হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
কানাডা দেশটি যেমন বড় তেমনি এর জলবায়ু/আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, নৃতাত্তি¡ক বৈচিত্র্য, এবং সর্বোপরি এর উত্থান ও মিথ, উপকথা, আদিবাসী প্রভৃতি প্যারামিটার বিশে^র দরবারে দেশটিকে দিয়েছে অনন্য এক অবস্থান।
আমার এই কলামের বিভিন্ন কিস্তিতে আমি ইতোমধ্যেই বলেছি যে, আমি ‘বালুকা বেলা’য় নানারকম ঝিনুক কুড়িয়ে বেড়াব, অর্থ্যাৎ স্মৃতিচারণ, আমার কানাডীয় জীবনযাত্রা, জীবনের নানান অভিজ্ঞতা, আমার লেখালেখির গল্প, সঙ্গীতজীবনের নানান গল্পকথা ও স্মৃতি, কানাডায় আমার সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে পড়াশোনা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করব। লিখব মনের কিছু না বলা কথা। বলব বিশেষ কোনো উপলব্ধির কথা, সাফল্য-ব্যর্থতা ও পাওয়া না পাওয়ার অজ¯্র কাহিনি।
তো আজকের আমার এই গৌরচন্দ্রিকার অর্থ হলো কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে পড়াশোনার সুবাদে আমার কিছু ব্যতিক্রমী ও ডাউন-টু-আর্থ অভিজ্ঞান ও জাদুবাস্তবতার মিশেল কিছু অনুভ‚তি ও সংবিত্তির কথা।
আমার শৈল্পিক ও কল্পনাপ্রবণ মানস, হার্দিক গলিঘুপচিতে সঞ্চিত হয়েছে অনেক রসদ, বিশেষত কানাডীয় কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে পড়াশোনায়।
আজকে তাই লিখব আমার দেখা মন্টোগোমারি’স ইন-এ সঞ্চিত কিছু স্মৃতি ও অনুভবের কথা। একমাত্র গ্রেটার টরোন্টোতে যে সংখ্যক কালচারাল প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠি, নানা মিউজিয়াম ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, তা যে কোনো অনুসন্ধিৎসু মনকে বিস্মিত করবে। তেমনি একটি মিউজিয়াম মন্টোগোমারি’স ইন। সাধারণভাবে বেশি পরিচিতি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান, যেমন ক্যাসা লোমা, আয়ারল্যান্ড পার্ক, ব্ল্যাক ক্রিক পাইওনিয়ার ভিলেজ?এসব বহুল আলোচিত ও পরিদর্শিত বলে এসব নামের সাথে আমরা কমবেশি পরিচিত সবাই। ফোর্ট ইয়র্ক বা মন্টোগোমারি’স ইন প্রভৃতির ঐতিহাসিক মূল্য থাকলেও এসবের নাম আমরা কম শুনেছি। ফোর্ট ইয়র্ক বা মন্টোগোমারি’স ইন-এ যাওয়া হয়তো বা হতো না আমার। এ দু’টি স্থানে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়েছে কালচার অ্যান্ড হেরিটেজে পড়ার কারণে।
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪-এ আমি কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ প্রোগ্রামে হেরিটেজ বিষয়ে শিক্ষা সফরে আমার সহশিক্ষার্থীদের সাথে মন্টগোমারি’স ইন জাদুঘর পরিদর্শন করি। এই সফরটি সংগ্রহ ও প্রদর্শনী ব্যবস্থাপনা কোর্সের একটি অংশ ছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রফেসর কেন জে. পারভিস।
এটি টরোন্টোর এটোবিকো অঞ্চলের ৪৭০৯ ডানডাস স্ট্রিট ওয়েস্টের ফারমার’স মার্কেটে অবস্থিত। আমি অবশ্যি নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে হাজির হয়েছিলাম। প্রফেসর কেন্ খানিকটা তিরস্কারের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার লেট হবার কারণ ছিল স্থানটা চিনে বের করতে।
পরবর্তীতে অবশ্য তিনি আমাকে ক্লাসে বা ফিল্ডট্রিপে সহজভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তার আরও দুয়েকটি ফিল্ডট্রিপেও স্থান চেনা জনিত জটিলতায় আমি দেরিতেই উপস্থিত হয়েছিলাম আর কেন্ সেটা অনেকটা মেনেই নিয়েছিলেন যে আমি লেট করেই আসব। তবে ক্লাসে আমার উপস্থিতি ও বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট/প্রেজেন্টেশনে তিনি আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন।
পরিদর্শনটি সবার জন্য একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। এই জাদুঘরটি অন্যান্য যাদুঘর থেকে একটু আলাদা এ জন্য যে এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আর ধরনের ভিন্নতার কারণে। এটি আসলে একটি সরাইখানা ছিল দূর অতীতে। আঠারোশ’ শতকে এটি নির্মিত হয়েছিল জর্জীয় আদলে। বিস্ময়কর বিষয় যে, এই স্থাপনাটা দুইশত বছরের ওপর সময় পার করেও সেই একইরকম রয়ে গেছে। কক্ষগুলিতে পরিপাটি বিছানা, ফায়ারপ্লেস আর কিেেচন যেন বর্তমানকালে সাজানো হয়েছে। আর সেইসব এখনও ব্যবহারোপযোগী। খাটের ওপর বিছানা বালিশ দেখে মনে হলো যেন ফায়ারপ্লেসে আগুন জ¦ালিয়ে ইষদুষ্ণ গরমে একটু আরাম করে ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। ইচ্ছে করলে উঠে গিয়ে কিচেন থেকে কফি বানিয়ে নিয়ে আসা যাবে।
সেই প্রাচীনকালের এবং অতীতের একটি সাধারণ সরাইখানা এখন নিজেই একটি অনন্য জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। বাইরে মাঠের মধ্যে গাছের নিচে দেখলাম অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছে এই সরাইখানা পরিদর্শনে।
আর ভেতরে আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। একটি কক্ষে দেখলাম সাদা পোশাক পরা এক মহিলা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে সেই অতীত জীবনের ভ‚তের গল্প আর জীবনযাত্রার বিচিত্র সিলূঅ্যাট তৈরি করছিলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো বন্দি জম্বি যেন বেরুনোর কোনো পথ খুঁজছে। জাদুঘরটির নামকরণ করা হয় ইন-কিপার ক্যাপ্টেন টমাস মন্টোগোমারি-এর (১৭৯০-১৮৭৭) নামে। এটি ১৮৩২ সালে জর্জীয় শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল।
পরে জানলাম, এটি মূকাভিনয় না, এটি কায়েজা নৃত্য? কধবলধ ফ’উধহপব. অন্টারিও প্রদেশে কায়েজা নৃত্য খুব জনপ্রিয়। এটি পারফরমিং আর্টস-এর একটি শাখা আর এর সাথে যোগ হয়েছে নানান উদ্ভাবনী উপাদান, তথা নাচের মধ্য দিয়ে বিশেষ কোনো বিষয়বস্তুর অভিব্যক্তি ও অঙ্গভঙ্গি।
অভিব্যক্তি/অঙ্গভঙ্গিকে নাচের অনুষঙ্গ করে সেই মহিলাটি সেই আঠারোশ; শতকের জীবনযাত্রাকেই ফুটিয়ে তুলছিলেন।
অন্যান্য কক্ষে শিল্পী এবং শিল্পীরা তাদের শো-এর মাধ্যমে পুরোনো দিনের জীবনধারাকে প্রতিফলিত করছিলেন বেহালা এবং বাঁশি বাজিয়ে, কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে নেচে। এটা ছিল, যেন সেই গৌরবময় অতীতের একটি বর্তমান রূপ। সামগ্রিক আবহটা ছিল যাকে বলা যায় মাইন্ড বেøায়িং। আমার একটা পর্যায়ে মনে হলো আমি একবিংশ শতাব্দীর কেউ নই; আমার শরীর মন যেন সেই আঠারোশ শতকে গড়া সরাইখানায় কোনো পথহারা পথিক।
জাদুঘরটি অতীতে এই সরাইখানায় আশ্রিত ও আগত মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার-আচরণের প্রতিফলন। একটা বিচিত্র অনুভ‚তি নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম।
তারপরও বেশ ক’দিন আমি আচ্ছন্ন ছিলাম মন্টোগোমরারি ইনের জাদুকরী আবহের প্রভাবে।
আজ এই পর্যন্তই। সামনের কিস্তিতে ফোর্ট ইয়র্ক পরিদর্শনকালে একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করার আশা পোষণ করছি।