ইউসুফ কামাল : সে রাতেও পুনুর সাথে বাসায় জম্পেশ আড্ডা গভীর রাত পর্যন্ত চলায় প্রায় ভোর রাতে ঘুমোতে গেলাম, ফলে আর ন’টার আগে উঠা হলো না। প্রথম ক্লাসটা ধরতে পারলাম না। বাসা থেকে বেড়িয়ে পপুলারে নাস্তা সেরে দশ’টায় ডিপার্টমেন্টে এসে ঢুকলাম। দেখি ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরির সামনের কড়িডোরে বিদ্যুত বুলার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই একটু হেসে দিলো, এগিয়ে গেলাম। বিদ্যুত বল্লো, ওঁকে নিয়ে একটু সদরঘাটে যাও, লঞ্চঘাটে একটু কাজ আছে, দেশ থেকে কিছু শীতের কাপড় পাঠিয়েছেন ওর মা। মনে হলো যেন বিদ্যুত আমাকে আদেশই করলো। একটা ক্লাশ ছিলো শেষ করে ওঁকে নিয়ে রিক্সা নিলাম। রিক্সায় ঘোরাটা অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কোন রকম আড়ষ্টতাই আগের মতো কাজ করতো না। দুজনই বেশ ফ্রী হয়ে গিয়েছিলাম। সম্পর্ক গভীর হয়ে গেলে যা হয়, বিষয়টা তেমনই। রিক্সায় পাশাপাশি বসার কারণেই বুলার সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধটা নাকে লাগতো, এখন মনে হয় কেন যেন ঐ গন্ধটাও অনেকটাই আপন হয়ে গিয়েছিলো। তা ছাড়া এটা যেনো তখন অনেকটা নেশার মতোই কাজ করতো। আপনজনের মতো হওয়ার কৃতিত্বটা অবশ্যই ওর সহজ সরল আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার। একে অন্যের পরিপূরকই মনে হতো, যেখানে কোন কিছুই অমার্জিত ছিলো না। পারস্পরিক ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ ছিলো বলেই সম্পর্কটায় কখনোই চিড় ধরেনি।
তখন বরিশাল ঢাকার যোগাযোগের বলতে গেলে একমাত্র মাধ্যমই লঞ্চ। কার্জন হল গুলিস্তান পার হয়ে নওয়াবপুর রোড হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢুকলাম। সারি সারি লঞ্চ বাঁধা ঘাটে। এখনকার মতো অবশ্য বড় বড় লঞ্চ তখন ছিলো না। ওর কথায় বুঝলাম বুলার এক মামার মালিকাধীন লঞ্চ ‘সালমা’। প্রয়োজনে ওর মা লঞ্চের সারেং মারফত টাকাসহ অন্যান্য জিনিষপত্র পাঠিয়ে দেন, শুধু ওটা সদরঘাট থেকে বিকেলের মধ্যে যেয়ে নিয়ে আসতে হয়। এ সমস্ত কারণেই ওটা খুবই নিরাপদ ও দ্রুত ব্যবস্থা ছিলো। খুঁজতে খুঁজতে টার্মিনালের শেষ মাথায় চলে এলাম, দেখি পল্টনের সাথে মোটা কাছি দিয়ে বাঁধা। লঞ্চের সামনে দাঁড়াতেই ওঁকে দেখে সারেং গোছের একজন হাতে একটা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট নিয়ে নীচে নেমে এলো। হাসি দেখেই বুঝলাম দুজনেই অনেক পরিচিত। প্যাকেটটার সাথে একটা এনভেলাপ বুলার হাতে দিলো। ধারণা করলাম হয়তো মাসের খরচের টাকাটা ওর মা পাঠিয়ে দিলেন। বাড়ি থেকে ওর মা এ ভাবে টাকা পাঠান বোঝা গেলো। হেসে বল্লাম, তুমি তো তাহলে এখন ধনী মানুষ। মনে আছে হাসি দিয়ে এনভেলাপটা আমার শার্টের বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিলো, তুমি নিয়ে নাও। হেসে বলেছিলাম, আরে না এ মনিহার আমার নাহি সাজে। তোমার থাকলেই আমার চলবে। যখন লাগবে চেয়ে নেবো। তোমার কাছেই থাক। দুপুরের খাওয়াও হয়নি, এখন তো হলে যেয়েও খাবার পাবে না। খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। রিক্সাওয়ালাকে স্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়ালে যেতে বল্লাম। প্রভিন্সিয়ালের বিরিয়ানী তখন আমার ও বুলার মতো অনেকেরই প্রিয়। খেয়াল করলাম সেদিনও আগের মতোই খাওয়ার পরে মিরান্ডা চাইলো ওয়েটার এর কাছে। এমন মিরান্ডা প্রেমী মানুষ খুব একটা পাইনি আমার জীবনে।

কর্নাট প্লেসের ঘোরাঘুরিতে বোঝা যায় দিল্লীর স্বচ্ছল মানুষের চালচলন পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের জীবন যাত্রার মতই আধুনিকতায় ভরা। যেমনি করে পুরান দিল্লীর আর নতুন দিল্লীর মানুষের জীবন যাত্রার মানের তুলনা করলে বোঝা যায় বৈষম্যটা কতটা প্রকট। আমাদের ঢাকার লক্ষীবাজার -সূত্রাপুরের সাথে ঢাকার গুলশান বনানীর পার্থক্যটা যেমন বেশি করে চোখে নাড়া দেয় ঠিক তেমনি। দিল্লীর দর্শণীয় স্থানসমুহের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্যের স্থান রাজঘাট। মূলত: এখানকার পারিপার্শিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্যের স্থানটা ভিন্নভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। নান্দনিক নকশায় ভিন্নভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে এই মহাপ্রাণ ব্যাক্তির মহাপ্রায়াণকে। এখান আসলেই যেন বোঝা যায় অহিংস নীতির এই ভারত স্বাধীনতার অগ্রদূত কে।

সারাদিন ঘুরে বিকেলে ঠিক করলাম আগামীকাল আগ্রা যাওয়া যায় কিনা। হোটেলে ফিরে ম্যানেজার তেওয়ারীকে আগ্রা যাওয়ার কথা বলাতে ভদ্রলোক ভালো উপদেশ দিয়ে বল্লেন, কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া ঠিক করে দিই, চারজনে আসা যাওয়া সাশ্রয়ী হবে। গাড়ির মিটারে যত মিটার ওঠে দেখে ভাড়া দিয়ে দিলেই হবে। আপনাদের ঘুরিয়ে এনে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে সমস্যা হবে না বরং সাথে গাড়ি থাকলে যখন যেখানে খুশী যেতে পারবেন। ট্রেনে গেলে ওখানে রাতে হোটেলে থাকতে হবে তাতে আপনাদের খরচ বাড়বে, আপনাদের একদিন সময়ও নষ্ট হবে। পরদিন সকালে রওয়ানা হয়ে গেলাম। দিল্লীর সাথে বাইরের প্রদেশ আর বড় শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত তা আমাদের ধারণাই ছিলো না। প্রশস্ত রাস্তা আর ট্রাফিক ব্যবস্থা খুবই উন্নত, সর্বোপরি যানবাহনের চালকদের মধ্যে আইন মেনে চলার সদিচ্ছা প্রবল। বিস্ময়কর বিষয় হলো বন্ধু সিকো একবার ড্রাইভারকে সিরিয়াল ভেংগে আগে যেতে বল্লেও সে গেলো না, যেটা করতে আমাদের দেশের ড্রাইভাররা রিতিমতো অভ্যস্ত।

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লোদী সাম্রাজ্যের সুলতান সিকান্দর শাহ্ আগ্রাকে দিল্লীর রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তিতে মোঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলের কিছুদিনও এখান থেকেও তারা রাজধানী হিসাবে রাজকার্য্য পরিচালনা করে। আগ্রা প্রধানত: তাজমহলের জন্যেই বেশি পরিচিত। সম্রাট শাহজাহান সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তাজমহলের কাজ শেষ করেন। সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর পৃথিবীতে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প কর্ম হিসেবে তাজমহলকে বিবেচিত করা হয়। পরবর্তিতে যমুনার অপর পাড়ে কালো পাথর দিয়ে সম্রাট শাহজাহান আরো একটি স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আওরঙ্গজেব তখন ক্ষমতায়, দ্বিতীয় এমনি আরো একটি কালো পাথরের তাজমহল তৈরী করলে পুরো রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে চিন্তা করে সে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যায়ের পক্ষে মত না দেওয়ায় সেটা আর হয়নি। সেটার সামান্য কিছু ভগ্ন নিদর্শন এখনও তাজমহলের পিছনে যমুনার অন্যপাড়ে দেখা যায়।

শেষ জীবনে সম্রাট শাহজাহানকে আগ্রা ফোর্টের একটি কক্ষে পুত্র আওরঙ্গজেব কর্তৃক বন্দীত্ব জীবন কাটাতে হয়েছে, সেখানে পিতার সাথে স্বেচ্ছা বন্দিত্ব জীবন বরণ করেন তদ্বীয় একমাত্র কন্যা জাহানারা। সম্রাটের সমগোত্রীয় কোন উপযুক্ত পাত্র না পাওয়ায় তাকে চির জীবন অবিবাহিত জীবন পালন করতে হয়। কথিত আছে-সম্রাট শাহজাহান পূর্নিমা রাতে তার কক্ষ থেকে মমতাজের কথা স্মরণ করে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর জাহানারার শেষ ইচ্ছা ছিলো তার মৃত্যুর পর যেনো কোনো সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের কবরের পাশে কবর না দিয়ে তাকে যেনো আধ্যাত্মিক সুফি সাধক নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কবরের পাশে দিল্লিতে কবর দেওয়া হয়। আরো নির্দেশ ছিলো কবরের উপর যেন কোনো আচ্ছাদন না থাকে। উন্মুক্ত আকাশের নীচে যেন সারা জীবন ঘুমিয়ে থাকতে পারেন। তাজমহলে পৌঁছার আগে ড্রাইভার একটা ধাবা’র সামনে যাত্রা বিরতি করলো খাওয়ার জন্য। এই স্থানে খাওয়ার জন্য তন্দুরী সাথে তরকারী, বিভিন্ন ধরনের ডাল জাতীয় খাবারই শ্রেয়।

সবাই খেয়ে আবার উঠে পড়লাম। সবাই দিল্লীর খাবারে যে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। মোটামুটি কেউই খাবার খেয়ে যে তৃপ্ত হচ্ছে না সেটা সবার চেহারায় ফুটে উঠছে। তাজমহল থেকে সামান্য একটু দূরে গাড়ি থেকে নেমে বেশ অনেক খানি রাস্তা হেঁটে তাজমহলে ঢুকতে হয়। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখের সামনে তাজমহল, একটু দূর থেকেও যেন বোঝার উপায় নেই সামনে এমন একটা মহান কীর্তি। সবাই থমকে গেলাম চোখের সামনে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যকে সরাসরি দেখতে পেয়ে। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে ভালোবাসার নিদর্শন দেখতে। চারজনই থমকে দাঁড়ালাম, কারো মুখেই কোনো কথা নেই। উপরের রাস্তা থেকে সিঁড়ির বেয়ে একটু নামতে হয়। তখনও প্রচুর মানুষ দেখলাম তাজমহলের চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যমুনা কিনারে শাজাহানের স্বপ্ন শতদল শ্বেত মর্মরে মরমের ব্যাথা
বিরহের অশ্রুজল তুমি ছবি, প্রেমের কবির তুলিতে আঁকা
তুমি জোস্না কপোত অমরার পদ্মে মেলেছো পাখা
মমতাজ নাই আজ শাহজাহান নাই আজ প্রেম আজো ফেলে ছায়া স্নিগ্ধ শ্যামল
তাজমহল তাজমহল তাজমহল তাজমহল তাজমহল তাজমহল।।
মনে পড়ে গেলো মৃণাল চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত গান। সারা পৃথিবীর প্রেমিকদের কাছে যেনো অনন্য এক তীর্থ স্থান হয়ে গেছে এই তাজমহল। অনন্য অসাধারণ এক অনুভূতির উপত্ত্তিস্থল।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল: লেখক, হিউস্টোন, টেক্সাস, আমেরিকা