শুজা রশীদ : (পর্ব ৩৮)
৪৮
আজ সকালে কিছুই করার নেই রিমার। ঢাকা গ্রোসারীতে বিকালে কাজ। আরোও বেশিক্ষণ কাজ করতে পারলে ভালো হত। হাত টানাটানি যাচ্ছে। লাইফ ইন্সুরেন্সের টাকাটা হাতে এলে ভালোই হবে। কয়েক দিন আগে অনেক দ্বিধা দ্ব›দ্ব করে শেষ পর্যন্ত ক্লেইম করেছে ও। ওকে জানানো হয়েছে ইনস্যুরেন্স কম্পানী কি ধরনের ইনভেস্টিগেশন করবে তার উপর নির্ভর করে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত লাগতে পারে ক্লেইমের প্রসেসিং হতে। সবাই অবশ্য ওকে বলেছে ওর চিন্তার কোন কারণ নেই। যদি কোন কারণে ইনস্যুরেন্স কম্পানী ওর ক্লেইম ডিনাই করে তাহলে সে উকিল ধরে কোর্টে কেস করতে পারবে। অনেক উকিলই এই জাতীয় কেস প্রো বোনো করবে।
রিমা আশা করছে পরিস্থিতি সেই দিকে গড়াবে না। ও ইতিমধ্যেই ওর বাচ্চাদের নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে। জাফরকে বলেছে বাসার সাথে সাথে ড্যানফোর্থে একটা ছোট দোকানও দেখতে। সেখানে ওর একটা পোশাক আষাকের দোকান খোলার শখ। অনেক দিন ধরেই ওর ব্যবসা করার ইচ্ছা। আবার পড়াশোনা করা কিংবা রিয়েল স্টেট এজেন্ট হবার জন্য কোর্স করা- দুটোরই পথ খোলা আছে কিন্তু ওর মন টানে ব্যবসার দিকেই।
রিমা জানত মিলা উইকএন্ডে বাসাতেই থাকবে। সকালে নাস্তা সেরে ছেলে দুজনকে লিয়াকতের এপার্টমেন্টে রেখে ফায়জাকে নিয়ে মিলার বাসায় চলে এলো ও।
মিলা তখনও ঘুমানোর পায়জামা পরে আছে, মুখে সবুজ একটা জৈবিক আস্তর। তাকে দেখে হাসিখুশি এবং উচ্ছল মনে হল। “কি দিয়েছ মুখে?” রিমা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়।
“চামড়ার যত্ন নিচ্ছি,” মিলা খুক করে হেসে উঠে বলে। “চায়ের পাতার সাথে মধু আর লেবুর রস মেশান। চামড়াটা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে, উজ্জ্বল করে দেয়। দেবে একটু?”
“আমি চাই না,” রিমা হাত নেড়ে বলে। “ঘটনা কি? মিস মিলা, তোমাকে দেখে এতো উচ্ছ¡সিত মনে হচ্ছে কেন?”
মিলা হেসে ওঠে। “উচ্ছ¡সিত? হতে পারে একটু। সব বলব তোমাকে।” এবার ফায়জার পেছনে লাগল সে। “মামনি, তুমি দেবে একটু? দেখবে চামড়ায় কেমন একটা সুন্দর অনুভূতি হয়। ভালো লাগবে।”
ফায়জা একটু দ্বিধা করে হলেও রাজী হয়ে যায়। লিভিং রুমে একটা চেয়ারে মেয়েটাকে বসিয়ে তার মুখে যতœ করে মিশ্রনটা মাখিয়ে দেয় মিলা। “শরীর এলিয়ে দাও। আধা ঘন্টা পরে ধুয়ে ফেলতে হবে।” নিজের মুখেরগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে রিমাকে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে যায় মিলা। “বললে বিশ্বাস করবে না, আমরা এক সপ্তাহর জন্য প্যারিস যাচ্ছি।”
“ডাক্তারের সাথে?”
“হ্যাঁ। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে!” মিলার মুখ খুশীতে জ্বল জ্বল করে ওঠে। “কি ভাবছি বলতে পারবে?”
“ও হয়ত তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে,” রিমা ঝট করেই আন্দাজ করে।
“ওকে আমার খুব ভালো লাগে। যেমন সুদর্শন তেমনি চমৎকার কথাবার্তায়। আর যা ভালো ব্যবহার! খুব আশা করছি বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তোমার কি মনে হয়? দেবে?”
