের গুণ এবং কাজের প্রতি একাগ্রতার কারণে শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারেন, সেই অনুপ্রেরণামূলক গল্প আমরা পাই এখানে। যে সমস্ত বাধা-বিঘ্ন তাঁকে টপকাতে হয়েছে, সেগুলোকেও অকপটে তিনি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু, এর মানে এই না যে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি সবকিছু বলেছেন। কোনো আত্মজীবনীই শতভাগ অকপট হয় না। কিছু না কিছু অজ্ঞাত থেকেই যায়।

এই বইতেও তাই আছে। কাননবালা দেবী তাঁর সুদর্শন স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্যের সাথে তাঁর প্রেম এবং বিয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। স্বামীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন পাতার পর পাতা জুড়ে। দেখলে মনে হবে হরিদাস ভট্টাচার্যই বুঝিবা তাঁর প্রথম এবং শেষ প্রেম ছিলো। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। হরিদাস ভট্টাচার্যের আগে তিনি অশোক মৈত্রের সাথে প্রেম করেছেন, বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হয়েছিলেন। অশোক মৈত্র ছিলেন প্রখ্যাত নীতিবাগীশ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের সন্তান। হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ব্রাহ্ম সমাজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর নীতিবাগীশতার অসংখ্য গল্প প্রচলিত আছে। একজন নায়িকার সাথে তাঁর ছেলের বিয়েকে তিনি মেনে নিতে পারেন নাই। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় নানা সংকটে পড়ে কাননবালা দেবী এবং অশোক মৈত্রের বিয়েটা ভেঙে যায়।

আত্মজীবনী শতভাগ অকপট হয় না, কিছু না কিছু বিষয় লেখক লুকিয়ে রাখেন, সেটাকে মাথায় রেখে পড়াটাই আসলে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। ‘সবারে আমি নমি’-র ক্ষেত্রেও আমি সেই কথাটাই বলবো। কতোখানি অজ্ঞাত রয়ে গিয়েছে সেটা না ভেবে, যেটুকু জ্ঞাত হয়েছে, সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত আমাদের। উনি লিখে গিয়েছেন বলেই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাক সময় কালের চিত্রটা আমরা কিছুটা হলেও পাচ্ছি। সেটাই বা কম কীসে। এর বাইরে তাঁর সংগ্রামমূখর জীবন থেকে প্রেরণা পাওয়াটাতো বাড়তি পাওনা।