নাদিরা তাবাসসুম : আজ সকাল বেলা থেকেই সূর্যের আলোটা বেশ উজ্জ্বল দেখালেও উত্তাপ তেমন নেই। একটু শীত শীত লাগছে। তাতে কি, সকালে সূর্যের আলো দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। তাই বহুদিন পর মাস্ক ছাড়া তিন বন্ধু মিলে বাইরে হাঁটতে বেড়িয়েছে। দিদার, দিনার আর রুহান পূর্বেকার ( কভিড-১৯-এর পূর্বে) মতো পার্কের চারপাশ ধরে হাঁটতে থাকে। দিদার বলে- আমরা আগের মতো বাইরে চলাফেরা করতে পারছি ভেবে আনন্দ লাগছে ঠিকই কিন্তু করোনা ভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়নি। আমাদের এখনও সাবধান হয়ে চলা উচিত। বাসা থেকে বেরুনোর সময় আমার ছেলে মাস্ক পরতে বলেছিল আমি পরিনি। মাঝে মাঝে দম নিতে কষ্ট হয়।

রুহান- কষ্ট হলেও মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। ভাইরাসের ঝুঁকি ছাড়াও আরো কত বিপদ আপদ ভয়ভীতি বর্তমান যুগের মানুষের নিত্যসঙ্গী। যুগ যুগ ধরে আমাদের মতো কত শত মানুষ এ পৃথিবীর বুকে বসবাস করেছে আবার চলেও গিয়েছে। যারা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আমাদের এ যুগের মানুষও গত হয়ে যাবে আবার নতুন প্রজন্মের নতুন মানুষদের নিয়ে জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকবে। সকল যুগের মানুষকে এভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বিগ্রহ ও ভয়ভীতি সাথে নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এর মাঝে কেউ বেঁচে থাকতে পারে আবার কেউ পারে না। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান সাক্ষ্য দেয়, দুর্বলেরা সবসময় সবল কর্তৃক নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শাসিত। শুনেছো নিশ্চয়ই ডারউইন এবং হার্বার্ট স্পেন্সার যেটাকে ‘Survival of the fittest’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে সভ্যযুগের জ্ঞান বিজ্ঞানে আলোকিত মানুষ পৃথিবীকে সুখ-শান্তিময় এবং বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে যদি পরস্পর প্রেম, ভালবাসা, সহানুভূতি ও মানবিক গুণাবলীর প্রয়োগ করতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং কখনও কোন প্রকার সীমা লঙ্ঘন না করে। কারণ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না। সীমা লংঘন বলতে নিজের খেয়াল খুশী অনুযায়ী যে কোন মন্দ বা হিংস্র কাজ অতিরিক্ত ও বাড়াবাড়ি করা। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা কাসাস-এর ৫০ নং আয়াতে বলেছেন “যে আল্লাহর পথ ছেড়ে প্রবৃত্তির দাসত্ব করে তার চেয়ে বড় ভ্রান্ত আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না”। তিনি একই সূরার ৫৯ নং আয়াতে বলেছেন “আমি জনপদসমূহকে কেবল তখনই ধ্বংস করি, যখন এর বাসিন্দারা জুলুম করতে থাকে”

দিনার – বিশ্ব জগতে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি এবং ধ্বংসের খেলা চলছে কতগুলো নিয়মনীতির উপর ভিত্তি করেই। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার এই নীতিগুলোকে ‘ল’ অফ গ্রাভিটি বলুক,’ ‘ল অফ ইলেক্ট্রো মেগনেটিক ফোর্স’ বল্কু, ‘উইক নিউক্লিইয়ার ফোর্স,’ অথবা ‘স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স’ বলুক- সবই ফোর্স বা এনার্জি যা খালিচোখে দেখা যায় না; কিন্তু আমরা বিশ্বাস করছি। অবাক হবে জানলে যে, বিশ্বজগতের ৯৫% জিনিষ মানুষের দৃষ্টিগোচরের বাইরে অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই না; মাত্র ৫% আমরা দেখতে পাই। এজন্য আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন যে, তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য; গুপ্ত ও প্রকাশ্য সব জানেন। আর একটা জিনিষ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মহাবিশ্ব ক্রমাগত স¤প্রসারিত হচ্ছে- যা পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষকে জানিয়েছেন। এ স¤প্রসারণ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা তিনিই ভালো জানেন।