“নিশ্চয় দেবে,” রিমা বলে, মিলাকে হতাশ করতে চায় না। মিলার বেশ কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে হৃদয় সংক্রান্ত ব্যাপারে। বিশেষ করে ওর আগের দুই স্বামীকে নিয়ে। রিমা মনে প্রাণে চায় ও ভালো কাউকে খুঁজে পাক। “কবে যাচ্ছ?”
“আগামী বৃহষ্পতিবারে! তার পরের বুধবারে ফিরে আসব। ও লন্ডনেও যেতে চেয়েছিল। আমি বললাম শুধু প্যারিসই ভালো। প্যারিসেই তো কত কি করার আছে! বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে। কতবার স্বপ্ন দেখেছি প্যারিসে যাবার। বিশেষ করে ওর সাথে যাবো- দারুণ হবে। ভাবতেই ভালো লাগছে!”
রিমা ঘন্টা খানেক থাকে। মিলার বকবকানিই শুনেছে। ওর নতুন বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে পারিসে গিয়ে কি কি করবে তার ফিরিস্তি- ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে যাবে, বিখ্যাত যাদুঘর দেখবে, আইফেল টাওয়ারে তো যেতেই হবে- তাকে থামানোই দুষ্কর। তাকে দেখে মনে হয়েছে সে যেন ছোট একটা মেয়ে যে ক্রিসমাসের সময় স্যান্টা ক্লজের কাছে যা চেয়েছিল ঠিক সেই উপহারটাই পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে।
ফেরার পথে ফায়জা বলল, “মিলা আন্টিকে এতো খুশী আমি আর কখন দেখিনি! সব ঠিকঠাক মত হলেই হয়।”
“আমিও মনে মনে সেটাই চাইছি,” মিলা বলে। “এতো ভালো মেয়েটা। কিন্তু কেমন করে যেন সব বদমাশগুলোই ওর কপালে এসে জোটে।”
রোববার বিকালে রাস্তায় ট্রাফিক তেমন নয়। ড্রাইভ করতে করতে রিমা ভাবে, এই ডাক্তারই যেন হয় মিলার সত্যিকারের প্রেমিক।
৪৯
জাহানকে কিভাবে সামাল দেবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না কালাম। রিমাদের বাসার দরজায় নিশুতি রাতে গিয়ে টোকা দেবার কথা তাকে সরাসরি গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ভুলই হবে। জাহান অম্লানবদনে অস্বীকার করবে এবং কালামই বরং একটা বিচ্ছিরি পাকে পড়ে যাবে। কাউকে কোন প্রমাণ ছাড়া এমন বাজে একটা ব্যাপারে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করাটা কেউ ভালো নজরে দেখবে না। আবার কিছু না করলেও নয়। রিমার কাছে খবর নিয়ে ও জেনেছে যেই করুক সে এখনও মাঝে মাঝেই রাতে দরজায় টোকা কিংবা ধাক্কা দেয়। প্রতিবারই তারা সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে এবং তটস্থ হয়ে থাকে।
কালাম প্রস্তাব দিয়েছিল দরজায় একটা ক্যামেরা লাগানোর। রিমা রাজী হয়নি। ভয় পেয়েছিল কেউ এসে ক্যামেরাটাই চুরি করে নিয়ে যাবে। যে বদমাশ রাতে ঝামেলা করছে সে নিজেই হয়ত সেটাকে নষ্ট করবার চেষ্টা করতে পারে। তার চোখে সেটা পরিস্থিতি আরোও খারাপের দিকে মোড় নেয়া। ও বরং এই যন্ত্রণা সহ্য করেই আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেবে। কিছুদিন বাদেই তো বাড়ি কিনে ওরা চলে যাবে। তখন ঝামেলা মিটে যাবে। কালাম অবশ্য ওর সাথে সম্মত হয়নি। ওদের নতুন বাড়ীতে গিয়ে যে এই বদমাশ হাজির হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তর নতুন ঠিকানা খুঁজে পাওয়াটা কি খুব কঠিন হবে?
