ইউসুফ কামাল : বারো’টা বাজার সাথে সাথেই কুতুব মিনার থেকে রওয়ানা দিলাম কারোলবাগের হোটেলের পথে। বড় জোড় ঘন্টা খানেক লাগতে পারে। ড্রাইভারকে বল্লাম পথের মধ্যে ভালো একটা ধাবা’য় কিছুক্ষণ দাঁড়াবো দুপুরের খাবারের জন্যে। উদ্দেশ্য দুইটা, দুপুরের খাওয়া ও সময় সাশ্রয় করা। আসলেই খাবারের মান ভালো, হোটেলের চেয়েও। সবাই মোটামুটি তৃপ্তি নিয়েই খেলাম। আন্ত জেলা ও দূরগামী ট্রাকের ড্রাইভারই এই সমস্ত ধাবা’র প্রধান খদ্দের তাই এদের ধরে রাখতেই এরা সব সময় সচেষ্ট থাকে, আবার কোন ধাবা’র সাথে মদের দোকানও থাকে। দিল্লিতে পাঞ্জাবী রেস্টুরেন্টে প্রকাশ্যে মদও পাওয়া যায়।
হোটেলে পৌঁছেই তেওয়ারীকে দিয়ে কোলকাতা হোটেলে সুকুমার বাবুর সাথে কথা বলে কাল থেকে দু’দিনের জন্য দুটো রুম বুক করলাম। তেওয়ারীর হোটেলের হিসাব শোধ করে রুমে এসে গোছ গাছ করতে লেগে গেলাম সবাই। দশ মিনিটের মাথায় তেওয়ারী চা পাঠিয়ে দিলো রুমে, এটা যে তাদের ব্যবসার একটা গুন তা আর বুঝতে বাকি থাকলো না। পৌনে চার’টার দিকে রওয়ানা দিলাম ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে। ট্রেন ছাড়ার পনেরো মিনিট আগেই ট্রেনের কামরায় উঠে পরলাম। আগে থেকেই আলম বলে রেখেছে এবার সে নীচের বার্থে ঘুমাবে উপরে সিকান্দর। দু’জনের মধ্যে সব সময়ই খুঁটিনাটি লেগেই থাকে আবার যত গোপন শলাপরামর্শও দুজনেই করে। এও এক ধরনের জটিল সমীকরন।
সঠিক সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো। আধা ঘন্টা পর এ্যাটেন্ড্যান্ট এসে পড়লো। তবে এবার আর পুরনো ভূলটা করলো না সিকান্দর, এ্যাটানডেন্ট খাবারের মেনুর কথা বলতেই সিকান্দার বল্লো, ননভেজ। গতবারের ঠকে যাওয়ার স্মৃতিটা মনে হয় ভুলতে পারছে না। বড় একটা বিজয় করতে পেরেছে ভেবে তার চোখে মুখে আর হাসি ধরে না। ওর কান্ডে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। ঘন্টা খানেক পরেই এ্যাটেনডেন্ট খাবার টেবিলে দিয়ে চলে গেল। ভাবলাম বেড়ানোর পর্ব তো মোটামুটি শেষ পর্যায়ে, দুই দিন কোলকাতা থেকে আবার ঢাকার পথে বিমানে উঠবো। আলম, বিদ্যুৎ, সিকান্দরকে নিয়ে আগামী দুই দিনের কর্মপন্থা নিয়ে একটু আলাপ করে নেওয়া যেতে পারে। কার কার কোথায় যাওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছা এখনই জানা দরকার, তাতে সবাই বিড়লা প্লানোটোরিয়াম, হাওড়া নতুন ব্রীজসহ আরো দু’একটি স্হানের ব্যাপারে মতামত রাখলো। বিদ্যুৎ, সিকান্দর, আলম সিনেমা দেখার বিষয়ে ইচ্ছা পোষন করলো।
দিল্লী ঘুরে সবাই একটু খুশী, গল্পে শোনা আর বাস্তবে দেখা যে কত পার্থক্য সেটা সবাই বুঝতে পারছে। তাছাড়া দিল্লী সম্মন্ধে আমাদের কারোরই তেমন অভিজ্ঞতা ছিলো না, পশ্চিম বাংলার সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের যে কত বৈষম্য সেটা না দেখলে বোঝাই যায় না।
আগ্রা, আগ্রাফোর্ট, তাজমহল, কুতুবমিনার দেখে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা কোনোমতেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তবে জনসংখ্যার বিষয়টা ভারতের আর আমাদের বাংলাদেশের যে কতো মিল সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তবে পশ্চিম বংগের সাথে মিলটা সব চেয়ে বেশি। দিল্লীর ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ সেটা সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইতিহাসে পাওয়া খুবই দুস্কর।
প্রায় হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন সারা ভারত ও বৃহৎ ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে আছে যার পরিধি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ আরো কয়েকটা দেশ জুড়ে। মুসলিম সভ্যতার চিহ্ন এমনভাবে বিদ্যমান যা সহজে মুছে ফেলা যাবে না। সেই ইতিহাস ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করেছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারত শাসনের শুরু থেকে। এর মধ্যেও দু’একজন ইংরেজ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ভারত বর্ষের জন্য জনহিতকর অনেক কাজ ও করে গেছেন যা সত্যিই বিস্ময়কর।
সবাই একসাথে রাতের ডিনার শেষ করে যার যার বার্থে চলে গেলো। কম্বল খুলে গায়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম। জানালার বাইরের নিকশ কালো আধার, শুধু সামনের দিকে দ্রæত সরে যাচ্ছি সবাই এটাই বোঝা যাচ্ছে। রাতের আধার ফুড়ে যন্ত্রদানব ছুটে চলেছে উর্ধশ্বাসে, সাথে নিয়ে যাচ্ছে শত মানুষের স্বপ্ন সাধ। কয়েকদিনের ঘোরাঘুরির কারণে ক্লান্ত শরীর, কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। যখন ঘুম ভাঙলো দেখি সকাল হয়ে গেছে আলম মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকছে। মানুষের পদচারণা শুরু হয়ে গেছে নামার প্রস্তুতি নিতে। গন্তব্যের কাছে চলে এসেছি প্রায়। হাতমুখ ধুয়ে সবাই প্রস্তুত হচ্ছে। ব্রেক ফার্ষ্ট দিয়ে গেছে, পাউরুটির সাথে জেলির প্যাকেট। উপর থেকে নেমে সবাই নাস্তা করছে, হাওড়া পৌঁছতে হয়তো মিনিট ত্রিশেক লাগবে। হাওড়া কোলকাতার সবচেয়ে বৃহৎ ও পুরনো রেলওয়ে ষ্টেশন। শুধু তাই নয় পৃথিবীর মধ্য অন্যতম ব্যস্ততম ষ্টেশন। হাওড়া ষ্টেশনের ২৩টি প্লাটফর্ম দিয়ে প্রত্যেক দিন ৬০০ যাত্রীবাহী ট্রেন আসা যাওয়া করে। হিসাব অন্তে জানা যায় প্রায় ৬/৭ লক্ষ লোক রোজ এখান দিয়ে চলাচল করে।
ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলাম নিউমার্কেট এলাকার হোটেল ব্রাইটনে। ম্যানেজার সুকুমার টেলিফোন পাওয়ার পরই দুইটা রুম রেডী করে রেখেছে। রিসিপশনের পাশের রুমেই বসে ছিলেন, সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। দেশী মানুষ বলে কথা, জিজ্ঞেস করলেন কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা পথে। রুমে ঢুকে গোসল করে সবাই একটু রেষ্ট নিয়ে বেরিয়ে রাস্তার উল্টো দিকের হোটেল ‘কস্তুরী’ তে ঢুকলাম। কতদিন যে বাঙালির খাবারের স্বাদ পাইনি, সবাই ভালোই পেট ভরে খেলো। সিকান্দর তো উঠতেই চায় না ও মহা খুশী। রুমে এসে ঘুমিয়ে নিলাম, উঠে সুকুমার বাবুকে বুলার নাম্বার দিয়ে দেশে একটা কল বুক করলাম। কথা হয় না অনেক দিন, একটু চিন্তা করছিলাম, কেমন আছে? একটু খারাপ ও লাগছে। প্রায় রোজই দেখা হতো সে খানে অনেকদিন হয়ে গেছে খারাপ লাগাও স্বাভাবিক। ঢাকা থাকলে কথা বলা অনেক সহজ হতো। মিনিট দশেকের মধ্যেই রুমের ফোন বেজে উঠলো। কেমন আছো? কিছুটা উদ্বেগ মিশ্রিত কন্ঠস্বর। কবে ফিরবে? শান্ত কন্ঠে উত্তর দিয়ে বল্লাম, তুমি ভালো তো? আমরা সবাই ভালো। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে যে যাই বলুক খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, ভালো কি থাকা যায়? বল্লো, ভালো লাগছে না। কেমন যেন দম বন্ধ করা পরিবেশ মনে হচ্ছে চারিদিকে। কন্ঠ স্বরেই বুঝলাম মন থেকেই বলছে। বল্লাম, ঈদের পর আসো তোমার সেই ভালো লাগা চারুকলার লিচু তলায় যেয়ে বসবো।
সিনোরিটায় চা খাবো, রেস কোর্সের সবুজ ঘাসে হাঁটবো। মন খারাপ করো না। আমার কথাগুলো চুপ করে শুনলো। আস্তে আস্তে বল্লো, ভালো মতো ফিরে আসো। তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কতদিন দেখা হয় না আমাদের বলো তো! বল্লাম, আমাদের ঘোরাঘুরি তো শেষ কালকের পরদিন ঢাকার পথে রওনা হবো। সবার হাতেই কিছু টাকা জমে আছে, কিছু কিছু কেনা কাটা করবে সবাই, তোমার জন্য কি আনবো বলো? কিছু আনতে ইচ্ছা করছে। তোমার জন্য কি কিনেছো? সংগে সংগে জানতে চাইলো। বুঝলাম কিছু বলবে না। কিছু চাওয়ার মানুষও না, আনন্দের বহি:প্রকাশ ওর মধ্যে ভিন্নতর, বুঝাবে না কিন্তু চোখ মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি।
বিকেলে সবাই ঢুকলাম কোলকাতার ঐতিহ্যবাহী নিউমার্কেটে। সবাই যার যার মতো কিনছে। বিদ্যুৎ টেনে নিয়ে গেল ফ্যাশান জুয়েলারীর ষ্টোরে, স্যান্ডস্টোনের একটা নেকলেস পছন্দ করলো সাথে কালো রংয়ের পেন্ডেন্ট। বল্লো বুলার জন্য নাও, দাম ও আহামরি কিছু না কিন্তু সুন্দর, তখন বাজারে খুব চল এটার সৌখিন অনেকেই কিনছে। গায়ের রংয়ের সাথে কালো রংয়ের পেন্ডেন্টটা ম্যাচ করবে সুন্দর। নিয়ে নিলাম। কল্পনা করলাম এটা পাওয়ার পর ওর প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে?
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা