শুজা রশীদ : (পর্ব ৩৯)
৫৬
ফোনটা বাজছে। ঘুমাতে যাবার আগে রিঙ্গারের শব্দটা একেবারে কমিয়ে দিয়েছিল মরিয়ম। দুই মেয়ের ঘুম খুব পাতলা, বিশেষ করে হ্যাপির। কলার আইডি দেখল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। রাত দেড়টার সময় পিন্টু সাহেবের ফোন করার সময় হয়েছে! ভাবল ধরবে না। গত দুই সপ্তাহে একবারও ধরে নি। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টাল। শোনাই যাক না তার কি বলার আছে। লিভিংরুমে গিয়ে কলটা নিল।
“কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে?” ও নীচুস্বরে বলল।
“ফোন ধরছ না কেন?” পিন্টু অন্য প্রান্ত থেকে রাগী গলায় বলে ওঠে।
“ফোন করেছ কেন?” মরিয়ম মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করে।

“বাসায় চলে আসো। বাচ্চাদেরকে মিস করছি।” পিন্টুর কন্ঠে কাঠিন্য। মনে হল না সে আদতেই কারো অভাব বোধ করছে।
“তাই নাকি!” মরিয়ম চেষ্টা করেও কন্ঠ থেকে বিদ্রূপের ইঙ্গিতটা পুরোপুরি এড়াতে পারে না।
“তুমি কেন খামাখা আমাকে শাস্তি দেবার চেষ্টা করছ? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?” তার কন্ঠস্বর চড়ছে।
“কি করেছ সেটা বোঝার ক্ষমতাও তোমার নেই?” মরিয়ম হতাশ কন্ঠে বলে। “আমাকে আর কল কর না।”
“ফোন রেখে দিও না!” পিন্টু ধমকে উঠল। “রাখলে আমি কিন্তু তোমার ওখানেই চলে আসব।”
“যা ইচ্ছা তাই কর। আর কিছু বলবে? আমার অনেক ঘুম পেয়েছে।”
পিন্টু বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকল। মরিয়মের এই রূপ সে আগে কখন দেখেনি। এই মরিয়মকে সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
“তুমি এতো খারাপ ব্যবহার করছ কেন?” অবশেষে বলল।

“আমি খারাপ ব্যবহার করছি?” মরিয়ম এবার সত্যি সত্যিই রেগে যায়। এই লোকটা তাকে একেবারে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে দিচ্ছে।
“তুমি আমার মেয়ে দুইটাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছ,” পিন্টু গলা চড়িয়ে বলল।
“তোমার এটা করার কোন অধিকার নেই।”
“ওদেরকে দেখে তো মনে হয় না ওরা তোমাকে একেবারেই মিস করছে,” কথাটা বলে ফেলে মরিয়মের নিজেকে একটু ক্ষুদ্রই মনে হল।
অন্যপ্রান্তে আবার নীরবতা। “মিথ্যা বলছ তুমি!” পিন্টু মেজাজ দেখিয়ে বলল।
“তুমি ওদের কাছে আমার সম্বন্ধে বাজে বাজে কথা বলে ওদের মন বিগড়িয়ে দিচ্ছ।”

“হয়ত দিচ্ছি। কি করবে তুমি?” মরিয়ম খুব সহজ কন্ঠে বলে। এই জাতীয় কথার পরেও যদি লোকটা এই সামগ্রিক পরিস্থিতিটার গুরুত্ব না বোঝে তাহলে আর কিছুতেই বুঝবে না।
পিন্টু ভয়ানক ক্ষেপে গেল। “আমার সাথে তুমি এইরকম কেন করছ? কেন তুমি সবসময় আমার আর আমার পরিবারের বিরুদ্ধে কাজ কর? তোমার কি ধারণা রিমা নিষ্পাপ? তুমি তার কিচ্ছু জানো না। সে সাংঘাতিক ধুর্ত, ধোঁকাবাজ। আমার ভাইকে তার দরকার ছিল ইমিগ্রেশন পাবার জন্য। তাই তাকে পটিয়েছিল। বুঝতে পারছ আমার কথা?”
পিন্টু এমন ষাড়ের মত চীৎকার শুরু করল যে মরিয়ম ফোনটাকে কান থেকে এক ফুট ধরে ধরল। মনে মনে বেশ আনন্দই বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত কিছু একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। কিন্তু বউ-বাচ্চা ফেরত পেতে চাইলে চীৎকারে কোন কাজই হবে না। পিন্টুকে অন্য উপায় বের করতে হবে।

কলটা কেটে দিয়ে ফোনটার পাওয়ার অফ করে দিল মরিয়ম। পিন্টু ক্ষেপে লাল হয়ে যাবে, জানে। কিন্তু প্রশ্ন হল রেগে সে কি করবে? জানতে খুবই কৌতূহল হচ্ছে।

পরদিন সকালে মেয়েদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে দোলনকে বাসা থেকে তুলে এগলিনটন স্কোয়ার মলে গেল। দোলনের একটা পুরানো লাল টয়োটা করল্লা আছে কিন্তু সে বেশ ভীতু ড্রাইভার। খুব একটা গাড়ি চালায় না। মরিয়ম আসার পর থেকে সেই তাকে সবখানে নিয়ে যায়। দোলন বেশ সহজ-সরল, ফ‚র্তিবাজ। তার সঙ্গ মরিয়মের ভালো লাগে।
দুপুর দুইটার একটু পরে মল থেকে ফিরে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ধুসর ক্যামরিটাকে দেখেই চিনতে পারল। লাট্টু বেশ কিছুদিন ধরেই এই গাড়ীটা চালান। তিনি এখানে কি করছেন? নিজের সমস্যা নিজে মেটাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বাবাকে পাঠিয়েছে পিন্টু? হতাশায় আপনমনে মাথা নাড়ল মরিয়ম।

ভেতরে ঢুকে দেখল লাট্টু লিভিংরুমে বসে ওর বাবার সাথে কথা বলছেন। ওর বাবা অবশ্য কথা বার্তা খুব একটা বলেন না, একটু পরপরই ঘুমে ঢুলতে থাকেন। ওকে দেখে লাট্টু মনে হল যেন পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ফেললেন।
“মরিয়ম!” তিনি হাসি মুখে বললেন।
“হঠাৎ চলে এলাম। মনে হল একটু দেখা করে যাই।”
মরিয়ম নিজের বাবাকে কামরায় পাঠিয়ে দিয়ে শ্বশুরের সাথে বসল। “সব ঠিক ঠাক আছে আব্বা?”
লাট্টু মাথা দোলালেন। “আছে একরকম। তোমার শ্বাশুড়ী খুব একটা ভালো বোধ করছে না। বøাড প্রেশার অনেক বেড়ে গেছে। খেতে পারছে না। মাঝে মাঝে খুব মাথা ধরে। কষ্ট পাচ্ছে বেচারী। তোমাদের সবার কথা খুব বলছে।”

বাসায় ফেরার ব্যাপারে শ্বশুরের সাথে আলাপ করবার কোন আগ্রহ মরিয়মের নেই। সে চুপচাপ শুনল। লাট্টু জানতেন তার উপস্থিতিতে এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। কিন্তু তারপরও তাকে একটু চেষ্টা করতেই হত। বলা যায় একরকম কাকুতি মিনতিই করলেন মরিয়ম এবং বাচ্চাদের ফিরে আসার জন্য। মরিয়ম নিঃশব্দে শুনল, কিছু বলল না।
“আম্মাকে বলবেন নিজের শরীরের যত্ন নিতে। এই বয়েসে অসুখ বিসুখ হলে অকারণে কষ্ট পাবেন।” মরিয়ম আবেগহীন কন্ঠে বলে।

“আমিও তো ওকে সারাক্ষণ তাই বলি। শোনে না আমার কথা। বলে মেয়ে দুইটাকে না দেখা পর্যন্ত তার শরীর ভালো লাগবে না।“ লাট্টু এখনও আশা পুরোপুরি ছাড়েননি।
“স্কুলের পর তো মেয়েরা বাসাতেই থাকে,” মরিয়ম বলে। “মাকে নিয়ে চলে আসবেন একসময়।”
লাট্টু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। “সে তো এখন আর বাসা থেকে একেবারেই বাইরে যেতে চায় না। কিন্তু তারপরও বলব। যাইহোক, তুমি কতদিন এখানে থাকবে বলে ভাবছ?”
মরিয়ম মাথা নাড়ল। “আব্বা, আপনার প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে দিতাম। নিজের প্রতি যতœ নেবেন। আম্মাকে আমার সালাম দেবেন।”
লাট্টু অনীহা নিয়েই বিদায় নিলেন। তার ভয় হল পিন্টু পরিস্থিতি যাথাযথ বুঝতে পারছে না। সময় এসেছে নিজের সমস্যা তার নিজেরই মেটানোর।

৫৭
আগের দিন তুষার পড়েছে। খুব বেশি না পড়লেও রাস্তা ঘাট, বাড়ীর ছাদে একটা পুরু শ্বেত স্তর পড়বার জন্য যথেষ্ট। দুই ছেলে তুষার দেখে পাগলপারা হয়ে গেছে। এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখেছে অন্য বাচ্চারা তুষারে খেলছে। মা কেন তাদেরকে নীচে গিয়ে অন্যদের সাথে খেলতে দিচ্ছে না ব্যাপারটা তাদের মাথায় কিছুইতেই ঢুকছে না। ফায়জাও খুব অবাক হয়েছে। গত দুই দিন ধরে তারা একরকম এপার্টমেন্টের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। রিমা নিজেও কাজে যায় নি। খুবই সন্দেহজনক। বেশ কয়েকবার মাকে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু রিমা তাকে শুধু একটু ধৈর্য ধরতে বলেছে। ছেলে দুই জন কিছুক্ষণ ছটফট করে টেলিভিশন খুলে একটা বাচ্চাদের মুভি দেখতে লেগে গেছে। ফায়জাও একটা টিন এজারদের গল্পের বই হাতে নিয়ে সোফায় বসেছে। রিমাই দেখা গেল খুব ছটফট করছে। এক পর্যায়ে খেয়াল করল ফায়জা লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে লক্ষ্য করছে যদিও রহস্য ফাঁস করবার জন্য খুব একটা চাপাচাপি করছে না। দোষটা ওরই। মেয়েকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। একবার ভেবেছিল বলবে কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে না বলারই। জানে একটু অতিমাত্রায় সতর্ক হচ্ছে, কিন্তু অসতর্ক হয়ে একটা বিপদে পড়ার চেয়ে বেশি সাবধান থাকাই ভালো।

আজ আকাশে মেঘলা থাকলেও মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে সূর্য উঁকি মারছে। কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামঝি বাইরে অনেক ঠান্ডা। সে এক সময় লিভিং রুমে একটা সোফায় সুস্থির হয়ে বসল, পাশেই সেল ফোনটা রাখা, নজর বাচ্চাদের মুভিটাতে। দুই ছেলে আঁঠার মত সেঁটে আছে মুভিতে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কলের জন্য অপেক্ষা করছে ও। পালে বেশ হাওয়া লেগেছে। অনেক ঝুট ঝামেলার পর ওর জীবনে নতুন সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে। এই দিনটা কোনভাবেই বিনষ্ট হোক ও চায় না। অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে স্থির রাখার, ভেতরের উত্তেজনাকে অবদমিত করার, কিন্তু খুব একটা সফল হচ্ছে না। এতো দেরী হবার কারণটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। জাফর সকালে ফোন করে বলেছিল সব কিছু দুপুর নাগাদ হয়ে যাবে। দুপর কখন পেরিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে জাফরকে কল করবার তাগিদটা চাপিয়ে রেখেছে। সব ঠিকঠাক হলে সে নিজেই জানাবে।

যখন আরোও আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেল এবং রিমা দুপুরের খাবারের কোন ব্যবস্থা করল না তখন ফায়জা নিজেই উঠল। আগের রাতের পিজার কিছু বেঁচেছিল। সেগুলো গরম করে দুই ভাইকে দিল। তারা মুভি ছেড়ে ডাইনিং রুমে খেতে আসবে না। ফায়জা সেটা কখনই হতে দেয় না। তারা দুজনাই খুব ছড়িয়ে খায়, বিশেষ করে রবিন। আজ অবশ্য রিমা গোপনে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে ওকে অনুরোধ করল নিয়মের ব্যাতিক্রম করতে। ফায়জা ছেলেদেরকে লিভিংরুমে লাঞ্চ দিয়ে নিজে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পরে রিমাও ওর সাথে এসে যোগ দিল।
“তোমাকে কিছু দেব?” ফায়জা জানতে চায়।
রিমা মাথা নেড়ে ফায়জার আধা খাওয়া একটা টুকরা থেকে এক কামড় নিল। “ক্ষিধা নেই।”
“বাড়িটা নিয়ে কিছু হয়েছে, না?”
রিমা মাথা দোলায়।

“কি হয়েছে? কি জন্য অপেক্ষা করছ?” ফায়জা জানতে চায়। আসলে ওর যেটা জানতে বেশি আগ্রহ সেটা হচ্ছে রিমা কেন ওদেরকে স্কুলে কিংবা বাইরে যেতে দিচ্ছে না গত কয়েকটা দিন।
রিমা এক মুহুর্ত দ্বিধা করল। “আজকে বাড়ি ক্লোজিং হচ্ছে। এতো সময় কেন লাগছে জানি না। এজেন্টের কাছ থেকে কল পাবার জন্য অপেক্ষা করছি। পরে আমরা উকিলের অফিসে গিয়ে কিছু কাগজপত্র সাইন করব। উকিল আমাদের বাড়ীর চাবি দেবে।”
ফায়জা আনন্দে নেচে উঠল। “তাহলে আমরা আজই আমাদের নতুন বাড়িতে যেতে পারব?”
রিমা মাথা দোলাল। “আশা করছি। ঘন্টা কয়েক পরে।”
“এটা আমাকে আগে বলনি কেন?” ফায়জা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়।
“চাইনি কেউ জানুক,” রিমা অপরাধী মুখে বলে। “দুশ্চিন্তা হচ্ছিল নিরাপত্তা নিয়ে। আমি তোমাকে বললে, তুমি তোমার বন্ধুদের বলবে, তারা তাদের বাবা-মায়েদের বলবে- দিন পার হবার আগেই পাড়ার অর্ধেক মানুষ জেনে যাবে। অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। বুঝতেই পারছ, কেন আমি এতো সতর্ক।”
“ইন্সিউরেন্সের টাকাটা পেয়ে গেছ?”
রিমা মাথা দোলায়। “হ্যাঁ। সেটার অধিকাংশই চলে যাবে বাড়ীটার ডাউন পেমেন্টে। লেনদেনের ব্যাপারটা চুকে গেলেই বাঁচি। শুধু চিন্তা হয় এই বুঝি খারাপ কিছু একটা হয়।”
ওর মনে হয় মিলা এইসময় ওর পাশে থাকলে ভালো হত। মনে অনেক বেশি জোর পেত। কিন্তু মিলা গেছে তার ডাক্তার প্রেমিকের সাথে প্যারিসে।

ওর ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠে দ্রæত ফোন ধরল ও। জাফর। চুপচাপ তার কথা শুনল রিমা। ফোন রেখে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে লফিয়ে উঠল। “আমাদেরকে যেতে হবে এখন। জিব্রান! রবিন! যাও, রেডী হও।”
“আমি ওদেরকে রেডী করছি, মা,” ফায়জা বলে। “তুমি রেডী হও।”
রিমা মেয়েকে একটা আলতো হাসি দিয়ে দ্রুত নিজের কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ওরা যখন স্কারবরো টাউন সেন্টারের কাছে একটা বিল্ডিঙয়ে অবস্থিত উকিলের প্রশস্ত অফিসে পা রাখল ততক্ষণে জাফর সেখানে পৌঁছে গেছে। রিয়েল স্টেট উকিল বিরেন শাহ তার বন্ধু মানুষ। ছোটখাট, কৃষ্ণ মানুষ, ঝকঝকে হাসি। দেরীর জন্য ক্ষমা প্রার্থন করল। আজ সকাল থেকে তার বেশ কয়েকটা ক্লোজিং ছিল। সেই কারণেই দেরী। রিমার বাড়ী নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সব কিছু ঠিকঠাক। চিন্তার কোন কারণ নেই।

বিরেন জানতে চাইল ক্লোজিঙয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রিমা নিয়ে এসেছ কিনা। রিমা দুইখানা গভর্নমেন্ট আইডি এবং একটা সার্টিফাইড চেক এনেছে। ও মাথা দোলাল। বিরেন জানাল তাকে অনেকগুলো কাগজে সাইন করতে হবে। ডেস্কে জাফরের পাশে একটা চেয়ারে তাকে বসতে দিয়ে তার মহিলা এসিস্ট্যান্টকে বলল বাচ্চাদেরকে পাশের কামরায় নিয়ে যেতে যেখানে আরোও বসার আয়োজন আছে।

বিরেন সাইনিং পর্বটা সেরে ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল। রিমা একটু ইতস্তত করছে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল, “কোন সমস্যা?”

রিমা সময় দেখল। ও নোমানকে আসতে বলেছে। জাফর এবং উকিলকে ও বিশ্বাস করে কিন্তু তারপরও চেয়েছিল নোমান এসে কাগজপত্রগুলো একবার দেখুক।
নোমান অল্পক্ষণের মধ্যে হাজির হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। রিমা তাকে পারিবারিক বন্ধু হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিল। নোমান কাগজপত্রগুলোর উপর দ্রæত নজর বোলাল। রিমা সাইন করল। ফায়জা মনে হয় নোমানের কন্ঠস্বর শুনে থাকবে কারণ সে এই ঘরে এলো দেখতে। রিমা আড়চোখে তাকে আসতে দেখল কিন্তু কিছু বলল না। ও চায়না ফায়জা একটা ভুল ধারনা করুক।

আধা ঘন্টা পরে বিরেন তার হাতে সব সাইন করা ডকুমেন্টের একটা কপি ধরিয়ে দিল তারপর হস্তান্তর করল বাড়ীর চাবি। “কংগ্রাচুলেশনস! আপনি এখন একজন বাড়ীর মালিক,” সে হাসি মুখে বলে।
জাফর প্রস্তাদ দিল সে ওদের সাথে গিয়ে আরেকবার সবাইকে বাড়ীটা ঘুরে দেখাবে। ইনসপেকশনের সময় কয়েকটা সমস্যা ধরা পড়েছিল, বিক্রেতা ঠিক করে দিয়েছে। রিমা চাবির তোড়াটা হাতের মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে বড় করে একটা শ্বাস নিল। মিন্টুর কথাই সব চেয়ে বেশী মনে পড়ল এই মুহুর্তে। নিজের জীবন দিয়ে তাদের জন্য এই উপহার রেখে গেছে সে। মানুষ হিসাবে সে কেমন ছিল, কি করেছিল আর করেনি, সেসবে এখন আর কিছু আসে যায় না।

বাচ্চারা ভালো উপহার পেলে কাউকে ভোলে না। নোমানকে দেখেই দুই ছেলে দাঁত বের করে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ফায়জা গম্ভীর, সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে করতে একটা ছোট্ট ‘হাই’ দিল। “তুমি আসছ না?” নোমানকে জিজ্ঞেস করল।
নোমান কেশে গলা পরিষ্কার করল। “তোমরা চাইলে আসতে পারি। তোমাদের নতুন বাড়ীটা দেখতে খুব ইচ্ছা করছে অবশ্য।”
ফায়জা কাঁধ ঝাঁকাল। “আসো তাহলে।”
জাফরের সাথে ক্ষনিকের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হল রিমার। ভদ্রলোকের চোখে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি দেখল মন হল। আশা করছে সে কাউকে নোমানের কথা বলবে না। এই জাতীয় ব্যাপার ছড়াতে বেশী সময় লাগে না। এই মুহুর্তে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করবার মত মন মানসিকতা ওর নেই।

মিনিট বিশেক পর তিন গাড়ির বহর এসে থামল রিমাদের নতুন বাড়ির ড্রাইভওয়েতে। রিমা গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ওর মুখে ফুটে উঠল মিষ্টি এক টুকরো হাসি। প্রথম এই বাড়িটা দেখার পর আরোও অনেকগুলো বাড়ি দেখেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার এটাতেই ফেরত এসেছিল। একেই বলে নিয়তি।
হেঁটে উঠোনে উঠে চাবি দিয়ে দরজা খুলল রিমা। পেছনে তাকিয়ে দেখল নোমান বেশ আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। “দেখার মত কিছু না,” রিমা বলল।
নোমান মাথা দোলাল। “মন্দ না। ভালোই কিনেছ।”
“ভেতরে এসে ঘুরে দেখবে না?” রিমা জানতে চায়।
“নিশ্চয়।” নোমান ওর পিছু নেয়।

জিব্রান এবং রবিন এক দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেল, কামরা থেকে কামরায় ছুটাছুটি করতে লাগল, সিঁড়ি বেয়ে নীচে বেসমেন্টে গিয়েও কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করল। ফায়জা গেল ওর কামরা দেখতে। বাসায় নতুন কি কি কাজ করান হয়েছে রিমাকে দেখানোর জন্য ব্যাস্ত হয়ে ছিল জাফর। ড্রাই ওয়ালে বেশ কিছু স্থানে ভাঙ্গা ছিল। সেগুলো সব ঠিক করে দেয়া হয়েছে। নতুন পেইন্ট করলে বাড়ীটার ভেতরটা দেখতে খুব ভালো লাগত। রিমা চেয়েছিল কিন্তু বিক্রেতা রাজী হয়নি। পেইন্ট করাতে অনেক খরচ। তাছাড়া কিছু না করেই বাড়ীর যদি এতো চাহিদা থাকে তাহলে সে কেন অকারণে অর্থ খরচ করতে যবে? প্রথম দর্শনে ভেতরটা দেখে মনে হয় পুরানো, জরাজীর্ন, নোংরা। ফায়জার বেশ অপমান বোধ হচ্ছে। “ওকে কেন আসতে বললে?” মায়ের কানে আনে ফিসফিসিয়ে বলে সে।

“অসুবিধার কিছু নেই,” রিমা মেয়েকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। নোমানকে এইসবের মধ্যে টেনে আনার কোন আগ্রহই ওর ছিল না কিন্তু শেষ মুহুর্তে কেন যেন মনে হল নোমানের উপস্থিতি ওকে আরেকটু মানসিক জোর দেবে। নোমান বরাবরের মতই এসেই সব কিছু নিজের কাঁধে তুলে নিতে প্রস্তুত। যা করতে হয় সে করবে, যেখানে যেতে হয় সে যাবে। রিমাকে সাহায্য করবার জন্য কোন কিছু করতেই সে বিমুখ নয়।

“অসুবিধা আছে মা,” ফায়জা রাগ দেখায়। “সে নিশ্চয় আমাদেরকে অনেক ছোট ভাবছে।”
“সে ঐ রকমের মানুষ নয়,” রিমা মেয়েকে শান্ত করবার চেষ্টা করে। কিন্তু কাজ হল না।
নোমান দ্রুত বাড়ীটা ঘুরে দেখল। তাকে কাজে ফিরতে হবে। যাবার আগে রিমাকে মুভিঙয়ে সাহায্য করবার প্রস্তাব দিল। রিমা প্রতিজ্ঞা করল প্রয়োজন হলে সে তাকে নিশ্চয় জানাবে।
জাফরও একটু পরে চলে গেল। রিমা একটা ফ্যাসানের দোকান দিতে চায়। দোকান খুঁজে দেবার দায়িত্ব জাফরের উপরেই পড়েছে। সে কিছু খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু না দেখে কিছু বলতে পারছে না। তার ইচ্ছা আজ কয়েকটা সে দেখবে।

সে চলে যাবার পর, রিমা বাচ্চাদেরকে একজায়গায় জমায়েত করে সবাই মিলে একটু দোয়া করল। সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানানোর ব্যাপারটা ঠিক তার চরিত্রে নেই কিন্তু আজকে সে তার ব্যাতিক্রম করল। মাঝে মাঝে আনন্দময় মুহুর্তে কোন মহাশক্তিকে ধন্যবাদ জানাতে ভালোই লাগে।