দিদার- কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় “তিনি সৃজন, পালন, ধ্বংসকারী”। মানুষের জন্য বাসযোগ্য একমাত্র এই পৃথিবীকে তিনি চাইলে নিশ্চয়ই সকল ভয়ভীতি এবং বিপদ আপদ মুক্ত করে দিতে পারতেন! কিন্তু তিনি তা করেননি। আমরা দেখি, সৃষ্টিজগতের সবকিছু প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল হচ্ছে। সৃষ্টির সেরা মানুষের জীবনেও ঘটছে ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধন। জীবনের সকল সময় এক অবস্থায় কাটছে না। মানুষের কর্মফলের কারণে বা প্রকৃতির নিয়ম-নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে নেমে আসে দুর্যোগ, মহামারী ইত্যাদি। তবে এ সবই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় হয়ে থাকে। এভাবে তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে কারা ধৈর্য্যশীল আর সহনশীল এবং কারা ধৈর্য্যহারা বা দুর্বল ঈমানের অধিকারী সে পার্থক্য করে ফেলেন।

রুহান – পবিত্র কোরআনে ভয়ভীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে দু’ভাবে। বাহ্যিক ভয়-ভীতি যা ইহলৌকিক জীবনে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময় সঞ্চারিত হয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। এতে আল্লাহ তার ঈমান পরীক্ষা করেন। আর দ্বিতীয়ত মৃত্যু, কিয়ামত, হাশর-নশর, হিসাব-নিকাশ ও দোজখের শাস্তির কথা স্মরণ করে আল্লাহকে ভয় করা। আর এই খোদাভীতির কারণেই পবিত্র কোরআন মোত্তাকীদের জন্য হেদায়েত হিসাবে অবতীর্ণ। বাহ্যিক ভয় শুধু বিপদআপদ, অভাব-অনটন ও দুর্যোগের কারণেই ঘটে থাকে। আর পরকাল ও আল্লাহভীতি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন;
“আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রাখ যে, তাঁর কাছে তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে” (সূরা বাকারা; আয়াত ২০৩)

“যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পথ করে দেন, আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার সব কাজের সহজ সমাধান দিয়ে থাকেন। এটা আল্লাহর অবতারিত বিধান, যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন আর তাকে মহা পুরস্কার প্রদান করবেন” (সূরা তালাক; আয়াত২-৫)
“বলুন, পবিত্র ও অপবিত্র সমান নয়, যদিও মন্দের আধিক্য আপনাকে বিস্মিত করে, সুতরাং হে জ্ঞানীরা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর! যেন তোমরা সফলকাম হতে পার” (সূরা মায়িদা; আয়াত ১০০)

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, নিঃসন্দেহে কেয়ামতের প্রকম্পন ভীষণতর” (সূরা হাজ্জ; আয়াত ১)
“হে আদম সন্তান! তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের কাছে রাসুল এসে আমার আয়াত শুনালে যে তাকওয়া অবলম্বন করবে ও সংশোধিত হবে, তাদের কোন ভয় নেই, তারা দুঃখিতও হবে না” (সূরা আরাফ; আয়াত ৩৫)

দিদার- মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতিদিনের কাজকর্মে ও বিপদে আপদে ধৈর্য্য ধারণ করার এবং কখনও কোন কাজে সীমা লঙ্ঘন না করার তৌফিক দান করুন। আজকের মতো আমরা হাঁটাহাঁটি এখানেই শেষ করতে পারি। চলো বাসায় ফিরে যাই। আল্লাহ হাফেজ ।