রেস্টুরেন্টের কাজে যোগ দেবার পর সপ্তাহ দুই চুপচাপ কাটাল কালাম, সুযোগের সন্ধানে থাকল জাহানের সামনে বিষয়টা কোন একভাবে পাড়ার। জাহান তার দুঃসম্পর্কের ভাই দিনারের মত ততখানি নাক উঁচা নয়। দিনার কালামের সাথে পারতপক্ষে কোন কথাই বলে না। শুধু কোন কিছু নিয়ে বকাবকি করার সুযোগ পেলে মুখ খোলে। কালাম ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে পড়াশোনা করছে শোনার পর জাহান ওর প্রতি একটু বন্ধুত্বভাবাপন্ন হয়েছে। কালাম এবং সুফির সাথে পেছনের গলিতে সিগ্রেট টানার জন্যও যোগ দিয়েছে। সুফির মত সেও ধুমপানের নেশা ছাড়ার চেষ্টা করছে। দুঃখ করে বলেছে ওর সামান্য উপার্জনের বেশ খানিকটা চলে যায় এই নেশার পেছনে। দেশে থাকতে সবাই সিগ্রেট টানত। ব্যাপারটা মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল। অল্প বয়েসেই সিগ্রেট ধরেছিল। তার বন্ধুরাও সবাই ধুমপান করত। এই অভিশাপ থেকে সে কিছুতেই নিজেকে আর বের করতে পারছে না। সুফি লোকটাকে এমনিতে খুব একটা পছন্দ না করলেও এই একটা ব্যাপারে দুজনের কিছু মিল থাকায় তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হত।
“আমি যখন এখানে আসি,” একদিন সিগ্রেট বিরতির সময় জাহান বলে, “আমার বয়েস ছিল মাত্র বাইশ। দেশে থাকতে কমার্সে একটা ডিগ্রী নেবার চেষ্টা করছিলাম সাথে ছুটা কাপড়ের ব্যবসাও করছিলাম। দিদার ভাই বলল এখানে এসে এসিস্ট্যান্ট শেফ হিসাবে কাজ কর। আহমেদ স্যার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে দিলেন। আমি চলে এলাম। কাজ নিয়ে কোন সমস্যা নেই কিন্তু চেয়েছিলাম কলেজ ডিগ্রীটা নিতে তাহলে অফিসে কোন ভালো কাজ কর্ম করতে পারতাম।” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। “কিন্তু সেটা হবার এখন আর কোন সম্ভাবনা নেই। আমার বউ-বাচ্চা আছে। এই এসিস্ট্যণ্ট শেফের কাজে যে উপার্জন তাতে পরিবারের খরচ জুগিয়ে অন্য কিছু করার উপায় থাকে না। চেষ্টা করছি একটা ফুল শেফের কাজ পাবার। দিদার ভাইকে আবার বলে দিও না। সে বলে আমি পারব না। নিজের হাতে রাখতে চায়।”
“জীবনটাতো তোমার। দিনারের কথা তোমার শোনার দরকারটা কি?” সুফি সিগ্রেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে। “তোমার নিজের ভালো নিজেকেই দেখতে হবে।”
“সুফি ভাই, আপনি এমন গাল ভরা কথা বার্তা বলবেন না,” জাহান ওর উপরেই ক্ষেপে যায়। “আপনার না দেশ থেকে একটা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রী নেয়া আছে? আপনি নিজে কি করেছেন? কত বছর হল এই ওয়েটারে ফালতু কাজ করছেন? আসার পর থেকেই, ঠিক কিনা? আমাকে আবার লেকচার দিচ্ছেন!”
“আমি তোমাকে লেকচার দিচ্ছিলাম না!” সুফি আহত কন্ঠে বলে। “বলছিলাম তোমার নিজের ভালো নিজেকেই বুঝতে হবে। ভুলটা কি বললাম?”
“যেভাবে বলেছেন ঐটা শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়েছে,” তার দিকে একটা আঙ্গুল নাচিয়ে বলে জাহান। “আপনার ভাবসাব দেখে মনে হয় আপনি কি যেন এক পন্ডিত হয়ে গেছেন। আপনি স্রেফ একটা ওয়েটার!”
সুফি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। “আমি কিছু বললেই তুমি এমনভাবে ক্ষেপে যাও কেন?”
