হিমাদ্রী রয় : সংসারে পাশে থেকে যে দুঃখটাকে আপন, সুখে সমর্থন, অসুখে পরিচর্যা আর কঠিন সময়ে দেয় প্রেরণা সে নারী। সকালে চায়ের পেয়ালা হাতে, ভাতের হাড়ি, বাসন মাজা, সব কাজের দশভুজা, সন্তানের স্কুলব্যাগ, দুয়ারে দাঁড়িয়ে পতির হাতে ওয়ালেট তুলে দেওয়া, স্বামী-সন্তানের সুখনিদ্রার জন্য কোমল হাতে বিছানা পাতা, রাতে ভাষাহীন মশারি তলে ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করা পুরুষের সাথে অভিসার যাত্রা, অবশেষে তার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের উপর রেখে ক্লান্তির নীদ্রা যাপন।
সকাল থেকে রাত, জন্ম দেবার, অন্ন দেবার, সঙ্গ দেবার, মমতার আঁচলে আশ্রয় দেবার কখনো বোন, কখনো বন্ধু, কখনো জননী একি অঙ্গে অনেক রুপে বিরাজমান নারী, তার ভূমিকা প্রতিদিন প্রতি মুহুর্ত তাই একটি দিবসে নারীকে নিয়ে বন্দনা হয়তো করাই যায় কিন্তু নারী মর্যাদার সহাবস্থান আসতে হবে যার যার ঘর থেকে।
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আখ্যা একটি মান্যতা। গোলাপে আর কাব্যের আলাপে ঘিরে রাখার দিন এটি নয় বিবেকের আয়নায় নিজেকে যাচাই করা পুরুষ হিসাবে আমার সাফল্যে, সংকল্পে, ব্রতে কতটা পাশে রেখেছি নারীকে।
“নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী, পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি, যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটে সম্পদে সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে, পাবে তবে চিনিতে মোরে”।
নারী দেবীর মর্যাদা চায়নি কিন্তু তাকে মানুষ বলে গণ্য না করার করার অধিকার আমাদের কে দিলো, তাকে সম্মান করার দাবি সে রাখেনি কারো কাছে কিন্তু অসম্মান, অবহেলা অবজ্ঞা করার অধিকার নেই আমার কাছে। সংসারে স্বেচ্ছাশ্রমের হিসাব সে নেয় না কোন দিন আর আমি ভাত কাপড়ের হিসেব কষি কোন সাহসে।
নারী শুধু নর্মসঙ্গিনী নয় কর্মসঙ্গিনী এই এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সংসারে নারীর ভুমিকা সার্থক করে তুলা হবে আর তা নাহলে নারী অচেনাই থেকে যাবে “আমি অন্তপুরের মেয়ে চিনবে না আমাকে”।
সবার আগে বিছানা ছাড়া, সবার শেষে বিছানায় যাওয়া সেটা যাজ্ঞসেনীর জীবনে ছিলো, আমার মায়ের আমলেও ছিল আমার সন্তানের মায়ের সময়ে এসেও সেই এক।
আমার মায়ের জীবনে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে এই মন্ত্রের মধ্যে পুরুষের তন্ত্র খুব চালাকি করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ রমণী সুধাময়ী, শ্রীময়ী, ধিময়ী হয়ে বিনয়ের বিধি মেনে, রমণের গুনগুন গুঞ্জন কানে আসলেও মগজে ঠাঁই না দিয়ে মানিয়ে নেয়াই হবে জীবনের ব্রত আর মানতে না পাড়লেই ডাইনি জ্বালাময়ী। এই মেনে আর মানিয়ে নেয়ার মধ্যেই সংসার সুখের গুণ নিহিত। গান্ধারী স্বামীর অন্ধত্বকে নিজের চোখে বরণ করেছিলেন কালো কাপড় বেঁধে আর আধুনিক সমাজে আমাদের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে নারী নিজেকে বোরকায় নিয়েছে ঢেকে।
স্থান কাল বিশেষ নারী নিজেকে নিজের প্রতিপক্ষ করে তুলে। অন্যকে ভালোবাসতে হবে, অন্যের ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে তবে সেটা নিজের ইচ্ছাকে দাফন করে কেন? সহ্যের সাথে যাপনে চলে যায় একটা পুরো জীবন। মাঝখানে একজন রাসমনি, একজন বেগম রোকেয়াকে ধরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় শেষমেষ মায়ার কাছে যায় হেরে। হঠাৎ কোন বুদ্ধিমান পরিচালক লাইট, একশান বলতেই জেগে উঠেন নারী বহ্নিশিখা ‘নো মিনস নো’ নিয়ে উইমেন্স চ্যাপ্টারে লেখাজোখা। তারপর সেই হৃদয়হীন সংসারে বিবেকের একই বিধিবদ্ধ নিয়মের ছকে হাঁটা।
অনিয়মকে নিয়ম ভেবেইতো কাটিয়ে এসেছি অনেকগুলো বছর। এবং একে নারী ভয়ে নয় এড়িয়ে চলে শুধু বিনয়ে। সেদিন বৌ কাজ থেকে ফেরার পথে জলি বি থেকে ফ্রাইড চিকেন আনতে বলেছিলাম সে ভুলে গিয়েছিল খাওয়া হয়নি। পরদিন দুজনেরই ছুটি বৌ বললো চল যাই হালোহালো (ফিলিপিনো ডিজার্ট) খেতে ইচ্ছে করছে তোমারও জলি বি খাওয়া হবে। বেশ সেই কথামতো বেড়িয়ে পড়া। ফেরার পথে বৌ ধন্যবাদ দিতে ভুলেনি আর আমি খোটা দিতে। বললাম আমি তোমার খাবার আনতে বাফেলো যেতে পারি।
বৌ বললো আমার জন্য বাফেলোও যেতে হবে না আর চাঁদ-তারা নামিয়ে আনার কসম দিতে হবে না, পদ্ম আনতে যেয়ে ডুবতেও হবে না তিন প্রহরের বিলে। সে যা চায় তাহলো, যে বিছানা শেষে ছাড়বে গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব হোক তার, সবসময় গ্রীনবীন সেই বের করে রাখে, সিটি ময়লা নিয়ে যাওয়ার পর খালি বীনটা অন্তত ঢুকিয়ে রাখার এফর্ট যেন দেখাই, লন্ড্রিও সেই করে শুধু বাসি কাপড় যেন বাইরে না ফেলে ঝুড়িতেই ফেলি, আর কফি শেষ করে মগটা সিনকে। নিজেকে উত্তম সঙ্গী প্রমাণ করার জন্য গোলাপ যাত্রা তার কাছে অহেতুক।
নটে গাছটি মোড়ালো গল্প আমার ফুরালো বৌ জানলো না কোনদিন জানবেও না যেহেতু বাংলা পড়তে ও বুঝতে পারে না, তার অন্তরের অনুযোগের প্রেক্ষিতে আমার কনফেশন এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হোক যাপনের রোজনামচায় জীবনের গল্প বলায়।