শুজা রশীদ : (পর্ব ৪১)
৫৯
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ক্রিসমাস এবং বছর শেষের কেনাকাটা পুরো দমে চলছে। স্কুল মাত্র বন্ধ হয়েছে। চারদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব।
রিমার বাসা বদলের দিনটা বেশ ঠাণ্ডা যদিও সূর্য উঠেছে ডিসেম্বর মাসে আবহাওয়া সাধারণত এমনই থাকে। ভিনয় তার দুই ছেলে, যন্ত্রপাতি এবং দড়ি-দাড়া নিয়ে বেশ সকাল সকালই চলে এলো। আগের রাতে কালাম এসেছিল খোঁজ খবর নিতে। তার সাহায্য নিয়ে রিমা সবকিছু মোটামুটিভাবে গুছিয়ে ফেলতে পেরেছে। কালামের সকালে ঢাকা গ্রোসারীতে কাজ আছে। চেয়েছিল আজ কাজে না গিয়ে মুভারদেরকে সাহায্য করবে। রিমা সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে কাজের পর নতুন বাসায় চলে আসতে। বাক্স পোটরা খোলার জন্যও সাহায্য দরকার। কালাম তার কথা মেনে নিয়েছে।
মুভাররা এপার্টমেন্ট থেকে জিনিষপত্র সরাতে শুরু করতে বেশ কিছু কৌতূহলী প্রতিবেশীরা এলো খোঁজ নিতে। রিমা তাদের কাউকেই ওর বাড়ী কেনার ব্যাপারটা বলে নি ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা সবাই খুব বিস্মিত হয়েছে। রিমা যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাদের কৌতূহল মেটাতে। এক পর্যায়ে বড়রা ফিরে গেল তাদের বাসায় কিন্তু বাচ্চারা আশে পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। মুভারদের জিনিষপত্র বয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা তাদের কাছে বেশ আনন্দের মনে হচ্ছে।
ভিনয়ের ট্রাকে মালপত্র তোলা শেষ হতে রিমা বাচ্চাদের নিয়ে নিজের গাড়ীতে চাপল, ট্রাকের পিছু পিছু নতুন বাড়িতে এলো। নোমান ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বলেছিল আসবে। রিমা তাকে দেখে অবাক হয় নি কিন্তু মনে মনে বেশ একটা অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করেছে এই ভেবে যে আজ এতো বছর পরেও এই মানুষটার উপর তার এতোখানি প্রভাব অটুট আছে।
ভিনয় তার সুনাম বজায় রাখল। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সে এবং তার ছেলেরা ট্রাক থেকে সব জিনিষপত্র নামিয়ে যথাযথ স্থানে বয়ে নিয়ে গেল। তার ছেলেরা বিছানাগুলো লাগিয়ে দিতেও সাহায্য করল। মাত্র ঘন্টা চারেকের মধ্যেই সে রিমাকে তার নতুন বাসায় স্থানান্তরিত করে টাকা নিয়ে বিদায় হল।
তারা চলে যাবার পর বাসার মধ্যে কয়েক মুহুর্তের জন্য নীরবতা বিরাজ করল। সেই নীরবতা ভাঙল দুই ছেলের হুড়াহুড়িতে। হঠাৎ সারা বাড়িময় ছুটাছুটি করতে শুরু করল তারা। রিমা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চারদিকে নজর বোলাল। তার দৃষ্টি এক পর্যায়ে নিবদ্ধ হল নোমানের উপর। হাসছে লোকটা। “খুশী?” নোমান বলল।
রিমা হাসিমুখে মাথা দোলায়। হ্যাঁ।
“এইবার আমি আমার নিজের একটা কামরা পাবো,” ফায়জা হঠাৎ আনন্দের আতিশয্যে বলে ওঠে। “ঐ দুই বদমায়েশের হাত থেকে বাঁচা গেল!”
রিমা হেসে ওঠে। “দুই বদমায়েশও নিজেদের কামরা পাবে।”
“আমি কিন্তু বড় কামরাটা নেব,” ফায়জা ঘোষণা দিল।
“তথাস্তু!” রিমা বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে বলে।
দুই ছেলের কামরার আকার আকৃতি নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাদের নিজস্ব একটা কামরা পাবার আনন্দেই তারা বিভোর।
ওদের আনন্দ দেখে নোমান না হেসে পারল না। তারপর রিমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার জিনিষপত্র সব কি নিয়ে আসা হয়েছে নাকি এখনও এপার্টমেন্টে কিছু রয়ে গেছে?”
“না, কিছু নেই,” রিমা বলে। “শুধু চাবিটা ফেরত দিতে হবে। পরে এক সময় গিয়ে দিয়ে আসব।”
“বাচ্চাদের নিশ্চয় ক্ষিধা লেগেছে,” নোমান বলল। “আমি গিয়ে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আসি। ফায়জা, কি খেতে চাও?”
“জানি না। কিছু একটা হলেই হয়।” ফায়জা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। সে এখন নিজের কামরাটাকে কিভাবে সাজাবে সেই ভাবনাতেই মত্ত, খাবার-দাবার নিয়ে তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই।
জিব্রান এবং রবিন পিজজা বলতে অজ্ঞান। তারা সরবে তাদের অভিমত জানিয়ে দিল।
রিমা হাসল। “পিজজাই হোক তাহলে।”
“যাবো আর আসব।” নোমান দরজার দিকে রওনা দিল।
“ডেলিভারি নিলে কেমন হয়?” রিমা বলল।
“সশরীরে গেলে ভালো ডীল পাওয়া যায়,” নোমান হেসে বলল। বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল। ওদের চারজনকে কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের মত করে সময়টাকে উপভোগ করতে দিতে চায় সে। ফায়জাকে দেখে মনে হয়েছে সে একটু চুপচাপ। নোমান বুঝতে পারে নি তার উপস্থিতি সেই জন্য দায়ী কিনা।
নোমান চলে যাবার পর রিমা বাসার তাপমাত্রাটা বাড়িয়ে দিল। থার্মোস্ট্যাট ৭০ ডিগ্রীতে ছিল, সেটাকে বাড়িয়ে ৭৫ করে দিল। এপার্টমেন্টে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হত কেন্দ্রীয়ভাবে। প্রায়ই খুব গরম হয়ে থাকত। সেই উষ্ণতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওরা।
নোমান আধ ঘন্টা পরে ফিরে এলো দুই খানা বিশাল পিজজা আর এক বাক্স ভর্তি বারবিকিউ চিকেন নিয়ে। স্থানীয় আফগানী দোকান থেকে আনা। হালাল। রিমা কতখানি মানে জানত না। ঝুঁকি নিতে চায় নি। পিজজার গন্ধে বাতাস মুহুর্তে মৌ মৌ করে উঠল। টেবিলের চারদিক ঘিরে বসে ওরা সবাই মাত্র খেতে বসেছিল ঠিক সেই সময় একটা গাড়ী উৎকট শব্দ করে ওদের বাসার ড্রাইভওয়েতে এসে আচমকা ব্রেক কষে থামল।
নোমান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে গেল। রিমাও তার পিছু পিছু এলো। নোমানকে বলল দরজা না খুলতে। জানালার সামনে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল। মনে মনে একটা কিছু সন্দেহ করছিল। বাসার সামনে পরিচিত পর্শাটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝল তার ধারণাই সত্য। নোমান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “সমস্যা!” সে নীচু গলায় বলল।
রিমা হতাশায় মাথা নাড়ল। “কবে যে ও আমার পিছু ছাড়বে?”
“কে মা?” ফায়জা টেবিল থেকে জানতে চাইল।
রিমা তাকে চুপ থাকতে ঈশারা করে নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে বলল, “পিন্টু।” ও আশা করছিল ওরা যদি সবাই চুপচাপ থাকে তাহলে পিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বিদায় হবে।
কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণিত করল পিন্টু। গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলো সে, হেঁটে উঠোনে চলে এলো। রিমা নোমানকে টান দিয়ে জানালার সামনে থেকে সরিয়ে আনল। চায় না পিন্টু ওদেরকে দেখুক।
দরজায় জোরে জোরে করাঘাত পড়ল। কেঁপে উঠল ফায়জা। দুই ছেলে মহা আনন্দে পিজজা খাচ্ছিল, তারাও খাওয়া থামিয়ে বড় বড় চোখ করে দরজার দিকে তাকাল। ফায়জা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। “মা!”
রিমা হাত নাড়িয়ে ওকে নিশ্চিত করতে চাইল।
আরেক প্রস্থ সজোর করাঘাত পড়ল দরজায়। তারপর শোনা গেল পিন্টুর চীৎকার। “দরজা খোল!” তার কন্ঠ শুনেই বোঝা গেল সে ভয়ানক ক্ষেপে আছে।
“পুলিশে কল কর, মা!” ফায়জা ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠে বলে।
রিমা একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল, নোমানের দিকে একবার দৃকপাত করে দরজার সামনে হেঁটে গেল। “পিন্টু! তুমি কি মাতাল হয়ে এসেছ?” গলা চড়িয়ে বলে ও।
“না! আমি মাতাল হয়ে আসিনি!” পিন্টু চীৎকার করে ওঠে। “দরজা খুলছ না কেন তুমি?”
“তোমার তো এখানে আসার কথা না। এখনই চলে যাও। আমি পুলিশে খবর দেব না।” রিমা চেষ্টা করে তার কন্ঠস্বর যতখানি সম্ভব স্থির এবং দৃঢ় রাখতে। ভয় দেখানোর অর্থই হচ্ছে পিন্টুকে উৎসাহিত করা।
“পুলিশের থোড়াই কেয়ার করি আমি!” পিন্টু গলা ফাটিয়ে চীৎকার করছে। “আমার আর হারানোর কিছু নেই। মরিয়ম আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। দুই মেয়েকেও নিয়ে গেছে। তোমাকে আমি দেখে নেব। আর ঐ শালা নোমানকেও আমি দেখে নেব। ও এইখানে কি করছে? আমার ভাই মরে গেছে ছয় মাস হয় নি এর মধ্যেই নতুন নাগর জুটিয়ে ফেলেছ? শালী খুনী! খোল এই শালার দরজা!”
“পিন্টু, বুঝে শুনে কথা বল,” নোমান সতর্ক করে।
“না বললে কি হবে?” পিন্টু গর্জে ওঠে। “বাইরে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়া শালা। বিল্লি কোথাকার!”
নোমানের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। রিমার দিকে তাকাল। রিমা মাথা নাড়ল। “যেও না!” ফিসফিসিয়ে বলল। “মাতাল হয়ে আছে। আমি বরং পুলিশকেই ডাকি।”
পিন্টু আবার দরজা ধাককাচ্ছে। এবার আরোও জোরে। “বের হয়ে আয় হারামী! নাহলে এই দরজা কিন্তু আমি ভেঙে ফেলব।” দরজায় এবার ভয়াবহ জোরে একটা লাথি মারল সে। থর থর করে কেঁপে উঠল দরজাটা।
নোমান মনস্থির করে ফেলল। “ঠিক আছে, তুমি পুলিশ ডাকো। আমি বাইরে গিয়ে ওকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করি। বাচ্চাদেরকে আতঙ্কিত করে ফেলছে।”
রিমা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ফায়জা হলওয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখ রক্তশূন্য। জিব্রান এবং রবিন বোনের শরীর ঘেষে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে মুখে ভয়। “তুমি পারবে ওকে ঠেকাতে?” নোমানকে জিজ্ঞেস করল।
নোমান মাথা দোলাল। “আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি। আমি বাইরে যাবার পর দরজায় তালা লাগিয়ে দিও।”
“যদি পিস্তল নিয়ে এসে থাকে?” রিমা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠে বলল। “শুনেছি ওর নাকি বেশ কয়েকটা আছে।”
“ও আমাদেরকে স্রেফ একটু ভয় পাওয়াতে চায়। আমার কোন ক্ষতি করবে না।” নোমান তালা খুলে দরজাটা সামান্য ফাঁক করে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে পেছনে দরজাটা ঝট করে লাগিয়ে দিল।
তাকে কথা বলার কোন সুযোগই দেয় না পিন্টু, দেখামাত্র দুই হাতে ঘুষি ছুড়তে ছুড়তে আক্রমণ করে। নোমান মনে মনে এই রকমই কিছু একটা আশংকা করেছিল। সে প্রস্তুত হয়েই ছিল। লাফিয়ে এক দিকে সরে গিয়ে আক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হল।
নোমানকে কোন অবস্থাতেই মার খেতে দিতে রাজী নয় রিমা। সে ফায়জাকে পুলিশে ফোন করতে বলে বাইরের উঠোনে বেরিয়ে এলো। দেখল নোমান দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরটাকে সামান্যা ন্যুব্জ করে রেখেছে, দুই হাত শরীরে সামনে রেখে পিন্টুর এলোপাথাড়ি ঘুষি থেকে নিজেকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করছে।
নিজের মধ্যে আচমকা একটা অস্ম্ভব ক্রোধ অনুভব করে রিমা। পিন্টু এবার সীমা অতিক্রম করে গেছে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে চীৎকার করে উঠে পিন্টুর দিকে ছুটে যায় ও, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় তাকে। মুহুর্তের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও পিন্টু দ্রæত নিজের পায়ে আবার দাঁড়িয়ে যায়, তারপর এগিয়ে এসে রিমাকে সজোরে ধাক্কা মারে। ছিটকে পেছনে পড়ে যায় রিমা, দেয়ালে মাথা ঠুকে যায়। আর্তকন্ঠে চীৎকার দিয়ে উঠে হাত দিয়ে নিজের মাথা স্পর্শ করে রিমা। রক্তের ছোঁয়া পেল না। কাটে নি।
পিন্টু খিস্তি করতে করতে রিমার দিকে এগিয়ে গেলো।
নোমান বুঝল তাকে কিছু একটা করতে হবে। দশ পনের মিনিটের মধ্যে পুলিশের আসার কোন সম্ভাবনা নেই। ওর নড়াচড়া দেখে পিন্টুর দৃষ্টি রিমার উপর থেকে ওর উপর সরে আসতেই নোমান ঝাঁপিয়ে পড়ল পিন্টুর উপর, কংক্রিটের মেঝের উপর পড়ল দুজন। ধপাস করে পড়ে গিয়ে একটু হকচকিয়ে গেল পিন্টু, জোরে জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করল। শেষ কবে মারপিট করেছে নোমানের মনে পড়ে না। শারীরিক সংঘর্ষে সে কখন যায় না। মারপিট করবার অভ্যাস তার একেবারেই নেই। তার হৃৎপিণ্ড পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে, শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্রæত, মাথাটাকে শূণ্য মনে হচ্ছে। পিন্টুর শরীরের উপর নিজের শরীরের সমস্ত ওজন চাপিয়ে শুয়ে থাকল ও। ওর নীচে চীৎ হয়ে শুয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করছে পিন্টু, গালাগালির তুবড়ি ছুটছে তার মুখ দিয়ে, ঘুষি মারবার চেষ্টা করছে। সৌভাগ্যবশত লাগাতে পারছে না। এরপর তার কি করা উচিৎ নোমান বুঝতে পারছে না। কিন্তু জানে পিন্টুকে এভাবে খুব বেশীক্ষণ আটকে রাখা যাবে না। পিন্টু শারীরিকভাবে ওর চেয়ে বড়, শক্তিও বেশী। খুব দ্রæত অন্য একটা উপায় বের করা দরকার।
ফায়জা ফোনে পুলিশ ডিসপ্যাচারের সাথে কথা বলছিল। শুনল বাইরের উঠোনে মা আর্তচীৎকার দিয়ে উঠল। বাইরে ছুটে এসে রিমাকে ধরে তুলল। “মা, ঠিক আছো তুমি? পুলিশ আসছে!”
নোমান পুলিশের সাইরেন শুনতে পাচ্ছে না। আল্লাই মালুম তাদের এখানে এসে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে। তার শরীরের নীচে সরিসৃপের মত নড়াচড়া করছে পিন্টু, উর্ধাংগ সে প্রায় উন্মুক্ত করে এনেছে। চীৎকার চেচামেচিতে আশে পাশের কয়েকজন প্রতিবেশীরা বেরিয়ে এসেছে। “একটু সাহায্য কর, প্লিজ!” নোমান আবেদন করে।
“পুলিশে খবর দিয়েছ তোমারা?” একজন লোক জানতে চায়।
“আমি দিয়েছি,” ফায়জা বলে, তার কন্ঠ কেঁপে ওঠে। “তারা আসছে।”
নোমান বুঝল পরিস্থিতি না বুঝে কেউ তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে আসবে না। উপায় না দেখে সে চেষ্টা করল নিজের শরীরটাকে সরিয়ে পিন্টুর শরীরের উপর আরোও চাপিয়ে বসতে। ওর মাথা দিয়ে আটকে রাখল পিন্টুর মুখ। চারদিকে রক্তের ছাড়াছড়ি। কার রক্ত বুঝতে পারছে না সে। পিন্টু হঠাৎই একটু স্থির হয়ে আসে। “সরে যা শালা বান্দর!” চীৎকার করে বলে পিন্টু। “আমার নাকটা ভেঙেছিস হারামী!”
নোমান এক লাফ দিয়ে পিন্টুর শরীরের উপর থেকে সরে যায়, পিছিয়ে তার নাগালের বাইরে চলে যায়। এইবার দেখতে পায় পিন্টুর নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। “যাহ্, আমি তোমার নাক ভেঙে ফেলেছি!” হতবিহবল কন্ঠে বলে সে, তারপর দ্রæত হাতে পরনের টি শার্টটা খুলে ফেলে পিন্টুর দিকে ছুড়ে দেয়। “এটা দিয়ে নাকটা ভালো করে আটকাও। রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“শালা হারামী!” পিন্টু গর্জে উঠলেও শার্টটা নিল, পাকিয়ে গোল্লা করে নাকে চেপে ধরল। তারপর লক্ষ্য করল ফায়জা ওর দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। “ফায়জা, কয়েকটা বরফ নিয়ে এসো, প্লিজ!” সে কাকুতি করল। “আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি। তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি।”
ফায়জা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। “আমরা মাত্র আজই এখানে এসেছি। কোন বরফ নেই বাসায়।”
“দাঁড়াও, আমি বরফের ব্যবস্থা করছি,” প্রতিবেশীদের একজন বলল। তার স্ত্রী নিকটেই দাঁড়িয়ে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। “ওর নাক ভেঙে গেছে। বরফ নিয়ে এসো।“ স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল সে। মহিলা দ্রুত বাসার ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই একটা অল্প বয়স্ক ছেলে এক দৌড়ে এসে এক গামলা বরফ দিয়ে গেল। পিন্টু কয়েকটা বরফের টুকরা রক্তাক্ত জামার মধ্যে পেঁচিয়ে আবার নাকে চেপে ধরল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নোমানকে লক্ষ্য করে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলল, হেঁটে নিজের গাড়ীর কাছে গিয়ে আছড়ে পিছড়ে কোন রকমে ভেতরে ঢুকল, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ী পিছিয়ে রাস্তায় নামাল, চালিয়ে চলে গেল। এইবার পুলিশের গাড়ীর সাইরেন শোনা গেল। বেশ দ্রæতই চলে এসেছে তারা। পাঁচ মিনিটও হয় নি কল করা হয়েছিল। ঠান্ডার মধ্যে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল নোমান। রিমা তাকে টান দিয়ে বাসার মধ্যে নিয়ে এলো। “তাড়াতাড়ি জ্যাকেটটা পরে নাও। হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে।”
নোমান কথামত জ্যাকেটটা পরে সোফায় গিয়ে বসল, শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে, হাতে হাত ঘষে অবশ হাতে অনুভূতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকে। পুলিশ এসে পৌছানোর অপেক্ষা করছে ওরা। পিন্টুর নাক ভাঙার জন্য ওকে কি শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হবে? মনে মনে বেশ দুঃশ্চিন্তাতেই পড়ে গেছে নোমান।