“কারণ আপনার আচার আচরণ আমার পছন্দ হয় না,” জাহান বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে।
কালাম ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে দিনার সুফিকে একেবারেই পছন্দ করে না যদিও সুফি মানুষ হিসাবে খুবই ভালো, নিজের কাজকর্ম নিয়েই ব্যাস্ত থাকে। দিনারের অপছন্দের কারণটাও সে খনিকটা আন্দাজ করতে পারে। আহমেদ, পিন্টু এবং মরিয়ম সবাই সুফিকে একটু ভিন্ন নজরে দেখে, সেটা ধরতে খুব কষ্ট হয় না। জাহান নিশ্চয় ওর ভাইয়ের দেখাদেখিই সুফির সাথে অকারণে এই শত্রুতার সৃষ্টি করেছে।
“সে তো তোমাকে খারাপ কিছু বলেনি,” সুফির সমর্থনে কালামকে মুখ খুলতেই হয়। “তার সাথে এইভাবে কথা বলাটা তোমার উচিৎ নয়। সে তোমার চেয়ে বয়েসে বড়। তাকে তোমার সম্মান দেখিয়ে কথা বলা উচিৎ।”
“কিসের সম্মান?” জাহান বাঁকা হাসি দেয়। “তার ঐসব ফালতু আলাপে কান দিও না।” হাতের সিগ্রেটটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পেষে সে, তারপর ভেতরে ঢুকে যায়, বলে যায় তাদেরও বিরতি শেষ হয়েছে।
“আপনার উচিৎ ওকে বকা দেয়া,” জাহান চলে যাবার পর সুফিকে বলে কালাম।
সুফি মাথা নাড়ে। “কি লাভ? আরোও বেশি করে অপমান করবে তখন। ওর মাথায় কখন কি ঘোরে আমি বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে অনেক ভালো ব্যহার করে আমার সাথে। যাই হোক, পিন্টু ভাই আর মরিয়ম ভাবী আমাকে পছন্দ করেন। ঐটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওর সাথে ঝামেলা করে আমার ভাবমূর্তিটা আমি নষ্ট করতে চাই না।”
কালাম চেয়েছিল সুফিকে দলে টেনে দুজনে মিলে জাহানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে কিন্তু সেই সম্ভাবনা স্বার্থক হবার কোন সুযোগ আছে বলে তার মনে হল না।
দিন দুই পরে তারা তিনজন যখন আবার পেছনের গলিতে জমায়েত হয় এক কর্ম বিরতির সময়, কালাম মনে মনে স্থির করে পরিস্থিতি তাঁতিয়ে দেবার। কিভাবে কি করবে ঠিক মনস্থ করতে না পারলেও সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। কোন একটা উপায় হয়েই যাবে।
“যখন এখানে কাজ করছ না তখন কি কর?” জাহানের বকবকানীর মাঝে একটু বিরতি পেয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ওঠে কালাম।
“কেন?” জাহান সতর্ক কন্ঠে বলে।
“খেলাধুলা কর?” কালাম তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
জাহান মাথা নাড়ে। “না। কয়েক বছর আগে একটা গ্রæপের সাথে খেলতাম। কিন্তু এখন আর সময় পাই না। আমার সারা দিন যায় ফালতু সব চাকরী করে। পরিবার আছে। টাকা পয়সা দরকার।
আমি তোমার মত ভবঘুরে না। খেলাধুলা হচ্ছে ভবঘুরেদের কাজ।”
“আমি ভবঘুরে না!” কালাম প্রতিবাদ করে। “আমি ফুল টাইম পড়াশোনা করছি এবং সাথে তিনটা পার্ট টাইম কাজ করি।”
“তাই নাকি?” জাহান মুখ বাঁকিয়ে বলে। “দেখব শেষ পর্যন্ত তুমি কি কর। প্রফেসর সুফির চেয়ে ভালো কিছু করতে পারো কিনা সেটাই দেখার বিষয় হবে।”
“সে ব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ রেখ না,” কালাম দৃঢ় কন্ঠে বলেছিল। “এমি একদিন বিরাট কোন কম্পানীর বড় অফিসার হব এবং তোমার মত মানুষজনকে হায়ার আর ফায়ার করব।”
জাহান মনে হল মনে মনে ব্যাপারটা একটু চিন্তা করে দেখল। শেষতক ঐ ব্যাপারে তর্কে না যাবারই সিদ্ধান্ত নিল। “হয়ত। তোমাকে দেখে মনে হয় তোমার মাথায় ঘিলু আছে। যদি সত্যি সত্যিই হতে পারো আমাদেরকে ভুলে যেও না।”
“ভুলব কেন?” কালাম একগাল হাসি নিয়ে বলে। “আমারতো বিশ্বাসী মানুষজন লাগবে। পিন্টু যেভাবে তোমাকে বিশ্বাস করে। আমার কেন যেন মনে হয় এই রেস্টুরেন্টের বাইরেও অন্যান্য কাজের জন্য পিন্টু তোমার সাহায্য নেয়। তাতে তোমার কিছু এক্সট্রা ইনকাম হয়।”
এই শেষ উক্তিটা জাহানের কানে লাগল। আধা পোড়া সিগ্রেটে একটা লম্বা টান দেবার জন্য মাত্র দুই ঠোঁটের ফাঁকে গুজেছিল, ওর কথা শুনে মাঝপথেই থেমে যায়, তার দুই চোখ চিকন হয়ে পড়ে, দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হয়। কালামের দিকে ফেরে। এইতো বাবা, ধরা খেয়ে গেছ!
“কি বললে?” সে সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে।
“কি সম্বন্ধে?” কালাম বোকা সাজে। এই সরিসৃপটাকে একটু খেলানোর ইচ্ছা ওর। তাছাড়া ক্ষেপে গেলে জাহান ঠিক কি করতে পারে সেই সম্বন্ধেও ও ঠিক নিশ্চিত নয়। নিজের চেয়ে শক্তিশালি কারোও সাথে সরাসরি শারীরিক সংঘর্ষে জড়ানোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার কোন লক্ষণ থাকে না। সেই পরিস্থিতিতে সে পড়তে চায় না। তার উদ্দেশ্য ছিল কোন একভাবে জাহানকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেয়া যে সে রিমাদেরকে ভয় দেখাচ্ছে এবং তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজটা আর না করতে রাজী করান। কিন্তু লোকটা তার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে কালামের ভয় হয় পরিস্থিতি সামাল দেয়াটা সমস্যাজনক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখন পিছিয়ে যাবারও আর সুযোগ নেই।
“আমার সাথে বেশী চালাকী করার চেষ্টা কর না,” জাহান তিক্ত কন্ঠে বলে। “তুমি কি বলতে চাও? আমি পিন্টুর পালা কুত্তা? তোমার ধারনা আমার দিকে অল্প কিছু টাকা পয়সা ছুড়ে দিলেই আমি সব কিছু করব?”
“ও সেটা বলেনি,” সুফি কালামের পক্ষ সমর্থন করে।”
জাহান হাতের সিগ্রেটটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পেষে। “ওর মুখ থেকেই শোনা যাক ও কেন বলেছে,” জাহান দুই চোখে আগুণ নিয়ে কালামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“যা বলেছি সেটা সত্য না মিথ্যে?” কালাম ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবার মানুষ না।
জাহান লম্বা একটা পদক্ষেপ নিয়ে কালামের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কালাম ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হলেই আপ্রাণ চেষ্টা করে সেটাকে লুকিয়ে রাখতে। “আমার সাথে বেশী চালাকি কর না,” জাহান বলে, “কি শুনেছ বল।”
সুফি ওদের দিকে ছোট এক পা এগিয়ে আসে পরিস্থিতিটাকে সামাল দেবার জন্য। জাহানের হাতে আস্তে করে একটা চাপড় দিয়ে বলে, “এটা নিয়ে খামাখা মাথা খারাপ কর না।”
জাহান ঘুরে সুফির দিকে ফেরে তারপর তার বুকে দুই হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। সুফি ছিটকে পেছনে চলে যায়, আছড়ে পড়ে মাটিতে। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে ধীরে ধীরে নিজেকে মাটি থেকে টেনে তোলে সে, হাত দিয়ে কাপড় থেকে ধুলাবালি ঝাড়তে থাকে। কালাম দ্রæত এগিয়ে আসে ওকে সাহায্য করতে। “সুফি ভাই, ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” সুফি হালকা গলায় বলে। বোঝাই যায় এটা নিয়ে সে খুব একটা গোলমাল পাকাতে চায় না। “আমার হাত মুখ ধুতে হবে। আমি ভেতরে যাচ্ছি।”
“আমিও আসছি আপনার সাথে,” কালাম বলে। এই পরিস্থিতি থেকে পালানোর একটা পথ খোঁজে সে।
“না, তুমি যাচ্ছ না,” জাহান এগিয়ে এসে কালামের সামনে দাঁড়ায়, তার পথ রুখে দেয়।
“সরে দাঁড়াও,” কালাম খেঁকিয়ে ওঠে। “সুফি ভাইকে ঐভাবে ধাক্কা মারাটা তোমার উচিৎ হয়নি। মানুষকে কোন সম্মান দিতে শেখ নি তুমি।”