মণিজিঞ্জির সান্যাল : প্রতিটি মানুষই একদিন বৃদ্ধ হবে শরীরে এবং মনে।তখন শরীর এবং মন জুড়ে অবসাদ বা বিষন্নতা আসতেই পারে। কারো ক্ষেত্রে একটু আগে আসে, কারো ক্ষেত্রে একটু দেরিতে।
একটা সময় সন্তান বড় হয়ে কাজের সূত্রে বাইরে গেলে বা বৈবাহিক কারণে নিজের শহর ছেড়ে বাইরে গেলে বাড়িটা বড্ড শূন্য হয়ে যায়। এতদিনের চেনা সংসারের রূপটাও কেমন যেন পালটে যায়। বাড়িতে তখন একলা, মন জুড়ে গ্রাস করে অবসাদের পাহাড়। চেনা ছকটা, চেনা গন্ধটা কেমন যেন পালটে যায়। মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এই মন খারাপকে আর তো বাড়তে দেওয়া উচিত নয়।
দূরে থাকা বড় ছেলেমেয়েদের কিন্তু একটু দায়িত্ব নিয়ে এ ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। বাবা-মায়ের মনের অসুখ ঠেকানোর দায়িত্ব কিন্তু ছেলে মেয়েদেরই তাই না? কিন্তু কীভাবে তাই তো?
আসলে কিছু সন্তান বাইরে চলে গেলে নিজের কাজ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে তখন সময় করে নিয়ম মতো বাবা মায়ের সঙ্গে ভালোবেসে যত্ন নিয়ে কথা বলা আর হয়ে ওঠেনা। নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজকে নিয়ে, নিজের চারপাশের জীবনকে খুব বেশি মাত্রায় প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের বাবা, মায়ের প্রতি সামান্য খোঁজ খবরটুকু নিতে ভুলে যান। এই ধরনের সন্তানরা একটা শ্রেণী।
কিন্তু সবাই তো সমান নয়। অনেকেই আবার নানা ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা, মায়ের সঙ্গে কথা বলেন, গল্প করেন। ফোনে কথা হয় দিনে দু’ একবার। কারও ক্ষেত্রে কয়েকদিন অন্তর। কেউ আবার খোঁজও নেয় না। এর ফলে মহানগর, শহরতলি, গ্রাম সর্বত্রই একা হয়ে পড়ছেন বয়স্করা।
সবার সন্তান যে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় ঝেড়ে ফেলে দূর দেশে পালিয়ে যান, তা নয়। সবাই নিজের নতুন সংসারের ব্যস্ততায় মা, বাবাকে ভুলতে বসেছেন, তাও নয়। বিশ্বায়ন, সমাজ পরিবর্তন, আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতির জন্য বড় বড় সংসার থেকে আলাদা হয়ে পড়ছেন সমাজে প্রবীণদের একাংশ। ছোট পরিবারে থাকলেও বড্ড একলা হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। যার পরিণতি অবসাদ। একরাশ মানসিক অবসাদ জাপটে ধরে তাঁদের।
তবে শুধু ছেলে-মেয়ে দূরে থাকলে বা তাঁদের সঙ্গে কোনও কারণে সম্পর্ক তিক্ত হলেই যে এই একাকীত্বের অবসাদ আসে তা একমাত্র কারণ নয়। বয়সকালীন ডিপ্রেশনের কারণ কিন্তু একাধিক। একটা সময়ে স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর শোক, সাংসারিক অশান্তি, সন্তান যত্ন না নিলে, পরিবারে গুরুত্ব কমলে, শারীরিক অসুস্থতা, অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ার মতো বহু কারণ রয়েছে।
কীভাবে বুঝবেন যে আপনি সত্যি সত্যিই অবসাদের শিকার হয়েছেন?
কিম্বা একজন সন্তান হিসেবে বাবা, মায়ের মানসিক অবসাদের লক্ষণ টের পাবেন কিভাবে?
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন তাদের মধ্যে আগের সেই আনন্দ বা খুশি খুশি মনোভাবটা কিন্তু নেই। আরো একটু খেয়াল করলে দেখবেন—
(১) সব কিছুতেই তাদের মধ্যে হতাশা বা দুঃখ পাওয়া, এমন একটা বোধ কাজ করে।
(২) আনন্দের ঘটনাতেও আনন্দিত না হওয়া।
(৩) ছোটখাটো বিষয়ে মন খারাপ করা।
(৪) সমাজে কারও সঙ্গে মিশতে না চাওয়া।
(৫) নিজের শখের কাজেও উৎসাহ না পাওয়া ।
(৬) ওজন কমা, খিদে না পাওয়া,
(৭) কোনও কাজ করতে ইচ্ছা না করা, নিজেকে উৎসাহিত করার ব্যাপারেও অনীহা,
(৮) ঘুমের সমস্যা যেমন দিনের বেলায় ঘুম পাওয়া, রাতে ঘুম না হওয়া অথবা উল্টোটাও অতিরিক্ত ঘুম পাওয়া।
(৯) কথা কম বলা,
(১০) হাঁটাচলার গতি কমে যাওয়া,
(১১) আত্মহত্যার প্রবণতা, মৃত্যুচিন্তা,
(১২) স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া,
(১৩) নিজের প্রতি যত্ন না নেওয়া
(১৪) খাবার না খাওয়া, ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়া,
(১৫) নিজের পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি নজর না দেওয়া।
এক্ষেত্রে একসাথে যারা আছেন তারা খুব সহজেই নিজেরা যত্ন, সহযোগিতা আর ভালোবাসায় মা, বাবাকে ভাল রাখতেই পারেন শুধু নয়, এটি তো একধরনের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে তাই না? যারা আমাদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, দায়িত্ব, যত্ন, সেবা এবং ভালোবাসা শেষ বয়সে প্রাপ্য নয় কি?
আর যারা দূরে থাকেন, তারাও কিন্তু অনেক দূরে থেকেও অনেক কাছে থাকতে পারেন মানসিকভাবে। মনটাই তো আসল তাই না বলুন?
দূরে থেকেও পাশে থাকার জন্যে চাই সুন্দর হাসি মাখা মুখ আর ভালোবাসা ভরা কিছু কথা।
বয়স্ক বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে না পারার জন্যে সত্যিই কষ্ট পান কিছু ছেলেমেয়ে। তাঁদের অসহায়তার কথা ফোনে শুনলেও বেশিরভাগ সময়ই বিশেষ কিছু করার থাকে না। তবু মনে রাখা দরকার, শুধুমাত্র আর্থিক সচ্ছলতা দিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি দায?িত্ব, কর্তব্য পালন করাটাই সব নয়। এই সময় তাঁদের মধ্যে একাকীত্বে ভোগার সমস্যা হয় যা থেকে ধীরে ধীরে অবসাদ গ্রাস করে। তাই বিভিন্ন কারণে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা পরিবারের থেকে দূরে থাকলেও দিনে কয়েক বার অন্তত ফোনে কথা বলুন। সব সময় যে জরুরি কথা বলতে হবে এমন নয়। স্বাস্থ্যের খবর নেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের কথাও মন দিয়ে শুনুন। আর অবসাদের লক্ষণ বুঝতে পারলে প্রথমে নিজে কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের সমস্যা কাটানোর চেষ্টা করুন। তাতে সম্ভব না হলে দ্রুত কোনও মনোবিদের কাছে নিজেরা নিয়ে যান। কারণ সময়মতো চিকিৎসা শুরু না হলে পরিস্থিতি হাতছাড়া হতে পারে।
অবসাদ যখন গভীর হয় তখন প্রয়োজন থেরাপি। সমস্যা অল্প হলে কাউন্সেলিং করে ঠিক করেন সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টরা। সে ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি করা হয়। রোগীর সঙ্গে কথা বলে তাঁর চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নানা প্রবণতা খুঁটিয়ে দেখা হয়। ঠিকমতো চিকিৎসা করলে বেশিরভাগ বয়স্কের মনের সমস্যা এই কাউন্সেলিংয়ের পরে সাধারণত ঠিক হয়ে যায়।
কাউন্সেলিংয়ে সমস্যা না মিটলে বা সমস্যা একটু জটিল হলে এসিটালোপ্র্যাম জাতীয় অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ দেওয়া হয়। এগুলির সাইড এফেক্ট তেমন নেই। এছাড়াও রয়েছে রিল্যাক্সেশন থেরাপি। এক্ষেত্রে শরীরের পেশি নানাভাবে সংকোচন, প্রসারণ করে রিল্যাক্স করা হয়। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ও শ্বাস ছেড়ে ডিপ ব্রিদিং করতে হবে। এছাড়াও ধ্যান-যোগা, শরীরচর্চা করেও ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা যায়।
শুধু নিজের বাবা-মা নয়, একলা হয়ে পড়া প্রবীণ প্রতিবেশী-পরিজনদের পাশেও থাকা উচিত। কাউকে একাকীত্বের মধ্যে ফেলতে নেই। একাকীত্ব সত্যিই ভয়ংকর অভিশাপ। মানুষ সমাজবদ্ধ। সবার সঙ্গে থেকেও গুরুজনদের সান্নিধ্য নিয়েই সমাজযাপন। পাড়া, কমপ্লেক্সের বয়স্ক মানুষদের প্রতি একটু খোঁজ খবর রাখা উচিত। দেখবেন এতে শুধু তাঁরা নয়, আপনিও ভাল থাকবেন মানসিকভাবে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