মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
সতের.
কিন্তু একই সময়ে আমি টের পাচ্ছিলাম আমি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যাচ্ছি। আমি শুদ্ধির সেই নরম দিকটার পক্ষেই ছিলাম, যেমন সেই কথাটার মত, ‘অতি ভালো হচ্ছে ভালোর শত্রæ’। আমি যখন আমার লেখার জন্য সাদা কাগজ নিয়ে বসতাম তখন এক ধরনের আতংক আমায় পেয়ে বসতো। হয়তো আমি কোনো রচনা লিখতে বসছি যেটা অন্য কারো প্রত্যাশা মত হবে না, এমনকি আমি নিজেই আরেকবার লিখলে যেটা আমার মতো হবে না, এমন ভাবলেই আমার ভিতর একটা দুঃচিন্তা এসে ভর করতো। তবে পরবর্তীতে অবচেতন মনেই আমার এই ভাবনা আমার ভেতর এক আত্মরক্ষামূলক শক্তি হিসেবে কাজ করতো, আমি নিজেই নিজেকে বলতাম, আমি যদি কোন প্রজেক্ট এ পুরোপুরিভাবে মন না দিয়ে কাজ করি, তবে সেখানে আমার ফলাফল দেখে কোনোভাবেই আমাকে কারো নেতিবাচকভাবে বিচার করা উচিৎ নয়। আমার বাবা নিজের আপ্রাণ চেষ্টা আর অধ্যাবসায়ে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিলেন। আমি বাবার সেই সাফল্যের ধারে কাছে পৌঁছাবার জন্য সামান্যতম চেষ্টা করিনি, ফলে আমার বারবার মনে হতো, তবে কেনো নিছক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কেউ আমাকে বিচার করবে?
পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানে ফেল করার পর সরাসরি সিইজিইপি থেকে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে পড়ার আমার যে বাসনা, তা নিমিষেই দূর হয়ে গেলো, সাধারণত সবচেয়ে ভালো আর মেধাবীদের জন্য সেটার পথ উন্মুক্ত থাকে। আমি নিজেই নিজের সেই পথে যাবার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলাম, সম্ভবত আমি নিজেই নিজেকে বাধ্য করেছিলাম এমন পরিস্থিতি তৈরীর জন্য। আমার বাবা আর আমার ভেতর যদি সত্যিকারের বিভেদ খুঁজে বের করা হয়, তাহলে সরলভাবেই বলতে পারি, পড়াশুনা বা অন্য কাজে যুগে যুগে যারা সবচেয়ে ভালো করেছেন বাবাকে সেই দলে ফেলা যায়। সত্যি বলতে কি আমি কখনোই পড়াশুনায় বাবার মত সেই অসাধারণ তাক লাগিয়ে দেবার মত ভালো করতে চাই নি। বাবার পথটা ঠিক আমার পথ ছিল না ।
আমি জানতাম, আমার অন্যদের চেয়ে ভালো করার সব ক্ষমতা আছে। যখন কোনো বিষয়ের বিশেষ পরীক্ষা নেয়া হতো এবং আমার মনে হতো এমন বিষয়ের পরীক্ষাটা আমার ভালোভাবে দেয়া উচিৎ, তখন সেটায় আমি সত্যিই চমৎকার ফলাফল করতাম। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রেবফ এ নতুন ভর্তিচ্ছুদের জন্য যে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল, সেটায় আমি সবচেয়ে ভালোদের দলে ছিলাম। হাই স্কুলের শেষ বছরে আমি স্যাট এ অংশ নিয়েছিলাম। সেই পরীক্ষায় আমি ১৪০০ পেয়েছিলাম, এই নম্বরের ফলে আমি প্রথম পাঁচ জনের দলে ছিলাম। আমার কিছুটা হোঁচট খাওয়া গ্রেড থাকা সত্তে¡ও এই স্যাট এর ফলাফলের জন্য খুব সহজেই ম্যাকগিল এ আর্টস এ ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়েছিল। কয়েক বছর পর, আমি আইন স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেই পরীক্ষায় আমি শতকরা আটানব্বই ভাগ নম্বর পেয়েছিলাম। অতএব, আমি জানতাম আমি যথেষ্ট স্মার্ট। আমার শুধু আমার নিজের পথটা খুঁজে বের করার প্রয়োজন ছিল। আর এরজন্যেই আমি ঠিক করেছিলাম সাহিত্যে পড়বো। আমার মনে হয়েছিল, যে বিষয়টার প্রতি আমার সত্যিকারের ভালোলাগা আর ভালোবাসা আছে, আমি খুব সহজেই সেটাতে আমার চিন্তাকে কাজে লাগাতে পারবো। আর পড়াশুনা আমার কাছে এমন একটা বিষয় যা আমাকে কিছু সময় উপহার দেয় যে সময় আমি আমার নিজেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি।
১৯৯১ সালের শরৎকালে আমি যখন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করি, তখন আমার সামাজিক জীবনে আমার ব্রেবফ এর বন্ধুরাই ছিল আমার আসল বান্ধব। কিন্তু ক্যাম্পাসের নতুন কয়েকজন আমার বন্ধুত্বের জগতে পদার্পণ করে, বিশেষ করে যাদের একজন এখনো আমার বন্ধুত্বের গভীরতার নিরিখে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আসনে জেগে আছে।
ম্যাকগিল এ আমার যাবার প্রথম সপ্তাহেই জোনাথন এবলেট এর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। জন আর আমি অটোয়ায় একই এলিমেন্টারী স্কুলে পড়তাম। স্যাটনার ভবনের দিকে যেতেই আমি তার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ঐ ভবনটাকে ক্যাম্পাসের প্রাণ বলা হয় যেখানে ছাত্রদের অধিকাংশ বড় বড় দলগুলো আড্ডা দেয়। আমরা একে অপরের খোঁজ খবর নেয়ার পর জন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ম্যাকগিল এ আমার অনেক বন্ধু হয়ে গেছে কি না। তার কথা শুনে আমি আমার কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে শুধু বলেছিলাম, যেহেতু আমি একজন মন্ট্রিয়লের ছেলে সে কারণে ইতিমধ্যে আমার অনেক বন্ধু হয়ে গেছে, তবে আমি আর নতুন বন্ধুর খোঁজ করছি না। সত্যি বলতে কি, নতুন বন্ধু কিভাবে খুঁজতে হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, আর আমি নিশ্চিত আমি নিজে থেকে কখনও নতুন বন্ধু খোঁজার চেষ্টাও করতাম না। আমার কথা শুনে জন তার আশপাশটা একটু দেখে নিলো তারপর কাছেই দাঁড়ানো লম্বা চুলের এক যুবককে ইশারায় ডাকলো। জন তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। সে ছিলো গ্যারি বাটস, ম্যাকগিল ডিবেটিং ইউনিয়নের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আজকে প্রায় পঁচিশ বছর পর গ্যারাল্ড শুধু আমার প্রিয়তম বন্ধুই নয়, কানাডার লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে সে আমার ঘনিষ্ঠতম পরামর্শক।
গ্যারির আমন্ত্রণেই আমি ডিবেটিং ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম আর আমরা খুব দ্রæতই খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। সেই ডিবেটিং ইউনিয়নেই আমি আমার পরের বছরটা বিতর্কে আমার যে দক্ষতা আছে তাকে শাণিত করেছিলাম আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। ওটা এমন এক জ্ঞান আহরণের জায়গা ছিল যেখানে আমি আমার নিজের মত করে চিন্তা করতে শিখেছিলাম এবং আমার প্রতিপক্ষের বক্তব্যের দূর্বলতাকে ধরে কিভাবে যুক্তি আর নান্দনিক শব্দ ব্যবহার করে তাদের ঘায়েল করতে হয় তা শিখেছিলাম।
আমি সেই সময়েই শিখেছিলাম, কিভাবে বিতর্কে যৌক্তিক কথার অলংকরণে আর কিছুটা হাসির পরিবেশে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতে হয়। এই কৌশলটা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতো যখন তর্কের সমাপ্তিতে টানতে হতো, স্নানের চেয়ে শাওয়ার নেয়াটা ভালো বা গ্রীস্মের চেয়ে শীতকাল ভালো এমন সময়ে। বিতর্কের এমন বিষয়ে সেই বিতার্কিকই সফল হতো যে জন্মগতভাবেই একজন কমেডিয়ান। ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগতো কারণ আমি যে হিউমার ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম তা একজনকে দম ফাটিয়ে হাসানোর পরিবর্তে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিতো। আস্তে আস্তে আমি শিখে গিয়েছিলাম কিভাবে এবং কোন মাত্রায় প্রতিপক্ষের কথা ধরে সে অনুযায়ী তাকে পরাস্ত করতে হবে।
সেই নব্বই এর শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে যে সব বিষয়গুলো খুব বেশী আলোচিত হচ্ছিল সেই বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করার চিন্তাশক্তি এই বিতর্ক চর্চা আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ম্যাকগিল এর অধিকাংশ সেরা বিতার্কিকরাই ছিল মেয়ে যারা মূলত ছিলো নারীবাদী। আমার মনে পড়ে, তাদের কয়েক জনের সাথে আমার প্রায়ই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো এই বিষয়টা নিয়ে যে, একজন পুরুষ কখনো নারীবাদী হতে পারে কি না? তাদের কয়েক জন যুক্তি দেখাতো, বিষয়ের দিক দিয়ে নারীবাদ’কে বুঝতে হলে নারীদের প্রেক্ষাপটে চিন্তা ভাবনা, এমনকি বেড়ে উঠতে হবে যেটা একজন পুরুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাদের এমন সব যুক্তিতে আমিও যুক্তি দেখিয়ে বলতাম, নারীবাদ প্রতিষ্ঠায় পুরুষের অংশগ্রহণকে একেবারে বাদ দেয়া মানে নারীবাদ চিন্তায় যে সম অধিকারের নীতির কথা বলা হয় তাকে উপেক্ষা করা।
(চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা