রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

চুয়াল্লিশ.
একাদশ অধ্যায়
স্টার ওয়ারস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) স্টিভ এবং তার স্ত্রী লরেন ২০১১ সালের গ্রীষ্মে উইলো এবং আমার সাথে ডিনার করতে লস অ্যাঞ্জেলেসে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন তিনি মারাত্মকভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছেন, চোখেমুখে গভীর ব্যাথা-বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। জীবনী শক্তি খুব সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে। কন্ঠস্বর বদলে গেছে, কথা বললে কেমন যেন একটা অপরিচিত কর্কশ শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি আমাদের সাথে একটা সন্ধ্যা কাটাতে চান। আমরা কয়েক বছর আগে যা করেছি আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং পরাস্পরের সাফল্য কামনা করার জন্য মিলিত হওয়া। আমরা আমাদের ডাইনিং রুমে বসলাম এবং ওয়াইন দিয়ে শুরু হল আমাদের রাতের খাবার। ওয়াইনের গ্লাস উচিয়ে ধরে স্টিভ বললেন, ‘দেখুন আমরা কি করলাম। আমরা দুটি কোম্পানিকে বাঁচিয়ে দিলাম।’

আমরা চারজনই কেঁদে ফেললাম। সবচেয়ে উষ্ণতম আন্তরিক সময়ে স্টিভের অভিব্যাক্তি এমনই ছিল। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পিক্সার ডিজনির অংশ না হয়ে ওঠলে এমনভাবে কখোনই বিকাশিত হতে পারত না আবার ডিজনি পিক্সার অধিগ্রহণ করে নিজেদের উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছে। আমার করার কিছুই ছিল না তবে স্টিভের সাথে প্রথম দিকের কথোপকথনে আমি কতটা নার্ভাস ছিলাম সে বিষয়টি মনে পড়ে গেল। মাত্র ছয় বছর আগের কথা, কিন্তু মনে হচ্ছে সে এক অন্য জীবন। এরই মধ্যে পেশাগতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। আমরা মদ্য পানে বেশ মত্য হয়ে গেছিলাম, উইলোর বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেছিলাম। সে আমার চেয়ে অনেক আগে থেকেই স্টিভকে চিনত। ১৯৮২ সাল, তিনি তখন একজন উজ্জ্বল, দুর্বিনীত, মেধাবী তরুণ। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা। তার জীবনের শেষ মাসগুলিতে তিনি অসহায় এবং দুর্বল। উইলো তাকে এ অবস্থায় দেখে কতটা কষ্ট পেয়েছে তা আমি সহজেই অনুমান করতে পারি।

২০১১ সালের ৫ অক্টোবর তার জীবন অবসান হয়। পালো অল্টোতে তাকে সমাধিস্থ করার জন্য প্রায় পঁচিশজন উপস্থিত ছিলেন। আমরা তার কফিনের চারপাশের বর্গক্ষেত্রে বেশ আঁটসাট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লরেন জিজ্ঞেস করলেন কেউ কি কোন কিছু বলতে চান। আমি কথা বলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না কিন্তু পিক্সারের ক্যাম্পাসে সেই হাঁটার স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল।

আমি আমাদের সাধারণ পরামর্শক অ্যালান ব্রাভারম্যান ছাড়া অন্য কাউকে বলিনি আর আমার স্ত্রী উইলোর সাথে শেয়ার করেছিলাম সেদিনের সেই গভীর আবেগময় তীব্র ব্যাথার কথা। আসলে মুহূর্তটি স্টিভের চরিত্রকে ধারণ করে। তাই আমি কবরস্থানে সবার সামনে মুহূর্তটি স্মরণ করলাম। স্টিভ আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন। ক্যাম্পাস জুড়ে আমার সাথে হাঁটাহাটি করলেন। আমার চারপাশে তার হাত রেখে দুঃসংবাদটি পরিবেশন করলেন। তার উদ্বেগ আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তটি যেন অটুট থাকে। একটা ভয়ানক দুঃসংবাদ তিনি আমাকে বললেন। এটি আমাকে এবং ডিজনিকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি নিজের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ থাকতে চেয়েছিলেন। আবেগের সাথে তিনি নিজের ছেলের কথা উচ্চারণ করেছিলেন এবং ছেলের জন্য নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ছেলের স্নাতক পাশ দেখতে চেয়েছিলেন এবং ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে তার জীবন শুরু করা পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলেন।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে লরেন আমার কাছে এসে বললেন, ‘আমিও সেই গল্পের আমার দিকটা কখনোই কাউকে বলিনি।’ লরেন সেদিন স্টিভের বাড়ি ফেরার কথা বলা শুরু করলেন। ‘আমরা একসাথে রাতের খাবার খেলাম। তারপর বাচ্চারা ডিনার টেবিল ছেড়ে চলে গেল। আমি স্টিভকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি তাকে বলতে পেরেছ?’ উ্রত্তরে সে বলল, ‘হ্যা, আমি তাকে বলেছি।’ আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কি তাকে বিশ্বাস করতে পারি? তিনি মাত্র তার স্বামীকে কবরে শায়িত করেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আমাকে একটা উপহার দিলেন যা আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। আমি প্রতিদিন নিশ্চিৎভাবে স্টিভের কথা চিন্তা করতাম। লরেন বলা শুরু করলেন ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি?’ স্টিভ বললেন, ‘আমি লোকটিকে ভালোবাসি।’ আমাদের পারস্পরিক অনুভূতি এমনই ছিল।
যখন আমি স্টিভের সাথে মার্ভেল অধিগ্রহণ সম্পর্কে কথা বলতে কুপারটিনোতে গেছিলাম তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমি অন্য কিছু অধিগ্রহণের কথা ভাবছি কিনা। আমি লুকাসফিল্মের কথা উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন, ‘আপনি শুধু জর্জকে ফোন করুন।’জর্জ লুকাসের কাছ থেকে স্টিভ পিক্সার কিনেছিলেন। তারপর থেকে তিনি এবং জর্জ বছরের পর বছর ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি বললেন ‘আপনি কল্পনাও করতে পারেন না, জর্জ হয়তো লুকাসফিল্ম বিক্রি করতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। আমাদের দুজনের উচিত একদিন তার খামারে যাওয়া এবং তার সাথে দুপুরের খাবার খাওয়া।’

আমরা কখনও আর সেই দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা করার সুযোগ পাইনি। স্টিভ খুব আল্প সময়ের মধ্যে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডিজনি কোম্পানিতে তার যাতায়াত কমে গেল। কিন্তু লুকাসফিল্ম প্রথম থেকেই আমাদের অধিগ্রহণের তালিকার শীর্ষে ছিল। আমরা মার্ভেল চুক্তি সম্পন্ন করেছি এবং আমি ভাবছিলাম কীভাবে জর্জের সাথে কথা বললে তিনি আহত হবেন না। কারণ তার নিজের হাতে গড়া বিস্ময়কর পৃথিবী আমাদের কাছে বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়ে তাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইনি।

৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাইকেল আইজনারের সাথে জর্জ আমাদের পার্কে স্টার ওয়ার্স আর ইন্ডিয়ানা জোন্স থিমযুক্ত আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য লাইসেন্সিং চুক্তি করেছিলেন। বছরব্যাপী সংস্কার কার্যক্রমের পর ২০১১ সালের মে মাসে আমরা ডিজনি ওয়ার্ল্ড এবং ডিজনিল্যান্ডে স্টার ওয়ার্সের আকর্ষণগুলি পুনরায় চালু করলাম (এগুলোকে স্টার ট্যুর বলা হয়)। আমি জানতাম জর্জ অরল্যান্ডো যাচ্ছেন সেখানকার আকর্ষণ কেন্দ্রটি পুনরায় উদ্বোধন করার জন্য। এতে করে কোম্পানিরও লাভ হবে এবং ইমেজিনিয়ারিংএ তার বন্ধুদের সাথেও সাক্ষাৎ হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও তার সাথে উৎসবে যোগ দিবো। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমি সাধারণত পার্কের নতুন কোন আকর্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধনের ভার পার্ক এন্ড রিসোর্টের প্রধান নির্বাহীর হাতে ছেড়ে দিতাম। ভাবলাম জর্জের সামনে ধারণাটি উন্থাপনের একটা বড় সুযোগ এবং তিনি কখনো আমাদের কাছে লুকাসফিল্ম বিক্রি করার কথা বিবেচনা করবেন কিনা সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবো।

আমাদের সম্পর্ক এবিসি এন্টারটেইনমেন্টের পুরোন দিনগুলো ফিরে দেখার সুযোগ করে দিল। টুইন পিকসের সাফল্যের পর হলিউডের সবচেয়ে সম্মানিত পরিচালকদের কেউ কেউ আমাদের সাথে টেলিভিশন সিরিজ বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। জর্জের সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিল। তিনি একটা টেলিভিশন শো নির্মাণের জন্য একটা ধারণা দিয়েছিলেন। একজন তরুণ, তার নাম ইন্ডিয়ানা জোনস, তার বিশ্ব ভ্রমনের কহিনী অবলম্বনে তৈরি হবে টেলিভিশন শো। জর্জ বলেছিলেন, ‘টিভি শোয়ের প্রতিটি পর্ব হবে ইতিহাসের অংশ বা ইতিহাসের পাঠ বিশ্লেষণ।’ইন্ডি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের সাথে মতবিনিময় করবেন। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব চার্চিল এবং ফ্রয়েড এবং দেগাস এবং মাতা হরিদের সাথে কথা বলবেন। আমি তাকে খুব দ্রæত হ্যাঁ বলেছিলাম। ১৯৯২ সালে আমরা দ্য ইয়াং ইন্ডিয়ানা জোনস ইতিহাস ভিত্তিক টিভি শোটি সোমবার রাতে ফুটবল খেলা স¤প্রপ্রচারের আগে প্রচার করি। বড় সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা নিয়ে শোটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দর্শক-শ্রোতারা ঐতিহাসিক পাঠের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং টিভি শো স্কোর-রেট অনেক নিচে নেমে যায়। জর্জ যা বলেছিল তার সবকিছুই ঠিকঠাক ভাবে করেছিলেন। এটি সবার জানা তার কথা আর কাজে গড়মিল হয় না। এই জন্যই তিনি জর্জ লুকাস। টিভি শোটির দ্বিতীয় মৌসুম প্রাপ্য ছিল। দর্শকদের কাছে টানার আরেকটি সুযোগ নেয়া যেতে পারতো। তা আর কখনও হয়ে উঠেনি। জর্জকে সেই সুযোগ দেয়ার জন্য আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।
অরল্যান্ডোতে স্টার ট্যুর পুনরায় শুভ উদ্বোধন করার দিনে আমাদের হলিউড স্টুডিও পার্কে আকর্ষণ কেন্দ্রের কাছাকাছি ব্রাউন ডার্বিতে তার সাথে একটা ব্রেকফাস্টের ব্যাবস্থা করলাম। রেস্তোরাঁটি সাধারণত লাঞ্চের আগে খোলে না, কিন্তু আমি শুধু আমাদের জন্য একটি টেবিলের ব্যাবস্থা করার জন্য তাদের অনুরোধ করলাম, এতে করে আমরা একান্তে কথা বলার সুযোগ পাবো। যখন জর্জ এবং তার বাগদত্তা মেলোডি হবসন আসলেন তখন সেখানে দেখলেন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তারা অবাক হলেন । আমরা বসলাম এবং আমাদের সামনে মনোরম খাবার দাবারে পরিপূর্ণ ছিল। নাস্তার মাঝ পথে জর্জকে বিরক্ত না করে পরিষ্কারভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম তিনি কখনও লুকাস ফিল্ম বিক্রির কথা ভেবেছেন কিনা। সরাসরি আমাদের কাছে বিক্রি করার প্রস্তাব না করেও বিষয়টি তার কাছে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। তখন তার বয়স আটষট্টি। আমি বললাম, ‘জর্জ, আমি নিয়তিবাদী নয় এবং আপনি যদি এ বিষয়ে আলাপ না করতে চান তবে দয়া করে আমাকে থামিয়ে দিন। আমরা এই বিষয়ে কথা বলবো না, কিন্তু আমি মনে করি বিষয়টি আপনার দৃষ্টিগোচরে আনা মূল্যবান। চলতি পথে কখন কি হয় কেউ জানে না। আপনার কোন উত্তরাধিকারী নেই যারা কোম্পানিটি পরিচালনা করবেন। এখন যারা আছেন তারা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন কিন্তু তারা এটি পরিচালনার দ্বায়িত্ব নেবেন না। আপনার কোম্পানির গুরুভার কে বহণ করবে বা কে রক্ষণাবেক্ষণের দ্বায়িত্ব পালন করবে তা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরী। আপনার কি মনে হয়?’ (চলবে)
কোরবান আলী: অন্বুাদক, টরন্টো, কানাডা