শুজা রশীদ : (পর্ব ৪২)
৬০
পুলিশ খুব দ্রুত এসে হাজির হল। নোমানকে দুর্বৃত্তের নাক ভাঙার জন্য তারা গ্রেফতার না করায় সে পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ফেলল। আঙ্গিনার মেঝেতে লাল রক্তের ছোপ। এক দল পুলিশ ছবি তুলল, ওদের সবার ইন্টারভিউ নিল। অন্যদল গেল পিন্টুর পেছনে। রিমার বাসা থেকে পুলিশ বাহিণী যখন বিদায় হল তখন পর্যন্ত পিন্টুর খোঁজ পাওয়া যায় নি। সে বাসায় ফেরে নি। পুলিশ আশে পাশের সব হাসপাতালে খবর নিয়েছে। খোঁজ মেলে নি। কিন্তু তারা রিমাকে নিশ্চিত করেছে ওকে খুঁজে বের করে এরেস্ট করা হবে। তারা রিমাকে ওয়াকিবহাল রাখার প্রতিশ্রুতি দিল।

নোমান বেশ ভড়কে গেছে। এটাই বোধহয় তার জীবনে প্রথম মারপিট। তার সমস্ত শরীরে ব্যাথা করছে, মাথাটা দপ দপ করছে। তার কপালে কিছু ছোট ছোট ক্ষত হয়েছে। খুব সম্ভবত পিন্টু দাঁত দিয়ে কামড় দিয়েছিল। ও আশা করছে পিন্টুর দাঁতে কোন সমস্যা না হলেই হয়। যদি হয় তাহলে পিন্টু হয়ত প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এবার ওর পিছু লাগবে।

নোমান রাতে রিমার বাসায় থাকতে চেয়েছিল। কে জানে পিন্টু যদি আবার এসে হাজির হয়। কিন্তু রিমা তার প্রয়োজন দেখেনি। ও তাকে নিজের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তাকে দেখেই বোঝা গেছে তার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। রাতে ভালো ঘুম হওয়াটা দরকার। নোমান যেতে চায়নি। রিমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে যদি রিমার কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে সে অবশ্যই তাকে ফোন দেবে, যত রাতই হোক।

কালাম এলো পরদিন দুপরে। আগের দিন সন্ধ্যায় আসতে পারে নি কারণ মরিয়মের মেয়েদেরকে পড়াতে গিয়েছিল। পিন্টুর মারপিট সম্বন্ধে কিছুই জানত না সে। রিমা ধরে নিল তার অর্থ মরিয়মও পিন্টুর এই সা¤প্রতিক কেলেংকারির কিছুই জানে না এখনও। নোমান যে পিন্টুকে ধরে বেশ ধোলাই দিয়েছে এটা শুনে খুব খুশী হল কালাম। খুব হাঁ হুতাশ করল নিজে সেই সময়ে উপস্থিত থাকতে পারে নি বলে। থাকলে নির্ঘাত পিন্টুর নিতম্বে খান কয়েক জোরসে লাথি কষে দিত। বেশ কিছুক্ষণ থাকল সে। রিমাকে বাক্স পোটরা খুলতে সাহায্য করল।

সেই দিন সন্ধ্যায় নতুন বাসায় প্রথমবারের মত রান্না করবার উদ্যোগ নিচ্ছিল রিমা, সেই সময় মিলার কাছ থেকে একটা টেক্সট মেসেজ এলো।
একবার আসবে? প্লিজ?

রিমা সাথে সাথেই বুঝল কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। মিলার তো ফিরতে আরোও বেশ কয়েকদিন বাকী থাকার কথা। চুলা বন্ধ করে, বাচ্চাদেরকে নিয়ে সাথে সাথেই গাড়ি চালিয়ে মিলার বাসায় চলে এলো। একা যেতে পারলেই ভালো হত কিন্তু আজ যা হয়েছে তার পর বাচ্চাদেরকে একা বাসায় রেখে আসতে মন মানল না। পিন্টু তখনও ধরা পড়ে নি, ধরা পড়লেও স্বস্তি বোধ করার কিছু ছিল না। সে জামিনে সাথে সাথেই বেরিয়ে আসবে।
ডোর বেল বাজাতেই ঝট করে দরজা খুলে দিল মিলা। তার পরনে স্লিপিং ড্রেস। দেখে মনে হল সারা দিন ধরে কান্না কাটি করেছে। তার চোখ ফোলা, রক্তিম, গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ, চুল উসকো খুসকো। তাকে দেখেই রিমার হার্ট এটাক হবার উপক্রম হল। “মিস মিলা! একি! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ভুমিকম্প হয়েছে। আয়নায় নিজেকে দেখেছ?”
মিলা নীরবে মাথা নাড়ল। না, দেখেনি।
“শুধু মাথা নাড়লে হবে না। কথা বল। প্লিজ! কি হয়েছে?”

“তোমাকে বাসা বদল করতে কোন রকম সাহায্য করতে পারিনি,” মিলা বিড়বিড়িয়ে বলল। “খুব খারাপ লেগেছে।”
“আরে বাসা বদলের কথা রাখো তো। কবে ফিরে এসেছ? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার আরও কয়েকদিন সেখানে থাকার কথা।”
“তিন দিন আগে,” মিলা আবার বিড়বিড়িয়ে বলল।
“তিন দিন আগে? আর আমাকে একবারও খবর দেবার প্রয়োজন মনে করনি?” রিমা ধমক দিল। “কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে দিয়েছ আর প্রিয় বান্ধবীকে একবারও ডাকবার কথা মনে আসেনি?”
মিলা ফিক করে হেসে ফেলল। “কাঁদতে ভালো লেগেছে।”
“কি? কাঁদতে ভালো লেগেছে?”
“হ্যাঁ। এখন অনেক ফুরফুরে লাগছে। একটু ক্লান্ত বোধ করছি। গলাটাও শুকিয়ে আছে। কিন্তু নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছ।”
“চমৎকার!” রিমা তিক্ত গলায় বলল। “এইবার নিজেকে একটু ঠিকঠাক কর, তারপর আমাকে বল কি হয়েছে।”

মিলা মাথা নাড়ল। “কিচ্ছু করতে পারব না তবে কি হয়েছে তোমাকে বলছি। হারামীটা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। ওর বউ আছে! বাচ্চাও আছে। আমাকে তাদের ছবিও দেখিয়েছে। বাচ্চাদের বয়েস ছয় আর চার। দুই ছেলে।”
রিমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। জানত এই প্রেম কাহিণীর পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না। মিলার জন্য খুব খারাপ লাগল। “কবে বলেছে তোমাকে?” জানতে চাইল।
“আমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে ওকে চাপ দিচ্ছিলাম। সেই সময়। ভাব করল যেন কত সত্যবাদী যুধিষ্টির। আমি জিজ্ঞেস করিনি তাই আমাকে বউ বাচ্চার কথা বলেনি। ওর বউ উকিল। সবসময় ব্যাস্ত থাকে। তাই আমার সাথে সম্পর্ক করে তার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল। হারামী! দূর্বল মনের মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পছন্দ করে।”
“তুমি দূর্বল নও!” রিমা প্রতিবাদ করে। “লোকটাকে তুমি ভালো বেসেছিলে। তাতে তোমার কোন অন্যায় ছিল না।”
মিলা আবার কেঁদে ওঠে। “অন্যায় ছিল। ওর বউ বাচ্চা আছে। আমার উচিৎ ছিল জিজ্ঞেস করা।”

“বুঝেছি। তুমি কি একাই ফিরেছ না সেও তোমার সাথে ফিরে এসেছে?”
“একাই এসেছি। ওকে বলিওনি।” মিলা হাতের পেছন দিয়ে চোখ মুছল। “এমন গাধি আমি! সবাই সারাক্ষণ আমার সাথে প্রতারণা করছে।”
আবার হাও মাও করে কান্না শুরু করল মিলা। মিলা ওর পাশে থাকল, কাঁদতে দিল। কেঁদে কেটে মনের ক্ষোভ দূর করুক। ঘন্টা খানেক পর কান্না থামিয়ে মিলা ঘোষণা দিল যা হবার হয়েছে। এইসব পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সে এখন প্রস্তুত। সে গোছল করল, সুন্দর জামা কাপড় পরল, চুল আঁচড়াল, তারপর প্রস্তাব দিল বাইরে কোথাও খেতে যাবার। বাচ্চারা প্রস্তাব শুনে খুশিতে হৈ চৈ করে উঠল। ফায়জাকে বলা হল একটা রেস্টুরেন্ট বেছে নিতে। সে বেছে নিল গুরমে মালেশিয়া। তার সবচেয়ে প্রিয় রেস্টুরেন্ট।
রেস্টুরেন্টে মিলা চেষ্টা করল মুখে সবসময় হাসি ধরে রাখতে কিন্তু রিমা পরষ্কার বুঝতে পারল মনে মনে সে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। খাবার দারুণ হলেও মিলা প্রায় কিছুই খেল না। পরে রিমা তাকে তার নতুন বাড়িতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিল কিন্তু মিলা রাজী হল না। সে তার এপার্টমেন্টে ফিরে যেতে চায়।

রিমা মিলাকে তার এপার্টমেন্টে নামিয়ে দিল। কথা দিল পরদিন দেখতে আসবে। বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ ফায়জা বলে উঠল, “মা, একটা বুদ্ধি এসেছে!”
“কি নিয়ে?” রিমা জানতে চায়।
“মিলা আন্টিকে নিয়ে। নোমান আঙ্কেলের সাথে তার ভাব করিয়ে দিলে কেমন হয়? দুজনাই একাকী, দুজনাই যেমন ভালো তেমনি সহজ সরল। দুজনকে দারুণ মানাবে, তাই না?”
রিমার বুকটা কেঁপে উঠল। নোমানের সাথে ওর সম্পর্কটা যাই হোক ওর কাছে সেটার অনেক মূল্য আছে। এতো দিন পর আবার তাকে নিজের জীবনে ফিরে পেয়েছে ও, তাকে ছেড়ে দিতে ওর মন চায় না, মিলার জন্যও না। মনের গভীরে লোকটার প্রতি এক ধরনের অধিকার বোধ জন্মে গেছে ওর। সময় তাকে কিঞ্চিৎ ম্লান করে দিলেও ক্ষয় করতে পারেনি। এই সম্পর্কটাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা যাবে না।

৬১
প্রায় মাস খানেক হল মার্সেলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই রিমার। পরদিন সকালে সে যখন হঠাৎ তার নতুন বাসায় এসে হাজির হল তখন একটু অবাকই হল ও।
“কি খবর ম্যাডাম!” মার্সেল হাসি মুখে বলে।
“তুমি কি করে জানলে আমি এখানে চলে এসেছি?” রিমা সন্দিহান কন্ঠে জানতে চায়। “তুমি আমার উপর নজর রাখছো নাকি?”

মার্সেল হাসল। “সেটাই তো আমার কাজ! বাড়ীতো খুব সুন্দর হয়েছে। এদিক সেদিক অল্পবিস্তর কাজ করাতে হবে কিন্তু সব মিলিয়ে ভালোই।” সে বাইরের চত্তরে চোখ বোলাল। “আগের মালিক খুব একটা দেখভাল করে নি, বোঝাই যায়। যদি কোন রকম সাহায্য লাগে আমাকে খবর দিও। ওটা আমার শখ।”
মার্সেল ভেতরে ঢোকার আগ্রহ দেখায়নি। রিমাও বুঝতে পারছিল না তাকে ভেতরে আসতে বলবে কিনা। “কাল বিকালে কি হয়েছে শুনেছি,” মাথা নেড়ে জিভ দিয়ে ক্লিক করে একটা শব্দ করল সে। “ঐ লোকটার সমস্যা কি আমি বুঝতে পারছি না। আমি ওকে আগেও সাবধান করে দিয়েছিলাম। তুমি শুনেছ ওকে যে এরেস্ট করা হয়েছিল? জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে অবশ্য।”

“বাঁচা গেছে!” রিমা একটু হলেও স্বস্তিবোধ করে। “কোথায় লুকিয়ে ছিল?”
“রেস্টুরেন্টে। ওখানে ওর অফিসে ঘুমিয়ে ছিল।” মার্সেল হতাশ ভঙ্গীতে বলে। “এইবার অনেক ঝামেলায় পড়বে। তোমরা ঠিক আছো তো?”
“অনেক ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। বুঝিনি ঘটনা এতো দূর গড়াবে।”
“শুনেছি তোমার কোন এক বন্ধু ওকে রুখে দিয়েছিল। সে ঠিক আছে তো?”
“একটু ভড়কে গেছে কিন্তু শারীরিকভাবে ভালো আছে।” রিমা বলল। বাইরে দাড়িয়ে থেকে ওর ঠান্ডা লাগছে। “তুমি কি ভেতরে আসবে?” জানতে চাইল।
“না, না। তোমার ঠান্ডা লাগছে খেয়ালই করিনি,” মার্সেল লজ্জিত কন্ঠে বলে। “এদিকেই এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। বাড়িটাও দেখা হবে। আচ্ছা, যাই তাহলে। পিন্টুকে নিয়ে ভেবো না। ওর সাথে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে ও। কোন সমস্যা হলে আমাকে কল দিও। ঠিক আছে?”

রিমা মাথা দোলাল। মার্সেলের উপর ওর তেমন কোন ভরসা নেই। সেই প্রথম থেকেই বলে চলেছে পিন্টুকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না অথচ পিন্টুর যা ইচ্ছা সে করে চলেছে। পিন্টুর সাথে তার সুদীর্ঘ আলাপের ফলাফল শূণ্য। “সে আমাদেরকে আতংকের মধ্যে রেখেছে। তোমার কিছু করা উচিৎ।”

মার্সেল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “জানি তুমি খুব উদ্বেগের মধ্যে আছো। আমি আমার সাধ্য মত চেষ্টা করছি। সাবধানে থেক। সম্ভব হলে একজন পূর্ণবয়স্ক কাউকে তোমার সাথে থাকতে বল। পিন্টুর বিবাহিত জীবনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে। কখন কি করবে বলা মুষ্কিল।”
“ওকে জেলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা যায় না,” রিমা ঠাট্টাচ্ছলে বলে।
“এইবার তোমার বন্ধুকে আক্রমণ করার জন্য হয়ত জেলের ঘানি টানতে হতে পারে ওকে,” মার্সেল বলল। “পরে দেখা হবে।” হাত নেড়ে গাড়ীতে চেপে চলে গেল সে।
ঠান্ডায় কাঁপছিল রিমা। তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে একটা শাল গায়ে জড়াল। পিন্টু কখন জেলে যাবে না। কিছু না কিছু একটা উপায় ঠিকই বের করে ফেলবে। তাছাড়া, হাজার হোক সে পরিবারে অংশ। রিমাও সত্যি সত্যিই চায় না তাকে জেলে পাঠাতে। মরিয়ম আর মেয়েদের কথাওতো ভাবতে হবে। তারা তো আর কোন অপরাধ করে নি। তাদেরকে এমন একটা অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলার কি প্রয়োজন?

আগের বার আহমেদের বাসায় গিয়ে যেরকম অপমানিত হয়েছিল তার পর আবার তাদের ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে হবে ভাবে নি আবুল। কিন্তু কপালের লিখন খন্ডাবে কিভাবে? পিন্টু এরেস্ট হবার পর লাট্টু ওকে ফোন দেন। আর কোন ক্রিমিনাল উকিলের সাথে তার পরিচয় নেই। তিনি আবুলের সাহায্য চাইলেন পিন্টুর জামিনের ব্যবস্থা করবার জন্য। আবুল মরিয়মের কাছে জানতে চাইল তার কি করা উচিৎ। মরিয়ম বলল তার যা ইচ্ছা সে করতে পারে। আবুল লাট্টুকে কিছুটা পছন্দ করে। খুব যে সৎ মানুষ তা নয় কিন্তু ভদ্রলোকের ব্যবহার ভালো আর মানুষকে সম্মান দেখাতে জানেন। তার বয়েসে পিন্টুর মত একটা উটকো ঝামেলাকে সামাল দেয়া কঠিন ব্যাপার।

লাট্টুর সাথে কোর্টে দেখা করল সে। সরকারি উকিলের সাথে আলাপ করে লাট্টুকে শিওরিটি রেখে পিন্টুর জামিনের ব্যবস্থা করতে পারল। সরকার পক্ষ কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিয়েছে অবশ্য। পিন্টু রিমা কিংবা তার বচ্চাদের সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখতে পারবে না। তার বিচার শেষ হবার আগে শহর ছেড়ে কোথাও যাবে না। সাথে কোন অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করবে না। পিন্টু দ্বিতীয় বারের মত রেস্ট্রেইনিং অর্ডার ভঙ্গ করেছে জানার পর তাকে জামিন দিতেই তার অনীহা ছিল। আবুল তাকে বুঝিয়েছে সাংসারিক সমস্যা এবং মানসিক সমস্যার কারণেই পিন্টু এমন করেছে। ভালো যে শেষ পর্যন্ত সরকার পক্ষকে সে রাজী করাতে পেরেছে।
লাট্টু চেয়েছিলেন আবুল তাদের সাথে বাসায় যাক কিন্তু আবুল একটা অজুহাত বের করে এড়িয়ে যায়। যেটুকু করেছে তার বাইরে আর কোন কিছুর সাথে সে নিজেকে জড়াতে চায় নি। লাট্টুকে তাকে অনুরোধ করেছেন একজন ভালো ক্রিমিনাল উকিল খুঁজে দেবার জন্য। না করতে পারে নি আবুল। মরিয়ম এখনও ঐ গাধাটার স্ত্রী। ওরা চলে যাবার পর সে মরিয়মকে ফোন করে সব জানাল। মরিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন রেখে দিয়েছে। পিন্টুর ব্যাপারে কিছুই বলেনি। বোনের মাথায় কি চলছে ধরতে পারছে না আবুল। পিন্টু সম্বন্ধে প্রায় কখনই কিছু বলে না সে। আবুল চেষ্টা করেছে ঐ বিষয়ে আলাপ করে মরিয়মকে সহজ করতে কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।

নীতা ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তার নজর ছিল হোম মনিটরিং সিস্টেমের উপর। লাট্টু ড্রাইভওয়েতে গাড়ী থামাতেই তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পিন্টু গাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে মাকে আস্তে করে ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। লাট্টু তাদের পিছু পিছু ভেতরে এলেন। লিভিংরুমে তিনজন গোল হয়ে বসলেন।
“কি হল?” নীতা পিন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলেন।
“ট্রায়াল হবে,” লাট্টু গম্ভীর কন্ঠে বললেন। “আবুল অনেক চেষ্টা করেছিল সরকারী উকিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কেসটা উইথড্র করে নিতে কিন্তু লোকটা রাজী হল না। পিন্টু এই নিয়ে দুবার রেস্ট্রেইনিং অর্ডার ভেঙেছে। বলছে পিন্টু রিমার বাড়ীর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। রিমার অতিথিকে আক্রমণ করেছে। কঠিন অপরাধ।”
“আমি ওকে আক্রমণ করিনি,” পিন্টু তিক্ত কন্ঠে বলল। “গরুটাই আমাকে আক্রমণ করেছিল।”

“পুলিশ বলেছে তুমিই নোমানকে আগে আক্রমণ করেছ। ও আত্মরক্ষা করছিল।” লাট্টু নীচু গলায় বললেন। পিন্টুকে অকারণে ক্ষেপিয়ে দিতে চান না।
“শুনেছি অনেক রক্ত পড়েছিল নাকি,” নীতা করুন মুখে বললেন। “নাক ঠিক আছে? ব্যাথা করছে?”
“আমার নাক ঠিক আছে, মা,” পিন্টু সংক্ষেপে বলে। তার ভেতরে ভয়ানক এক ক্রোধ চাগিয়ে উঠছে কিন্তু ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার। ওর ইচ্ছা হচ্ছে এখনই বেরিয়ে গিয়ে ঐ ব্যাটা নোমানকে খুঁজে বের করে ওর মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। সারা জীবনে কারো কাছে এইভাবে হারে নি ও। অপমানে ওর মাথা কাটা যাচ্ছে।

নীতা ওকে মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ছেলের ভেতরের রাগটুকু ধরতে তার অসুবিধা হল না। পিন্টু সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসেছে, নজর মেঝেতে, ঠোঁটজোড়া পরস্পরের সাথে শক্ত করে চেপে রাখা। তার ভয় হয় এই ছেলে কোন একটা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে তারপর পস্তাবে। তিনি লাট্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে? ওর একটা ফুল চেক আপ করা দরকার। নাকটাতো অনেক ফুলে আছে।”
লাট্টু ঘাড় নাড়লেন। “বলেছিলাম। কিন্তু বাসায় আসতে চাইল।”
“তাই! বাবা, ক্ষিধা লেগেছে? আমি তোর জন্য রান্না করেছি। তোর প্রিয় চিকেন বিরিয়ানী। দেব এখন?”

পিন্টু একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মায়ের উপর রাগ না ঝাড়তে। এই পৃথিবীতে ছোট ছেলেকেই তিনি সবচেয়ে ভালোবাসেন। “এখন ক্ষিধা নেই মা। আমার গোছল করতে হবে। মাথাটা ধরে আছে।”
“ঠিক আছে। যখন ক্ষিধা লাগে আমাকে বলিস,” নীতা নরম গলায় বললেন। পিন্টু উঠে চলে যাবার উপক্রম করতে তার একটা হাত আলতো করে ধরলেন। “বাবা, বেশী মাথা গরম করিস না। উল্টোপাল্টা কিছু করিস না। আমি রিমার সাথে কথা বলব। হয়ত কেসটা তুলে নেয়া যাবে।”

পিন্টু হাত ছাড়ীয়ে নিল। “গোল্লায় যাক সে!” লিভিংরুম থেকে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল।
নীতা এবং লাট্টু পরস্পরের দিকে তাকালেন। দুজনের মুখেই দুশ্চিন্তা। শুনলেন পিন্টু ধড়াম করে তার ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল।