বিদ্যুৎ সরকার : ঠিক এখানটায় প্রতিদিন সকাল বা বিকেলে এসে বসতাম। পর পর অনেকগুলো বসার জায়গা থাকা সত্তে¡ও ঠিক এ বেঞ্চটাতেই আমি বসতাম।কখনো অন্য কেউ বসা থাকলে আমি অপেক্ষা করতাম তার চলে যাওয়া অব্দি। কেন যে অন্য বেঞ্চগুলোতে বসতে মন চাইতো না তা আমি নিজেও জানতাম না। মন সায় দিত না। বেইলি রোড থেকে যে রাস্তা সরাসরি রমনা পার্কে গিয়ে মিশেছে সে গেইট দিয়ে ঢুকে ঠিক ডান দিকে যে বেঞ্চটি, ওখানেই আমি নিয়মিত বসে থাকি। বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে রমনা পার্ক। অতঃপর বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, মানুষের আগমণ নির্গমন দেখা। অনেক পুরনো বন্ধু – সজনের চেনা মুখগুলোর দেখা মিলে! আবার নিয়মিত প্রতিদিন দেখতে দেখতে অচেনা মুখগুলোও এক সময় অনেক চেনামুখে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পুরনো অনেক আড্ডার বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় কখনো-সখনো। এটা একটা বারতি পাওয়া আমার। সহসাই আমি ফিরে যাই আমার ফেলে আসা পুরনো দিনগুলোতে।
আমার মতোন যারা বয়সের দিক দিয়ে অনেকটাই পরিপক্ক, অবসরপ্রাপ্ত বা অবসরের দোরগোড়ায় তারা বিকেলে ছুটে আসে দেহ ও মনকে চাঙা রাখতে। আমার এর সাথে যোগ হবে শারীরিক দিকটিও – সুগার কানেকশন। অর্থাৎ পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ডায়েবিটিস বেমো। হঠাৎ করে আমিও স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে পড়ি তাই, নিয়মিতভাবে রমনায় গমন ও রমনে চ্ছেদ হয় না। রমনায় পুরো এক চক্কর মেরে এক ঠোঙা চিনে বাদাম নিয়ে আবার সেই বেঞ্চটায়। বাদাম বিলাস ভাবতে শেখায়। অতীত নিয়ে ভাবা যায় তেমনি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবার অফুরান সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় বাদাম শিল্প কলা। বাদামের খোসা ফাটানোর শব্দ আমাকে আনন্দ দেয়, বাদাম চিবনোর সুখ আমাকে সুখী করে তোলে মুহূর্তেই। ইদানীং ‘কাঁচা বাদাম…’ ভাইরাল গানে পৃথিবী উত্তাল।
বাদামের জয়জয়কার পূর্ব থেকে পশ্চিমে। সে কাঁচাই হোক আর বালু-ভাজাই হোক বাদামের উত্তাপ সর্বত্র। বেঞ্চটার ঠিক পিছনেই একটি কৃষ্ণ চূড়া চাড়া রোপণ করা হয়েছিল আমার শেকড় উৎপাটনের আগেই। এতোদিনে সেটা চাড়া থেকে বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে ফুল ফোটাতে, পাতা ঝরাতে সক্ষম। এবার এসেই প্রতিবারের মতোই ছুটে গিয়েছিলাম রমনার সেই খানটায় দেখে তো আমি অবাক, কৃষ্ণ চূড়া ফুল ফুটেছে গাছটায়। কিন্তু আমার প্রিয় বেঞ্চ এর পিছনের অনেকটাই ভাঙা। যেখানে হেলান দিয়ে বাদাম চিবুতে চিবুতে তাবৎ ভাবনার জাল বুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম এতোদিন, সেটারই কিনা এ দশা! তবুও কৃষ্ণ চূড়ার লালিমা আমার মনকে রাঙিয়ে দিল। পাশের ঝরা বকুলের সুবাসে ‘সাজ সকাল, মন মাতাল…।’
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা