মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
ষোল.
ব্রেবফ এর সেই পড়া আদায় করে নেয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় আমি অনেক বেশি উপকৃত হয়েছিলাম আর এমন একটি পরিবেশের মধ্য দিয়েই আমি বেড়ে উঠছিলাম। কিন্তু এত সুন্দর ও চমত্কার পড়াশুনার পরিবেশ থাকা সত্তে¡ও অনেক কিশোরদের মত আমিও আমার নিজের মত করে একটু অন্যভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতাম। ক্লাসে আমার যে সব বিষয়গুলো ভালো লাগতো সেগুলো আমি খুব বেশি করে পড়তাম, কিন্তু যেটা আমার ভালো লাগতো না, সেটা আমি কোনো রকমে চালিয়ে যেতাম। ক্লাসে আমি যখন মনোযোগ হারিয়ে ফেলতাম, তখন লুকিয়ে কোলের ওপর কোনো এক উপন্যাস রাখতাম আর ক্লাসের ক্লান্তি থেকে একটু মুক্তি খুঁজতাম। আমার সব সময়ই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমি পরীক্ষায় অনেক ভালো নম্বর পাবো এবং সাধারণত আমি পেতামও। কিন্তু আস্তে আস্তে স্কুলের পড়াশুনা আর নিয়মনীতি থেকে আমি একটু পাশ কাটিয়ে চলতে থাকলাম। আমার সাথে আমার শিক্ষকরাও সেটা বুঝতে পারছিলেন। একদিন আমার অংকের শিক্ষকের মনে হয়েছিল আমার এই পাশ কাটানোটা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। পড়াশুনা ও ক্লাসের কাজের প্রতি আমার এই অনীহা আর এই অমনোযোগিতা লক্ষ্য করে একদিন তিনি আমাকে তাঁর অফিস ঘরে ডেকে তাঁর সামনে বসালেন। বুঝছিলাম, কঠিন কিছু তিনি আমাকে বলবেন। তিনি ঠাণ্ডাভাবে বলা শুরু করলেন, ‘জাস্টিন, আমি ইদানিং লক্ষ্য করছি তুমি পড়ালেখায় ভালো করছো না। আমি জানি, তোমার সবচেয়ে ভালো করার সব ক্ষমতা আছে, কিন্তু তুমি পড়ালেখার প্রতি যথেষ্ট সময় দিচ্ছো না।’
আমি তাঁর কথাটা কানে নিচ্ছিলাম না। আমি বিভিন্ন সময়েই এমন ধরনের কথা অনেক বার শুনেছি, সেজন্য সেই কথাটা আমার কাছে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না। আমার এমন ভাব লক্ষ্য করে সেই সময়ই তিনি রেগে বোম ফাটালেন, ‘তুমি জানো আমার এখন কি মনে হচ্ছে?’ রাগতে রাগতে এই কথা বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর তাঁর পরবর্তী কথা যে আমার কাছে চরম আঘাতের হবে সেটা জেনেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমার মনে হয় কি জানো, হয়তো তুমি নিজে মনে করো যে তোমার বেশি পরিশ্রম না করলেও চলবে, কারণ তোমার বাবা হচ্ছেন পিয়েরে ট্রুডো।’
আমার তখন পনেরো বছর বয়স এবং আমি তখন গ্রেড নাইন এ পড়ি। আমার ঐ জীবনে সেটাই প্রথম, যে কেউ আমার সাথে ওমনভাবে কথা বলেছিল। আমি নিশ্চিত আমার কিছু শিক্ষকও আমার সম্পর্কে ওমনটা ভাবতেন, বিশেষ করে যখন তাঁরা আমার আলস্য নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্ট হতেন।
কিন্তু কেউ কখনো আমার স্কুলে অমনোযোগিতার জন্য এভাবে আমার পারিবারিক পরিচয় নিয়ে কথা বলেননি। হঠাত এমন এক কথা শুনে আমি চরম অপমানিতবোধ করছিলাম। মুহূর্তে আমি কিছুটা রেগে গিয়ে আমার শিক্ষককে বলেছিলাম, ‘আমাকে এভাবে অপমান করবেন না।’
আমাদের বাবা সব সময় আমাদের তিন ভাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, আমরা যেন সব সময় মনে রাখি যে ‘ট্রুডো’ নামটা আমাদের কাছে কখনও যেন কোনো ‘মুদ্রা’ হিসেবে না মনে হয়, যে আমরা ঐ নামটা ভাংগিয়ে কোথাও কোনো ফায়দা লুঠবো, বরং আমরা যেন সব সময় ‘ট্রুডো’ নামের যে ওজন আর সম্মান আছে, তা যেন সব সময় দায়িত্বের সাথে রক্ষা করি। আমার মনে হয়, আমার শিক্ষক আমাকে যদি বলতেন, আমি ‘ট্রূডো’ নামের অবমাননা করছি, তাহলে আমি আমার অপরাধ নত শিরে মেনে নিতাম। আমার বাবা আমাকে কয়েক বারই বলেছেন যে, ব্রেবফ এ আমার যে সাধারণ মানের ফলাফল তাতে তিনি মাঝে মাঝেই হতাশ হন। কিন্তু সে যাই হোক, আমি কখনও কারো কাছ থেকে এমন ব্যবহার প্রত্যাশা করি না, যে আমি আমার বাবার পরিচয়ের জন্য গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলাফেরা করি, আসলে বিষয়টা একেবারেই ভুল।
তারপরও যখনই আমি আমার অংকের শিক্ষিকার সেই মন্তব্যটা নিয়ে ভাবতাম, তখনই আমার মনে হতো তাঁর কথার মধ্যে একটা অর্থ আছে। যদিও ওমন কথা শুনার মত কোন আচরণ আমি করিনি তারপরও সেটা আমার বিশেষ গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছিল। আসলে আমার শিক্ষকরা আমাকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, আমি আমার বাবার নাম নিয়ে বাণিজ্য করি আর নাই করি আমি যদি ওমনভাবে শরীরে বাতাস লাগিয়ে চলাফেরা করি তাহলে আমার আশেপাশের মানুষজন এমন ভাবতেই পারে। আমি উপলব্ধি করি, আমার শিক্ষিকা সেই উচ্চস্বরে আমার সাথে কথা বলে আসলে আমাকে বলতে চেয়েছিলেন, আমার ভিতর যদি সত্যি সত্যিই ভালো কিছু করার ক্ষমতা থাকে তবে কোনোভাবেই সেটাকে অবহেলা করা উচিত নয়।
আমি ব্রেবফ এ পড়াশুনা শেষ করেই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছি। এই সময়গুলোতে মাঝে মাঝে আমার পড়াশুনার স্বাভাবিক গতিতে যে ছেদ পড়তো তা শুধু আমার শিক্ষকদেরই চিন্তায় ফেলতো তা নয়, সেটা আমারও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। ধীরে ধীরে আমি ধরতে পেরেছিলাম, এই সমস্যাটার মূল কারণ শুধুমাত্র আমার ক্ষণকালের বয়ঃসন্ধিকালের আলস্য ছিল না, বরং এটার পেছনে এক গভীর কারণ ছিলো। এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন আমি একেবারে ইচ্ছে করেই পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান এ ফেল করেছিলাম। ঐ কোর্স এর রিপোর্টটা যখন আমি দেখেছিলাম তখন আমি কিছুটা চুপসে গিয়েছিলাম। ওটাই ছিলো আমাকে এক ধাক্কা দেবার মুহূর্ত যখন আমার মনে হয়েছিলো, আমার ভিতর কিছু অসংযত বিষয় আছে যা আমাকে ভালোভাবে দূর করতে হবে।
তখন আমার মধ্যে ঠিক মনোযোগের অভাব ছিল না, আসলে আমার যে বিষয়টা ভালো লাগতো সেটা আমি অনেক গুরুত্বের সাথে এবং চমত্কারভাবে করতাম। সত্যি কথা বলতে কি, যে সব কোর্সগুলোয় আমি মজা পেতাম সেগুলোই আমি এমন মজে যেতাম যে আমার সেই আগ্রহ আমাকে সেই সব শিক্ষকদের শিক্ষা সহকারী হিসেবে কাজ করার পথ খুলে দিতো, সেইসাথে যে সব ছাত্ররা ঐসব বিষয়ে কোনো সমস্যার পড়তো, তাদের সমস্যা দূর করার জন্য সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করতে আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তাম।
পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানে ফেলের বিষয়টা আমার বাবাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছিল। বাবা তাঁর এই এভিনিউ দ্য পিন্স এ তাঁর পড়ার সময়টার কথা প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন যেখানে তিনি অসাধারণ কিছু করেছিলেন। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, আমি তাকে নিরাশ করেছিলাম আর আমি তাঁর মত করে বেড়ে উঠছি না। আমার সারা বাল্যকাল জুড়ে আমার বাবা ছিলেন আমার একমাত্র নায়ক। তিনি ছিলেন আমার আদর্শ, আমার পথ প্রদর্শক আর আমার জীবন চলার পথের আপন জন। কিন্তু আমার এই পরিস্থিতিতে যখন তিনি আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন তিনি প্রথমেই ব্রেবফ স্কুলের সেই ১৯৩০ সালের দিকের তাঁর পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ডটা আমাকে দেখালেন। আমি দেখলাম রিপোর্ট কার্ডটার উপর থেকে নীচ পর্যন্ত এক টানে শুধু ‘এ’ লেখা অর্থাত সব বিষয়েই তিনি ছিলেন অসাধারণ। আমি জানতাম, মৌলিকভাবেই আমরা দু’জন ছিলাম দুই বৈশিষ্ট্যের মানুষ, আর আমাদের দু’জনের জীবনবোধও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
তিনি সব সময় তাঁর এমন স্বীকৃতির জন্য গর্ববোধ করতেন, এবং তিনি বুঝাতে চাইতেন এমন সব স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনি সত্যিই সম্পূর্ণ যোগ্য ছিলেন, কারণ এর জন্য তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন। কিন্তু পক্ষান্তরে, আমি সব সময়ই নিজে নিজেকেই বলতাম, আমার যদি সত্যিই কঠোরভাবে কাজ করতে হয়, সেটা আমার পরীক্ষায় শুধুমাত্র ভালো করা বা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভালো প্রশংসা পাওয়ার জন্য করা উচিত নয়। আমি সব সময় ব্যক্তিগত ইঁদুর দৌড়ে যারা সফল হতে ছুটোছুটি করে সেটার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলাম আর এমন মেকি প্রতিযোগিতার মধ্যে থেকে আমি কখনোই আমার জীবনকে অর্থহীন করতে চাইনি। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা