ভজন সরকার : কিংবদন্তি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর প্রয়াত হলেন। ৯২ বছর বয়সের যাপিত জীবন। রূপকথার গল্পের মতো জীবন ছিল লতাজির। দীর্ঘ ৭ দশক ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত জগতের মধ্যমনি। কী এক বর্ণাঢ্য জীবন! একেবারে ছকে বাধা জীবন যাকে বলে, তেমনি এক সুশৃংখল জীবন ছিল লতাজির। কত গান গেয়েছেন এই দীর্ঘ জীবনে? এই সংখ্যাটি জানার জন্যেও গবেষণা করতে হবে আগামী প্রজন্মকে। ভারতীয় উপমহাদেশ, মানে আজকের ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান তো বটেই, এমনকি নেপাল, ভুটানেও লতা মুঙ্গেশকর ছিলেন সমান জনপ্রিয়। খ্যাতি পেয়েছেন। সম্মান-ভালোবাসা পেয়েছেন। শ্রদ্ধা পেয়েছেন। পেয়েছেন বিশাল রাষ্ট্র ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত রতœ’ উপাধি। এ সব কিছু ছাপিয়ে সব চেয়ে মূল্যবান যা পেয়েছেন, তা হলো সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা।

লতা মুঙ্গেশকর সিনেমার গান গেয়ে খ্যাতি পেতে শুরু করেছেন গত শতাব্দির চল্লিশের দশকে। সে সময়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারাঠি সিনেমার গান দিয়ে শুরু করেন তাঁর প্লে-ব্যাকের ক্যারিয়ার। ১৯৪৬ সালে হিন্দি সিনেমায় প্রথম গান রেকর্ড করেন। সিনেমায় প্লে-ব্যাক করা তাঁর শেষ সিনেমা ‘বীরজারা”,মুক্তি পায় ২০০৪ সালে। জানা যায়, তিনি সর্বশেষ গান করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনির জন্য ২০১৯ সালে। ৩৬টি ভাষায় গান রেকর্ড করেছেন। বাংলাও ছিল তাঁদের অন্যতম।

জানা যায়, ১৯৫৬ সালে বাংলা সংগীতের আরেক দিকপাল শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করিয়ে নেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ গানটি লতাজির গাওয়া প্রথম বাংলা গান। তারপর থেকে অসংখ্য বাংলা গান গেয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর। নির্ভুল উচ্চারণের এ সব বাংলা গান শুনে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে, বাংলা তাঁর মাতৃভাষা ছিল না।

সলিল চৌধুরী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত সহ অনেক সুরকারের সুরে বাংলা গান গেয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যাঁকে হিন্দি সিনেমার জগতে সুরকার ও শিল্পী হেমন্তকুমার নামেই হিন্দি ভাষাভাষী মানুষ জানেন, তাঁর সুরেই অধিকাংশই বাংলা গান গেয়েছেন লতাজি। লতাজির কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম এলবাম বের হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত¡াবধানেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে এক সময় লতাজি রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন। মারাঠি ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়তেন লতা মুঙ্গেশকর।
আমার বাবা-মায়ের প্রজন্ম লতাজির গান শুনে শুনে বড় হয়েছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, লতা মুঙ্গেশকরের বিখ্যাত গান আমাদের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা শুনে শুনে বড় হয়েছি। আগামী অনেক প্রজন্মের মানুষও তেমনি মোহাবিষ্ঠ হয়ে থাকবেন লতাজির সেই কোকিলকন্ঠী মধুমাখা সুরের মূর্ছনায়।

জানা যায়, লতাজির গাওয়া বাংলা গানের সংখ্যাও ২০০টিরও অধিক। আমাদের কৈশোর-যৌবনের সেই রোমান্টিক দিনগুলো লতাজির গান শুনে শুনেই কেটেছে। হিন্দি গানের কথা বাদ দিলেও শুধু বাংলা গানের জনপ্রিয় সেই সব গান আমাদের প্রজন্মের ছিল মুখে মুখে।
আমার মতো কত মানুষের মধুময় স্মৃতির সরণী জুড়ে আছে লতাজির সেই সব কালজয়ী গান। ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘না যেও না’, ‘ওগো আর কিছু তো নয়’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, ‘সাত ভাই চম্পা,’ ‘নিঝুম সন্ধ্যায়,’ ‘চঞ্চল মন আনমনা,’ ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘তোমাকে শোনাতে এ গান যে গেয়ে যাই’-এর মতো বিখ্যাত সব গান আপামর বাঙালির মনপ্রাণ জুড়ে আছে দশকের পর দশক। লতাজির গাওয়া সব বাংলা গানই ছিল শ্রোতানন্দিত এবং বহুশ্রুত।

প্রায় সাত দশকের অধিক সময় ধরে এই সব গান সময়ের বাতাবরণ ছিন্ন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সমান ভালোবাসায় সমাদৃত হয়ে এসেছে। এ এক মহা বিস্ময়! একজন মানুষের কাছে এ এক মহাপ্রাপ্তি। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, লতা মুঙ্গেশকর তাঁর জীবনেই দেখে গেছেন মানুষ তাঁকে কতটা ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে।

লতাজি সে দিক থেকে সৌভাগ্যবতীই বটে। এ পৃথিবীতে কত প্রতিভাবান মানুষ অবহেলা-অনাদরে মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনকালে জানতেও পারেন নি, তাঁদের সৃষ্টিকর্ম এত সমাদৃত হবে। উদাহরণ হিসেবে, কবি জীবনানন্দ দাশের কথাই বলা যায়। বাংলা কবিতার এক মহত্ততম কবি জীবনানন্দ। বাংলা কবিতার ইতিহাস জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা গত কয়েক দশক ধরে সবচেয়ে বেশী পঠিত হচ্ছে। অথচ কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবনকালে জানতেও পারেন নি যে, বাংলা সাহিত্যের পাঠক তাঁর কবিতাকে এমন ভালোবাসবে। এক প্রকার অবহেলা আর ব্যর্থতার হতাশ নিয়েই তিনি মৃত্যবরণ (মতান্তরে ট্রামের নীচে আত্মহত্যা) করেন।

ইদানিং ‘ মরণোত্তর’ সম্মাননা নামে এক ‘অসভ্য ও অশালীন’ প্রথা চালু হয়েছে। একজন মানুষ মরে গেলে তাঁকে সম্মাননা দেওয়াতে কিংবা না-দেওয়াতে সেই মানুষটার কিছুই যায় আসে না। লতা মুঙ্গেশকর তাঁর জীবনকালেই দেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার দ্যুতিতে একটা গোটা উপমহাদেশের মানুষ কী রকমভাবে সম্মোহিত হয়ে থাকেন। একজন মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যু নিয়ে যে দর্শন উপলব্ধি করতেন, সেটা প্রাচীন ভারতের দর্শনশাস্ত্র উপনিষদ থেকে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বহুবার এ কথা স্বীকার করেছেন। কবি ‘ মৃত্যু শোক’ নিয়ে তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু সে দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহত পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড় মনোহর”।

কিংবদন্তি সুরসম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশকরের মহাপ্রয়াণে কোটি কোটি মানুষের মতো আমিও ব্যথিত ও শোকাহত। লতাজির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও )